ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান স্বস্তি পরিষদের

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৯ অক্টোবর ২০১৭

মিয়ানমারে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান স্বস্তি পরিষদের

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা বন্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের গোপনীয় ‘আরিয়া ফর্মুলা’ বৈঠক থেকে মিয়ানমারের প্রতি ফের আহ্বান জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে গত ১৩ অক্টোবর নিরাপত্তা পরিষদের ওই অনানুষ্ঠানিক গোপনীয় বৈঠকে অংশ নেয়া বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিরা দেশটির প্রতি এ আহ্বান রাখেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আরিয়া ফর্মুলা বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনে আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, বৈঠকে রাখাইন এ্যাডভাইজরি কমিশনের চেয়ারম্যান জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনান, জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশন ইউএনএইচসিআর ছাড়াও বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা সহিংসতা বন্ধের এ আহ্বান জানায়। মন্ত্রী বলেন, রাখাইনে আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু সহিংসতা এখনও বন্ধ হয়নি বলে বৈঠকে তুলে ধরেন ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি। তার বক্তব্যে রাখাইন রাজ্যের প্রকৃত চিত্র অনেকটাই উঠে আসে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আরিয়া ফমুর্লা বৈঠকে প্রতিনিধিরা বলেছেন, রাখাইনে সহিংসতা বন্ধের কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না এবং (বাংলাদেশে) অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেই চলেছে। রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত নির্মম নির্যাতনের কথাও তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে। মাহমুদ আলী জানান, সহিংসতা বন্ধ ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে সেকথা কোফি আনান তার বক্তব্যে তুলে ধরেছেন। তার নেতৃত্বাধীন কমিশনের প্রতিবেদন গ্রহণ করায় এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানানোয় মিয়ানমারকে তিনি ধন্যবাদ দেন। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তার কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নে বিশেষত বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেয়ার জন্য আহ্বান জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বৈঠকে ড. আনান এ বিষয়ে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া মিয়ানমারে অবিলম্বে সহিংহতা বন্ধ করে রাখাইনে মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রবেশাধিকার দিতে আহ্বান জানান তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী জানান, আরিয়া ফর্মুলা বৈঠক শেষে দেয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নিরাপত্তা পরিষদের চলতি মাসের সভাপতি ফ্রান্স সহিংসতার এ ঘটনাকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ আখ্যায়িত করেছে। সমসাময়িক সঙ্কট বা সমস্যা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের অনানুষ্ঠানিক গোপনীয় সভা আরিয়া ফর্মুলায় পরিষদের সদস্যরাষ্ট্র ছাড়াও সংশ্লিষ্ট অন্য রাষ্ট্র, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রী জানান, বৈঠকে নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের দুই মিত্র দেশ রাশিয়া ও চীনের মধ্যে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে অবস্থানের পরিবর্তন দেখা গেছে। রাশিয়া কোফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়ন চেয়ে বক্তব্য দিয়েছে। চীন প্রতিবেদন বাস্তবায়নের কথা না বললেও তাদের বক্তব্যে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। । চীনের বক্তব্যে কোফি আনান কমিশনের বক্তব্য নেই। কিন্তু চীন বলেছে, এ লোকগুলো পরশুদিন যায়নি। যুগ যুগ ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বসবাস করছে। এতেই বোঝা যায়, চীন ও রাশিয়া বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য গোটা বিশ্ব বাংলাদেশকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। এক বছরের কম সময়ে এ সঙ্কট সমাধানে আমরা আশাবাদী। তিনি বলেন, জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ৫ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। সহিংসতা বন্ধ না হওয়ায় ১৯৯২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখে দাঁড়িয়েছে। এখন নিরাপদে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে পাঠানো আমাদের লক্ষ্য। বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মিয়ানমারের ওপর চাপ রাখা অত্যন্ত জরুরী যা বাংলাদেশ চালিয়ে যাচ্ছে। আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ১৩ সেপ্টেম্বরে নিরাপত্তা পরিষদ রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম বিবৃতি দিয়েছে। উন্মুুক্ত আলোচনায় রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি ভূমিকা রয়েছে বলে কোফি আনান জানিয়েছেন। মন্ত্রী বলেন, ওই আলোচনায় চীন ও জাপান রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত যাওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু সহিংসতা বন্ধের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, মিয়ানমারের উর্দিওয়ালাদের কাছে আমরা আরও তথ্য দেব যে, রোহিঙ্গারা তাদের দেশের নাগরিক। কিছুদিন আগেও তারা রোহিঙ্গাদের পুরস্কৃত করেছে। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে আয়োজিত এবারের আরিয়া ফর্মুূলা সভায় নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ দেশ এবং অস্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র বলিভিয়া, মিসর, ইথিওপিয়া, ইতালি, জাপান, কাজাখস্তান, সেনেগাল, সুইডেন, ইউক্রেন ও উরুগুয়ে ছাড়াও আমন্ত্রিত হিসেবে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইইউ, ওআইসি, ইউএনএইচসিআর ও জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক সংস্থা ওসিএইচএ অংশ নেয়। নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে ইতোমধ্যে প্রায় পৌনে ছয় লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আগে থেকে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করায় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়েছে। এ অবস্থায় এখনও নির্যাতনের মুখে রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশমুখী হচ্ছে অসংখ্য রোহিঙ্গা। গত দুই মাসে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বার বার সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানো হলেও মিয়ানমার সাড়া দেয়নি।
×