ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দীপংকর গৌতম

আলোকিত সময়ের চিত্রকলা

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১০ নভেম্বর ২০১৭

আলোকিত সময়ের চিত্রকলা

‘সেটা শ্রেষ্ঠ সময়, সেটা নিকৃষ্ট সময়, সেটা বিচক্ষণতার যুগ, সেটা বোকামির যুগ, সেটা বিশ্বাসের যুগ, সেটা আলোর ঋতু, সেটা আশার বসস্ত, সেটা নৈরাশ্যের শীত, আমাদের সামনে সবকিছু ছিলো, কিছুই ছিল না, সকলেই আমরা সোজা স্বর্গের দিকে যাচ্ছি। সোজা আমরা উল্টো পথে হাঁটছিÑ সেই পথ এ পর্যন্ত আজকের পর্বের মতোই। যেখানে শোরগোল তোলা কর্তৃপক্ষের কেউ কেউ ভালর জন্যই হোক বা চরমতম মাত্রার তুলনার দাবিদার।’ ফরাসী বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে লেখা চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস, ‘এ টেল অফ টু সিটিজ’-এর শুরুটা এভাবেই করেছেন চার্লস ডিকেন্স। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পুরনো যুগ ও তার মূল্যবোধ শেষ হচ্ছে, নতুন যুগের অভ্যুদয় ঘটছে। চরম উত্তেজনায় ভরপুর আশা-নিরাশায় দুলছে শুধু ফরাসী দেশ নয় গোটা ইউরোপ। কার্ল মার্কসের ভাষায় এই বিপ্লবে ‘বুর্জেয়ারা বিজয়ী হয়েছিল; কিন্তু সেই সময় বুর্জোয়ার বিজয় ছিল এক নতুন সমাজ ব্যবস্থার বিজয়। (The bourgeois and the counter Revoulation-১৮৪৮) এরপর ১৯১৭-এর বলশেভিক বিপ্লব। প্রতিষ্ঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। বিপ্লব আলোড়ন তুলেছিল সেখানকার শিল্প সাহিত্যের জগতেও। কত শত লেখক-শিল্পী তখন বিশ্ব সংস্কৃতির প্রচল ধারাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। সে এক স্বপ্নের আবেশ ছড়ানো দিন। লেনা কিংবা ভল্গার বুকে তখোন সৃষ্টিশীলতার উল্লাস চলছে । শিল্প-সংস্কৃতির এই বিপ্লব সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিল। বিশ্বের বহু ভাষায় চলল তার অনুবাদ। শিশুতোষ থেকে বড়দের জন্য লেখা সেসব বই মেধা বিকাশ ও সৃজনশীল চর্চায় অনন্য ভূমিকা রেখেছিল। স্বপ্নের সেই দিনগুলো শিল্পকলাকে কতটা বিকশিত করেছিল তা একটি ধারণা মেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাশিয়ার চিঠিতে। তিনি লিখেছেন ‘এখানে ছবির মিউজিয়মের কাজ কী রকম চলে তার বিবরণ শুনলে নিশ্চয় তোমার ভাল লাগবে। মস্কো শহরে ট্রেটিয়াকভ গ্যালারি নামে এক বিখ্যাত চিত্রভা ার আছে। সেখান থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত এক বছরের মধ্যে প্রায় তিন লাখ লোক ছবি দেখতে এসেছে। যত দর্শক আসতে চায় তাদের ধারণা শক্ত হয়ে উঠেছে। সে জন্য ছুটির দিনে আগে থাকতে দর্শকদের নাম রেজিস্ট্রি করানো দরকার হয়েছে। