ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাক্ষাতকারে এরশাদ

শান্তিরক্ষী পাঠানো ছাড়া মিয়ানমারে শান্তি ফিরবে না

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

শান্তিরক্ষী পাঠানো ছাড়া মিয়ানমারে শান্তি ফিরবে না

রাজন ভট্টাচার্য, টেকনাফ, কক্সবাজার থেকে ॥ মিয়ানমারের নদীর পানি লাল হয়েছে মানুষের রক্তে। শিশুদের কুচি কুচি করে কেটে হত্যা করা হয়েছে। নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে। হাসতে হাসতে মানুষের গলা কেটে দেয়া হয়েছে। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বসতি। গ্রামের পর গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। এটা কোন সভ্যতার মধ্যে পড়ে না। একজন সভ্য মানুষ হিসেবে এ রকম নিষ্ঠুরতা সহ্য করাও কঠিন। মিয়ানমারে যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তা গোটা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ ও বিশ্ব নেতাদের হৃদয়ে নাড়া দেবে। কারণ মানুষ মানুষের ওপর এ রকম নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাতে পারে না। এত বড় মানবিক বিপর্যয় পৃথিবীতে আর হয়নি বলেও মনে করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। শুক্রবার কক্সবাজারের একটি হোটেলে জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রীর এই বিশেষ দূত। রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের করণীয়, জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়েও মতামত দেন তিনি। বলেন, বাংলাদেশের উচিত বিশ্ববাসীর কাছে আর্থিক সহযোগিতা চাওয়া। ভারত, চীন ও মার্কিন সরকারসহ তিনটি প্রভাবশালী দেশ ব্যক্তিস্বার্থের জন্য মানবতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। মিয়ানমার সরকারের পক্ষে কাজ করছে। তাদের কিছু বলছে না। তাই মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা কঠিন হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশ্ব নেতাদের এককাট্টা হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর অব্যাহত চাপ সৃষ্টি ও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সেখানে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর বিকল্প নেই বলেও মনে করেন এরশাদ। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য ‘সেভ জোন’ করারও পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো না হলে মিয়ানমারে চলমান মানবিক বিপর্যয় রোধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। সুচিকে বিশ্ববাসী ছি! ছি! করলেও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশ্ববাসীর জোড়ালো কোন ভূমিকা নেই। চলমান রাজনীতি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অবস্থান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে খোলামেলা আলোচনা করেন এরশাদ। একজন সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানে করণীয় প্রসঙ্গে এরশাদ বলেন, গোটা পৃথিবীর কাছে আমার আহ্বান মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি কর। তাদের কোনভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। মিয়ানমার অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘সেভ জোন’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জাতিসংঘের নেতৃত্বে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর কোন বিকল্প নেই। মিয়ানমারের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শান্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। এজন্য সেখানে একটি পৃথক শান্তিবাহিনী গঠন করাও জরুরী বলে মনে করেন তিনি। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এত বড় বিপর্যয় পৃথিবীতে আর হয়নি। সেখানে নদীর পানি লাল হয়েছে মানুষের রক্তে। শিশুদের কুচি কুচি করে কেটে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী ও সন্ত্রাসীরা। নারীদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার এখনও চলছে। হাসতে হাসতে মানুষের দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হচ্ছে। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বসতি। এটা কোন সভ্যতার মধ্যে পড়ে না। একজন সভ্য মানুষ হিসেবে এরকম নিষ্ঠুরতা সহ্য করাও কঠিন। মিয়ানমারে যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তা গোটা বিশ্বের বিবেকবান নেতাদের হৃদয়ে নাড়া দেবে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নিজ দেশে ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে এরশাদ বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া উচিত। এর কোন বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অন্য দেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবে না। শত অনুরোধেও তারা বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে আশ্রয় দিতে রাজি হবে না। তাই বর্তমানে সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আর্থিক সহযোগিতা চাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। আরেকটি বড় বাস্তবতা হলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা আরেকটি দীর্ঘ মেয়াদী সঙ্কটের মুখে পড়তে যাচ্ছি। কারণ বেশিরভাগ রোহিঙ্গা নির্যাতনের কারণে এখন নিজ দেশে ফিরতে নারাজ। আমরা কিভাবে তাদের খাবার দেব, নিরাপত্তা দেব, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করব। এখন অনেকে ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে আসছেন। কয়েকদিন পর আর কেউ আসবে না। তখন তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব বর্তাবে সরকারের ওপর। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের পাাশে থাকার মৌখিক সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশ্ববাসীর জোড়ালো কোন ভূমিকা নেই। