ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইউনিটপ্রতি ৫৭ পয়সা বাড়বে

বিদ্যুতের পাইকারি দর ১১.৭৮ ভাগ বৃদ্ধির সুপারিশ

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বিদ্যুতের পাইকারি দর ১১.৭৮ ভাগ বৃদ্ধির সুপারিশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সারাদেশে বিদ্যুতের বাল্ক বা পাইকারি দর ১১ দশমিক ৭৮ ভাগ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কারিগরি কমিটি। কমিটির এই সুপারিশ মেনে নেয়া হলে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি ৫৭ পয়সা বৃদ্ধি পাবে। সোমবার রাজধানীর ট্রেডিং কর্পোরেশন টিসিবি মিলনায়তনে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রথম দিনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। পাইকারি দরে বিতরণ কোম্পানিগুলো বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছ থেকে বিদ্যুত কিনে থাকে। স্বাভাবিকভাবে পাইকারি দর বৃদ্ধি পেলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পাবে। আজ মঙ্গলবার থেকে গ্রাহক পর্যায়ে দরবৃদ্ধির প্রস্তাবের শুনানি শুরু হবে। কারিগরি কমিটি তাদের সুপারিশে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির জন্য জ্বালানির উচ্চদরকে দায়ী করেছে। কমিটি বলছে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিদ্যুত উৎপাদনে জ্বালানি সরবরাহ করলে এক হাজার ৮৭১ কোটি ৫০ লাখ টাকা সাশ্রয় সম্ভব হতো। যাতে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ৩২ পয়সা কমে আসত। দেশে ডুয়েল ফুয়েল (দ্বৈত জ্বালানি) এক হাজার ৮০৮ মেগাওয়াটের মধ্যে ৮০৮ মেগাওয়াট ডিজেল দিয়ে চালানো হচ্ছে। এরমধ্যে আরপিসিএলের ১৪৯ মেগাওয়াট এবং মেঘনাঘাটে সামিট পাওয়ারের ৩০৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র দুটি গ্যাসে চালানো সম্ভব হলে ইউনিট প্রতি জ্বালানি সাশ্রয় হতো ১৩ দশমিক ১২ টাকা। এছাড়া পিডিবির প্রায় ৪০ বছরের পুরাতন বিদ্যুত কেন্দ্রর উৎপাদন ব্যয় পড়ছে ৩৭ দশমিক ৪৮ টাকা। এসব কেন্দ্র বন্ধ করা হলেও বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব। শুনানিতে পিডিবির তরফ থেকে চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ দাবি করেন সন্ধ্যায় আমাকে গ্রাহকের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দিতে হয়। কাজেই তখন বাড়তি দরের কথা না চিন্তা করে আমরা উৎপাদনের দিকে মন দেই। হুট করে চাইলেই অনেক কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে পুরাতন কেন্দ্রে রিপাওয়ারিংসহ বিদ্যুতখাত সংস্কারের নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেহেতু জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের সঙ্কট রয়েছে তাই তেলে বিদ্যুত উৎপাদনের বিকল্প নেই। আমরা কয়লা দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদনের চেষ্টা করছি তবে এটি সময় সাপেক্ষ। প্রসঙ্গত পিক আওয়ারে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উচ্চদরের কেন্দ্রগুলোও চালানো হয়। এতে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নেয়া পদক্ষেপগুলোর দিকেও খুব একটা নজর দেয়া হয় না বলে শুনানিতে অভিযোগ করা হয়। গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিইআরসির কাছে দেয়া পিডিবির পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়, বর্তমানে প্রতি ইউনিট পাইকারি বিদ্যুতের গড় সরবরাহ ব্যয় ৫ দশমিক ৫৯ টাকা । অথচ পিডিবি পাইকারি প্রতি ইউনিট বিদ্যুত ৪ দশমিক ৮৭ টাকায় সররাহ করছে। এতে দেশের একক পাইকারি বিদ্যুত ক্রয়-বিক্রয় প্রতিষ্ঠান পিডিবির ইউনিট প্রতি আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ৭২ পয়সা। চলতি