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পূর্বে যে সব দর্শক এ রকম গ্যালারিতে আসত তারা ধনী মানী-জ্ঞানী দলের লোক এবং তারা, যাদের এরা বলে নড়ঁৎমবড়রহব, অর্থাৎ পরশ্রমজীবী। এখন আসে অসংখ্য স্বশ্রমজীবীর দল, যথা রাজমিস্ত্রি, লোহার, মুদি, দরজি ইত্যাদি। আর আসে সোভিয়েত সৈনিক, সেনানায়ক, ছাত্র এবং চাষী-সম্প্রদায়। আর্টের বোধ ক্রমে ক্রমে এদের মনে জাগিয়ে তোলা আবশ্যক। এদের মতো আনাড়িদের পক্ষে চিত্রকলার রহস্য প্রথম দৃষ্টিতে ঠিকমতো বোঝা অসাধ্য। দেয়ালে দেয়ালে ছবি দেখে দেখে এরা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, বুদ্ধি যায় পথ হারিয়ে। এই কারণে প্রায় সব মিউজিয়ামেই উপযুক্ত পরিচালক রেখে দেয়া হয়েছে। মিউজিয়ামের শিক্ষা বিভাগে কিংবা অন্যত্র তদানুরূপ রাষ্ট্রকর্মশালায় যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক কর্মী আছে তাদেরই মধ্যে থেকে পরিচায়ক বাছাই করে নেয়া হয়। যারা দেখতে আসে তাদের সঙ্গে এদের দেনা-পাওনার কোন কারবার থাকে না। ছবিতে যে বিষয়টা প্রকাশ করছে সেইটে দেখলেই যে ছবি দেখা হয়, দর্শকরা যাতে সেই ভুল না করে পরিদর্শয়িতার সেটা জানা চাই। চিত্রবস্তুর সংস্থান (পড়সঢ়ড়ংরঃরড়হ), তার বর্ণকল্পনা (পড়ষড়ঁৎ ংপযবসব), তার অঙ্কন, তার অবকাশ (ংঢ়ধপব), তার উজ্জ্বলতা (রষষঁসরহধঃরড়হ), যাতে করে তার বিশেষ সম্প্রদায় ধরা পড়ে সেই তার বিশেষ আঙ্গিক (ঃবপযহরয়ঁব) সকল বিষয়ে আজও অল্প লোকেরই জানা আছে। এ জন্য পরিচায়কের বেশ দস্তুরমতো শিক্ষা থাকা চাই, তবেই দর্শকদের ঔৎসুক্য ও মনোযোগ সে জাগিয়ে রাখতে পারে। আর একটি কথা তাকে বুঝতে হবে, মিউজিয়ামে কেবল একটি মাত্র ছবি নেই, অতএব একটা ছবিকে চিনে নেয়া দর্শকের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়; মিউজিয়ামে যে সব বিশেষ শ্রেণীর ছবি রক্ষিত আছে তাদের শ্রেণীগত রীতি বোঝা চাই। পরিচায়কদের কর্তব্য কয়েকটি করে বিশেষ ছাদের ছবি বেছে নিয়ে তাদের প্রকৃতি বুঝিয়ে দেয়া। আলোচ্য ছবিগুলোর সংখ্যা খুব বেশি হলে চলবে না এবং সময়ও বিশ মিনিটের বেশি হওয়া ঠিক নয়। ছবির যে একটি স্বকীয় ভাষা, একটি ছন্দ আছে সেইটেই বুঝিয়ে দেয়ার বিষয়; ছবির রূপের সঙ্গে ছবির বিষয়ের ও ভাবের সম্বন্ধ কী সেইটে ব্যাখ্যা করা দরকার। ছবির পরস্পর-বৈপরীত্য দ্বারা তাদের বিশেষত্ব বোঝানো অনেক সময় কাজে লাগে। কিন্তু দর্শকদের মন একটুমাত্র শ্রান্ত হলেই তাদের তখনই ছুটি দেয়া চাই। অশিক্ষিত দর্শকদের এরা কী করে ছবি দেখতে শেখায় তারই একটা রিপোর্ট থেকে উল্লিখিত কথাগুলো তোমাকে সংগ্রহ করে পাঠালাম। এর থেকে আমাদের দেশের লোকের যেটি ভাববার কথা আছে সেটি হচ্ছে এই পূর্বে যে চিঠি লিখেছি তাতে আমি বলেছি, সমস্ত দেশকে কৃষি বলে যন্ত্রবলে অতিদ্রুতমাত্রায় শক্তিমান করে তোলবার জন্যে এরা একান্ত উদ্যমের সঙ্গে লেগে গেছে। এটা ঘোরতর কেজো কথা। অন্য সব ধনী-দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের জোরে টিঁকে থাকার জন্য এদের এই বিপুল