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করতে হলে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনী মিয়ানমারে পাঠানোর বিকল্প নেই। এই ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। কোন দেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মানবিক বিপর্যয়সহ নানা ইস্যুতে শান্তিরক্ষী বাহিনী কাজ করে। তবে প্রশ্ন হলো, মিয়ানমার সরকার শান্তিরক্ষী বাহিনী গ্রহণ করবে কিনা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চালের দাম বৃদ্ধি ও খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে কিনা এমন প্রশ্নে এরশাদ বলেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে আমাদের দুটি ফসল সম্প্রতি নষ্ট হয়েছে। দেশের উত্তর ও হাওড় অঞ্চলে খাদ্য সঙ্কটের কথা মানুষ ভুলে গেছে। সরকার পরিস্থিতি মোকাবেলায় আতপ চাল আমদানি করেছে। কিন্তু মানুষ এই চাল খায় না। যে কোন মূল্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য সঙ্কট কোথায় গিয়ে শেষ হবে আমি জানি না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি অভিযোগ করে এরশাদ বলেন, মিয়ানমারের ১০ লাখ রোহিঙ্গার স্বার্থের কথা বিশ্ববাসীও ভাবল না। তাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করার কেউ নেই। আজও কোন দেশ অত্যাচারের প্রেক্ষিতে কঠোর প্রতিবাদ করেনি। জাতিসংঘের মহাসচিব ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ অন্য দেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বললেও জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এরশাদ বলেন, শক্তিশালী কিছু রাষ্ট্রের স্বার্থের কারণে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ নিয়েছে তারা। কোন কোন দেশ মিয়ানমারে ইকোনমিক জোন করবে, বাণিজ্য করবে। তাই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। আমি মনে করি রোহিঙ্গাদের অত্যাচার না করে অর্থনৈতিক জোনে কাজে লাগাতে পারত। যতই বলি ধর্মীয় ইস্যুতে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আমি কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে কোন হিন্দু শরণার্থী পাইনি। মুসলমানদের তাড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য থেকেই এই অত্যাচার, নির্যাতন করা হচ্ছে বলেও মনে করেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্প্রতি দেয়া আউং সান সুচির বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে এরশাদ বলেন, তার দেয়া জনবিরোধী বক্তব্য বিশ্ববাসী গ্রহণ করেনি। আমিও প্রত্যাখ্যান করছি। সুচি এখন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। তাই তার নিজস্ব কোন মতামত নেই। গোটা পৃথিবী এখন সুচিকে ছি! ছি! করছে। তিনি সামরিক জান্তার কাছে বন্দী, হয়ত এ কারণেই তার কিছু করার নেই। সুচির নোবেল পুরস্কার বাতিলের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নোবেল পুরস্কার দেয়ার পর বাতিলের নজির পৃথিবীতে নেই। তবে গণতন্ত্রের লড়াইয়ের জন্য তাকে নোবেল দেয়া হলেও তা পালনে তিনি ব্যর্থ। গণতন্ত্রের জায়গা থেকে তিনি সরে গেছেন। আমরা এখন যে সুচিকে দেখছি তিনি গণতন্ত্রের নেত্রী নন। গণতন্ত্র চর্চাও করেন না। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশে প্রবেশ করলে দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নত হতে পারে কিনা এমন প্রশ্নে সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, আপাতত নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা করছি না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশে সন্ত্রাসী তৎপরতার কথা যারা বলছেন আমি মনে করি এটি রাজনৈতিক বক্তব্য। এই অভিযোগ কথার কথা। প্রকৃত তথ্য হলো মিয়ানমারে চারটির বেশি প্রদেশে ৫০ হাজার যুবককে বিভিন্ন স্থানে একত্রিত করে হত্যা করা হয়েছে। বিধবা নারী আর সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদে এখন সবাই কাতর। তাদের কারও পক্ষে সন্ত্রাসী কর্মকা- করা সম্ভব নয়। দেশের চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে নানা ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর এই বিশেষ দূত বলেন, এক সময় দেশে এত বিশৃঙ্খলা ছিল না। দিন দিন তা বাড়ছে। বাসে, রাস্তায়, বাড়িতে ধর্ষণের মতো জঘন্য সামাজিক অপরাধ অহরহ ঘটছে। বাবা সন্তাকে হত্যা করছে। সন্তান বাবাকে হত্যা করছে। আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। সর্বোপরি সামাজিক অবক্ষয় বাড়ছে। যা গোটা জাতির জন্য সুখকর সংবাদ নয়। এমন বাস্তবতায় মানুষ ভাল থাকতে পারে না। তিনি বলেন, সরকার নিজেদের অবস্থান থেকে মানুষ ভাল আছে দাবি করলেও দেশ কিভাবে চলছে এর জবাব মানুষের কাছেই আছে। তাদের জিজ্ঞেস করুন। জবাব পাবেন। দেশে এখন মানুষের নিরাপত্তার বড়ই অভাব। সার্বিক নিরাপত্তা ব্যাহত। এটি আরেকটি বড় সমস্যা। এসব বিষয়ে সরকারের এখনই নজর দেয়া উচিত বলে মনে করেন প্রবীণ এই রাজনীতিক। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সময়মতো হবে এমন আশার কথা জানিয়ে সাবেক এই রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি এখনও আশাবাদী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সময়মতোই হবে। কোন বিপর্যয় নির্বাচন ঠেকাবে না। মিয়ানমার ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে এখন যুদ্ধাবস্থার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির কারণে সরকার সময়মতো নির্বাচন না করার চিন্তা করতে পারে। সরকারের এমন চিন্তা করা কোনভাবেই ঠিক হবে না। কারণ যুদ্ধাবস্থায়ও কোন দেশের নির্বাচন বন্ধ থাকতে পারে না। এরকম নজির পৃথিবীতে হয়ত নেই। বাস্তবতা হলো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া নির্বাচন বন্ধ থাকে না। রাখার কোন নিয়মও নেই। আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অবস্থান ও প্রস্তুতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুচকি হাসেন এরশাদ। বলেন, আমি বারবার একক নির্বাচনের কথা বলছি। দলের সব কর্মী যেন একথায় আশাবাদী হয়। দলের অবস্থান আরও ভাল হয়। একক নির্বাচনের চিন্তা থেকেই ২৮৯ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছি। ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার ইচ্ছা আছে। তবে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ততই পরিবর্তন হবে। সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে আমরা কোন জোটে যাব, নাকি এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেব।
×