অর্থবছর বা ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে পিডিবির প্রাক্কলিত পাইকারি বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় ধরা হয়েছে ইউনিট প্রতি ৫ দশমিক ৯৯ টাকা। এ হিসেবে বর্তমানে ইউনিট প্রতি যে সরবরাহ ব্যয় রয়েছে তার মধ্যে পার্থক্য ইউনিট প্রতি ১ দশমিক ৯ টাকা। শুনানিতে জিটিসিএলের সাবেক পরিচালক (অপারেশন) সালেক সুফি বলেন, মাস্টারপ্লান-২০১০ এ বলা হয়েছে ৫ ভাগ তরল জ্বালানিতে বিদ্যুত উৎপাদন করা হবে। কিন্তু এখন ৩২ ভাগ বিদ্যুত তরল জ¦ালানিতে উৎপাদন করা হচ্ছে। যাতে করে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। সরকার বা পিডিবির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যর্থতার দায় জনগণের কাঁধে চাপানো হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। সালেক সুফি বলেন, এর আগে সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২০১৪ সালে বিদ্যুতের দাম কমানো হবে। কিন্তু এখন ২০১৭ তে এসে দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এখন পিডিবি যে গ্যাসের সরবরাহ পায় তা দিয়ে অন্তত সাড়ে আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু কেন্দ্র পুরাতন হওয়ায় তা সম্ভব হচ্ছে না। প্রসঙ্গত, বর্তমানে যেসব বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সরাসরি জ্বালানি তেল আমদানি করছে তাদের প্রতি লিটার ফার্নেস তেলে খরচ হয় ২২ টাকা। আর বিপিসির কাছ থেকে পিডিবি ফার্নেস তেল ৪২ টাকা লিটার ও ডিজেল ৬৫ টাকা দরে কিনে নেয়। বেসরকারী কেন্দ্রগুলোকে বিদ্যুতের জন্য আনা তেলে কোন রাজস্ব তো দিতেই হয় না উল্টো তারা দশ শতাংশ প্রণোদনা পেয়ে থাকে সরকারের কাছ থেকে। আর বিপিসিকে গড়ে প্রায় ৭ শতাংশ রাজস্ব দিতে হয়। এ প্রেক্ষিতে সম্প্রতি বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, পিডিবিকে জ্বালানি তেল আমদানি করার অনুমতি দিলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। শুনানিতে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, পিডিবিকে নতুন করে তেলের ব্যবসায় না জড়িয়ে বিপিসির কাছ থেকে যেন কম দামে তেল সরবরাহ পাওয়া যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিদ্যুতের দামের হিসেবের মধ্যে মোট বড় রকমের গোঁজামিলের হিসেব রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। শুনানির সভাপতিত্ব করেন বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম। গণশুনানিতে পিডিবির পক্ষে সংস্থাটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদের নেতৃত্বে পিডিবির বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। এ ছাড়া বিইআরসির সদস্যরা ছাড়াও এতে অংশ নেন বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি প্রস্তাবের ওপর গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক এ কে মাহমুদ, সদস্য কামরুজ্জামান, বেগম হামিদা ইদ্রিসসহ প্রমুখ। গণশুনানির বাইরে বামদের বিক্ষোভ বিদ্যুতের গণশুনানি যখন চলছিল তখন অডিটরিয়ামের বাইরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সামাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-খালেকুজ্জামান) ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। বিক্ষোভ সমাবেশে বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, বিদ্যুত খাতের দুর্নীতি বন্ধ ও প্রশাসিক ব্যয় কমিয়ে বিদ্যুতের দাম দেড় টাকা পর্যন্ত কমানো সম্ভব। এ সময় বক্তব্য রাখেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম, বাসদের মানস নন্দী, বজলুর রশিদ ফিরোজ, সিপিবির সাজ্জাদ জহির চন্দন ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের হামিদুল হক প্রমুখ।
×