সাধনা। আমাদের দেশে যখন এই জাতীয় দেশব্যাপী রাষ্ট্রিক সাধনার কথা ওঠে তখনই আমরা বলতে শুরু করি, এই একটিমাত্র লাল মশাল জ্বালিয়ে তুলে দেশের অন্য সকল বিভাগের সকল আলো নিবিয়ে দেয়া চাই, নইলে মানুষ অন্যমনস্ক হবে। বিশেষত ললিতকলা সকল প্রকার কঠোর সংকল্পের বিরোধী। স্বজাতিকে পালোয়ানি করবার জন্য কেবলই তাল ঠুকিয়ে পাঁয়তারা করাতে হবে, সরস্বতীর বীণাটাকে নিয়ে যদি লাঠি বানানো সম্ভব হয় তবেই সেটা চলবে, নতুবা নৈব নৈব চ। এই কথাগুলো যে কতখানি মেকি পৌরুষের কথা তা এখানে এলে স্পষ্ট বোঝা যায়। এখানে এরা দেশজুড়ে কারখানা চালাতে যে সব শ্রমিকদের পাকা করে তুলতে চায়, তারাই যাতে শিক্ষিত মন নিয়ে ছবির রস বুঝতে পারে তারই জন্য এত প্রভূত আয়োজন। এরা জানে, রসজ্ঞ যারা নয় তারা বর্বর; যারা বর্বর তারা বাইরে রুক্ষ, অন্তরে দুর্বল। রাশিয়ায় নবনাট্যকলার অসামান্য উন্নতি হয়েছে। এদের ১৯১৭ খ্রীস্টাব্দের বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গেই ঘোরতর দুর্দিন দুর্ভিক্ষের মধ্যেই এরা নেচেছে, গান গেয়েছে, নাট্যাভিনয় করেছে এদের ঐতিহাসিক বিরাট নাট্যাভিনয়ের সঙ্গে তার কোন বিরোধ ঘটেনি।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় রাশিয়ায় চিঠি বা মিউজিয়ামের যে বিকাশ ঘটেছিল তার কারণ ছিল একটা। বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বিপ্লবের একটি ধারা তৈরি হয়েছিল যার নাম সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজম বা সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ। ঐতিহাসিক সত্য হলো, ১৮৮০-এর দশকে প্রভাববাদের বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া তা এই শিল্পধারার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সম্ভাবনার আগেই এসে গিয়েছিল। একটি শিল্পকর্মে স্থায়ী ভাব (সড়ঃরভ) ভিন্ন ভিন্ন রঙের বৈচিত্র্যে উপস্থাপন ১৮৯০-এর দশকের বৈশিষ্ট্য। (বিমূর্ত শিল্পকলার ধারণা ও বাস্তবতা- শরীফ আতিক-উজ-জামান, আরাদ্ধ, ২৯ নভেম্বর, ২০১৫) পুঁজিবাদী শাসকদের এই মতবাদের প্রভাববাদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় প্রথমে ফ্রান্সে, পরে ইউরোপজুড়ে। এই প্রতিক্রিয়া ছিল শিল্পীর জীবনের অভিজ্ঞতাজাত। ভ্যান গঘ ও গগ্যাঁ তাদের চিত্রকলায় নিজেদের সমাজ-বিচ্ছিন্নতাকে নানা বর্ণে তুলে ধরেছেন। গগ্যাঁর বন্ধুবলয়ে আরও শিল্পীরা ছিলেন যারা পরিণত সময়ে বুর্জোয়া সমাজের আশীর্বাদ ছেড়েছেন বা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। ১৮৮৫ সালের দিকে একজন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ শিল্পকলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন এমন ভাবনাটাই অবাস্তব ছিল। তখন শিল্পীর স্বাধীনতা আর নৈতিক সততা ছাড়া কিছু ছিল না। প্রভাববাদ প্রকৃতিকে অনুভূতিনির্ভর চিত্রকল্পের জন্য একটি ব্যক্তিগত ও অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে রূপান্তর করেছে। সেই সঙ্গে অসুখী মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে পুঁজিবাদের দিকে আকৃষ্ট করেছে। প্রাথমিক দিকেও প্রভাববাদের একটি নৈতিক ভিত্তি ছিল। এর প্রথাহীন দৃশ্যকল্প, অবিরত পাল্টে যাওয়া বহির্প্রকৃতির অন্বেষণ বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। ১৮৬০ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে শহরকেন্দ্রিক যে স্বাচ্ছন্দ্য তা তখনকার চিত্রকলার বিষয় ও নান্দনিক ভাবনার মধ্যে সক্রিয় ছিল। এসব ভাবনায় জারের আমলের শিলঈদের মগজকে স্থবির করে রেখেছিল। শিল্পকে তারা একান্ত নিজস্ব নান্দনিক পরিতৃপ্তির বিষয় বলে মনে করতেন। একদিকে প্রভাবভাবাদ অন্যদিকে ভবিষ্যতবাদের পথ পরিষ্কার করে চিত্রকলা মানবিক বোধের এক অতীন্দ্রিয় শিল্পমাধ্যমে রূপ নেয়। যার নাম হয় সমাজতান্ত্রিকবাস্তববাদ। গোর্কির নেতৃত্বে এ আান্দোলন শুরু হরে অযুত শিল্পীরা অবস্থান নেয় এ শিল্প আন্দোলনে। ইতোপূর্বে শিল্পীদের যে বিচ্ছিন্নতা, নিয়ন্ত্রণহীনতা, বেপথু জীবন, আত্মহনন প্রবৃত্তি সব ধুয়ে মুছে শিল্পীদের নতুন এ সংগ্রামে অযুত শিল্পী অবস্থান নেয়। শিল্পীরা এক স্বাভাবিক ছকে নিজেদের স্থাপন করে। এদেরে মধ্যে নেতৃত্বে ছিলেন বিশ্বখ্যাত শিল্পী মার্ক সাগাল, কান্ডিনেস্কি, মেলভিচ, গোয়েন্ডেরেভা প্রমুখ। ১৯১৯ সালে সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজম বিশ্বের তাক লাগানো এক সম্মেলনের আয়োজন করে। যার নেতৃত্বে ছিলেন তাকলিন। এ সম্মেলনে সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের এটি শিল্পিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়। যথাস্থানে যথাবস্তু। আমারা একে রিয়েলিস্টিক থেকেও এক ধাপ আগানো শিল্পধারা বলে চিন্তা করতে পারি। তবে থার্ড সম্মেলনের পরে সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজম মূল বিন্যাসটি পায় শিল্পী প্রিডাভিজস্কি এবং এক সময়ের ফিউচারিস্ট শিল্পী লা ফিমোভিচ ও রেপিনের হাতে। রাজনৈতিক চেতনার উজ্জীবিত হয়ে ও চেতনার বিকাশ ঘটাতে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবাদের শুরু হয়। আনাতলি লুনাচারস্কি বলশেভিক পার্টির পক্ষ থেকে এটি দেখভালের দায়িত্ব নেন। এ ধারার যেসব চিত্রকলা ও ভাস্কর্য তখন তৈরি হয় তার মধ্যে- করবিনের মস্কো ব্রিজ, সুখমিনের অর্ডার টু এ্যাটাক, গ্রামিসভের পার্টি কংগ্রেস, ব্রডস্কির লেনিন ইন স্মলনি, ল্যাকটিওনভের লেটার ফ্রম দ্য ফ্রন্ট, ডেইনিকার ডিফেন্স অব সেবাসটোপল। এমন অজস্র শিল্পীদের কাজে ভরে যাচ্ছে মস্কোর মিউজিয়াম। বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে ব্যস্ত ভাস্কর গড়ছে মহামতি লেনিনের ছবি, কোথাও বা কাস্তে-হাতুড়ি হাতে কৃষক শ্রমিকের কাফেলা। ১৯৩২ সালে যোশেফ স্ট্যালিন শিল্পের এ ধারাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অনুমোদন দেন। শিল্পের এই নতুন দর্শন তখন সারাবিশ্বের শিল্পীদের তুলিতে জুড়ে দেয় নতুন ভাষা। যে ভাষা শ্রমজীবী মেহনতী মানুষের শ্রম উঠে আসে তুলিতে-কলমে। ইতোপূর্বে ইউরোপের ধারা প্রভাববাদ বা ভবিষ্যতবাদ যখন পুঁজিবাদী জার শাসিত সোভিয়েতের শিল্পীদের আচ্ছন্ন ও জীবনবিমুখ করে রেখেছিল। সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজমের জয়জয়কারে ইউরোপের পুঁজিবাদী সমাজ তখন শিল্পের নতুন মাত্রা দাদা ইজম, ফিউচার ইজম নিয়ে মেতে ওঠে। এর মধ্যেও এটা স্পষ্ট হয় যে সমস্ত ধারাই রুশ বিপ্লবের আলোয় আলোকিত। মানুষ, বস্তু বা তার কাজকে উপজীব্য করে গড়ে ওঠা এ শিল্পমাধ্যমে শ্রমজীবী ও মেহনতী মানুষ ও তার কাজ উঠে আসতে থাকে তুলি-কলমে। আজ শতবর্ষ পরে আমরা যে দেয়ালিকা বা পোস্টার করি। প্রতিবাদের ভাষা আঁকি দেয়ালে প্ল্যাকার্ডে ফেস্টুনে এসবই রুশ বিপ্লবের ফলাফল। বা সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজমের ফলাফল। শিল্প-সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচার-বিবেচনার ধারাটি প্রাচীন নয়। বলা যায় রুশ বিপ্লবের সমান বয়সী। তবে এ বিষয় নিয়ে ভিন্নমত এবং যুক্তিতর্কের বহুমাত্রিক বয়ান কম নয়। তবে ওই বিতর্কের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছেÑ শিল্প সৃষ্টির পেছনে দুটো শক্তি সক্রিয়। প্রথমত শ্রম যা মূলত মানসিক, কিছুটা দৈহিক, অন্যদিকে শ্রম, বস্তু ও মেহনতের প্রভাব। শেষোক্ত দিকটি, বিশেষত শ্রম হয়ে ওঠে সৃষ্টির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রেরণা। সময়ের ধারায় ও মানবসভ্যতার বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় শিল্প ও সৃষ্টিতে উভয় ক্ষেত্রেই কথাগুলো সত্য। যেমন সাহিত্যে তেমনি স্থাপত্যে- চিত্রকলায় ও ভাস্কর্যে। তবে এক্ষেত্রে শিল্প সৃষ্টিই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এই শিল্পের সহজিয়া দিক সারা বিশ্বের চেতনাসম্পন্ন মানুষকে শিল্পী করে তুলেছে, শিল্পকে নিয়ে গেছে হাতের কাছে। শিল্প সৃষ্টির মৌল তাগিদ, নন্দনতাত্ত্বিক ভাষায় প্রেরণা মূলত কারও মতে ‘মনুষ্যস্বভাবে’ নিহিত, অন্য মতে প্রয়োজনের তাগিদে। এখানে বিষয়টির নন্দনতাত্ত্বিক বিবেচনা। শেষোক্ত মত ক্রিস্টোফার কডওয়েলের। শিল্পের উৎস ও তার নন্দনতাত্ত্বিক বিচার ব্যাখ্যায় এমন মন্তব্যই তিনি করেছেন। মার্কসবাদীদের একাংশ ওই প্রয়োজনের সঙ্গে বিশেষভাবে ‘শ্রম’কে যুক্ত করেছেন গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে। যা কিছু সম্ভব হয়েছে শিল্পের সঙ্গে মেহনতী মানুষের সম্পর্কের কারণে। শিল্পকলা তাই রুশ বিপ্লবের কাছে ঋণী থাকবে বিশ্ব যতকাল টিকে থাকবে।
×