ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্থায়ী সমাধান চাই ॥ জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

স্থায়ী সমাধান চাই ॥ জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের রাখাইনে জাতি ও ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সদর দফতরের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে এই আহ্বান জানান। খবর বাসস’র। প্রধানমন্ত্রী অবিলম্বে মিয়ানমারে সহিংসতা ও জাতিগত নিধন নিঃশর্তভাবে বন্ধ করে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি প্রস্তাবও পেশ করেন। সেগুলো হলো- ‘প্রথমত, অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা, দ্বিতীয়ত, অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা, তৃতীয়ত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং এই লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা, চতুর্থত, রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা এবং পঞ্চমত, কোফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।’ সাধারণ পরিষদের এই অধিবেশনে বক্তব্য দিতে তিনি চতুর্দশবারের মতো উপস্থিত হয়েছেন উল্লেখ করে বাংলায় ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তবে আমার হৃদয় আজ দুঃখে ভারাক্রান্ত। কেননা, আমার চোখে বার বার ভেসে উঠছে ক্ষুধার্ত, ভীত-সন্ত্রস্ত এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মুখচ্ছবি।’ তিনি বলেন, ‘আমি মাত্র কয়েক দিন আগেই আমার দেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে দেখা করে এসেছি যারা ‘জাতিগত নিধনে’র শিকার হয়ে আজ নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য মতে, গত তিন সপ্তাহে বাংলাদেশে ৪ লাখ ৩০ হাজার শরণার্থী এসেছে। অথচ জাতিগত নিধনের শিকার এসব রোহিঙ্গা হাজার বছরেরও অধিক সময় ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে আসছেন।’ শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এই মুহূর্তে নিজ ভূখন্ড থেকে বিতাড়িত ৮ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছি। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান নৃশংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থার ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। তিনি বলেন, এতে আমরা ভীষণভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, যখন দেখি এই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া ঠেকানোর জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সীমানা বরাবর স্থলমাইন পুঁতে রাখছে। এসব মানুষ যাতে নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন এখনই তার ব্যবস্থা করতে হবে, যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারে চলমান সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করে বলেন, এ বিষয়ে আমাদের সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি মেনে চলে। শেখ হাসিনা, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা বন্ধে এবং ওই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ও জাতিসংঘের মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানান। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি চাই, মানব ধ্বংস নয়- মানবকল্যাণ চাই। এটাই হোক আমাদের সকলের লক্ষ্য। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক প্রথম ভাষণের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের হয়ে প্রথমবারের মতো এখানে ভাষণ দেয়ার সময় এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে তাঁর অঙ্গীকারের কথা বলে গেছেন। তিনি বলেন, সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘এমন এক বিশ্বব্যবস্থা গঠনে বাঙালী জাতি উৎসর্গীকৃত, যে ব্যবস্থায় সকল মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচার লাভের আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হবে। এবং আমি জানি আমাদের এ প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মধ্যে আমাদের লাখ লাখ শহীদের বিদেহী আত্মার স্মৃতি নিহিত রয়েছে।’ শান্তির প্রতি তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই আমরা শান্তিকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করে চলেছি। এ উপলব্ধি থেকেই সাধারণ পরিষদে ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর ‘শান্তির সংস্কৃতি’ (কালচার অব পিস) শীর্ষক প্রস্তাব পেশ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া পুনরায় শুরুর আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করা এবং ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য এবং শত্রুতা নিরসনের জন্য আমি সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আশা করি, শান্তি বিনির্মাণে জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকা অব্যাহত থাকবে। এ লক্ষ্যে ‘অব্যাহত শান্তি’র জন্য অর্থায়ন বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছ থেকে আমরা সাহসী এবং উদ্ভাবনমূলক প্রস্তাব প্রত্যাশা করছি। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘জাতিসংঘ শান্তিবিনির্মাণ তহবিলে’ ১ লাখ মার্কিন ডলার প্রতীকী অনুদান প্রদানের ঘোষণাও করেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যতম সেনা ও পুলিশ সদস্য প্রদানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনসমূহের কার্যকারিতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা সমুন্নত রাখার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে আমরা আমাদের নিজস্ব প্রস্তুতি এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া বজায় রেখে চলছি। যে কোন জরুরী পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক অঙ্গীকার প্রদান, শান্তিরক্ষীদের প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি এবং অধিক সংখ্যায় নারী শান্তিরক্ষী মোতায়েনে আমরা সদা প্রস্তুত রয়েছি। ‘যৌন নিপীড়ন’ সংক্রান্ত যে কোন অভিযোগের বিষয়ে তার সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ প্রেক্ষাপটে ‘যৌন নিপীড়ন’ সংক্রান্ত যে কোন অভিযোগের বিষয়ে আমরা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি মেনে চলি। আমাদের এই নীতির প্রতিফলন হিসেবে আমরা জাতিসংঘ মহাসচিব প্রস্তাবিত ‘যৌন নিপীড়ন’ সংক্রান্ত ‘ভলান্টারি কমপ্যাক্টে’ সমর্থন প্রদান করেছি। তিনি বলেন, ‘যৌন নিপীড়ন’ সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবেলায় আমি মহাসচিবের ‘সার্কেল অব লিডারশিপে’র প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ ছাড়া এ বিষয়ে গঠিত ‘ভিকটিম সাপোর্ট তহবিলে’ প্রতীকী অনুদান হিসেবেও প্রধানমন্ত্রী এক লাখ মার্কিন ডলার অনুদানের ঘোষণা দেন। ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ এবং সহিংস জঙ্গীবাদের বিরোধিতা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সহিংস জঙ্গীবাদ বিস্তার রোধে তৃণমূল পর্যায়ে তার সরকার পরিবার, নারী, যুবসমাজ, গণমাধ্যম এবং ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করেছে। শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা সন্ত্রাসীদের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন বন্ধ এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্তর্জাতিক বিবাদ-মীমাংসার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। একজন সন্ত্রাসীর কোন ধর্ম, বর্ণ বা গোত্র নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি নিজে বেশ কয়েকবার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছি। সে হিসেবে আমি সন্ত্রাসের শিকার মানুষের প্রতি আমার সহানুভূতি প্রকাশ করছি। আমি মনে করি, তাদের সুরক্ষা দেয়া প্রয়োজন।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থপাচার, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন এবং অন্যান্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘবদ্ধ অপরাধের ক্ষেত্রে সাইবার জগত থেকে উদ্ভূত হুমকি মোকাবেলা এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে আমি জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ভয়াবহতম গণহত্যার শিকার হয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী ৩০ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি হয়েছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে চিহ্নিত ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে তারা এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। বাঙালী জাতিকে মেধাশূন্য করতে তারা দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। তিনি বলেন, গণহত্যার শিকার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সম্প্রতি ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। মূলত, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’র মাধ্যমে তারা এই গণহত্যার সূচনা করেছিল। এই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত মূল অভিযুক্তদের তার সরকার ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের কোথাও যাতে কখনই আর এ ধরনের জঘন্য অপরাধ সংঘটিত না হয় সে জন্য আমি বিশ্ব সম্প্রদায়কে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, ’৭১-এর গণহত্যাসহ সকল ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমাদের এ লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বৈশ্বিক বিষয়ে যেমন অভিবাসন, শরণার্থী সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তন এসডিজি এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কে তার সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ নিরাপদ, সুশৃঙ্খল এবং নিয়মিত অভিবাসনকে উৎসাহিত করে। ‘গ্লোবাল কমপ্যাক্ট অন সেফ অর্ডারলি এ্যান্ড রেগুলার মাইগ্রেশনে’র মাধ্যমে একটি সুস্থ ধারার অভিবাসন-কাঠামো তৈরির জন্য গত বছর আমরা একটি প্রস্তাব পেশ করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, এ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে আজ অভিবাসন এবং উদ্বাস্তু সংক্রান্ত ‘কমপ্যাক্ট’ গঠনের বিষয়ে জাতিসংঘে আলোচনা চলছে। তিনি বলেন, ‘এদের দুঃখ-দুর্দশা আমি গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর আমি আমার ছোট বোনকে নিয়ে ৬ বছর উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছি।’ জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে আমরা আশাবাদী। জাতীয় পর্যায়ে জলবায়ু সংবেদনশীলতার দিকে লক্ষ্য রেখে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় আমরা কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে গ্রীন ইকোনমি এবং ‘ব্লু-ইকোনমি’র সম্ভাবনার প্রতি আমরা আস্থাশীল। তার নেতৃত্বে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বন্যা এবং অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবেলায় দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য দেখিয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে আমরা শস্য-নিবিড়করণ প্রযুক্তি এবং বন্যা-প্রতিরোধী ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছি। এ বছর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে যে ব্যাপক বন্যা আঘাত হেনেছে আমরা তা সফলভাবে মোকাবেলা করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, পানি বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের প্যানেলের সদস্য হিসেবে আমি এ সংক্রান্ত ‘সমন্বিত কর্ম-পরিকল্পনা’ বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার প্রদান করছি। ২০১৫ সালের মধ্যে আমরা আমাদের ৮৭ শতাংশ নাগরিকের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করেছি। ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ জনগণকে নিরাপদ পানি সরবরাহের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, আমরা মনে করি শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য দারিদ্র্য, ক্ষুধা, নিরক্ষরতা এবং বেকারত্ব দূর করা অত্যন্ত জরুরী। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে তার সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ক্ষেত্রে আমাদের সরকার সমাজের সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার নীতি গ্রহণ করেছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম-আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে রূপান্তরের যে রূপকল্প আমরা হাতে নিয়েছি, এসডিজি তারই পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। তিনি বলেন, মূলত এসডিজি গ্রহণের অনেক আগে থেকেই আমরা বেশকিছু কর্মসূচী এবং সামাজিক নীতি বাস্তবায়ন শুরু করেছি যা পরবর্তীকালে এসডিজিতেও প্রতিফলিত হয়েছে। এসব কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- ‘একটি বাড়ি একটি খামার’, কমিউনিটি ক্লিনিক, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচী, নারীর ক্ষমতায়ন, সবার জন্য শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং বিনিয়োগ ও উন্নয়ন। এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি এবং অঙ্গীকারের বিষয়গুলো আমরা এ বছর জাতিসংঘে ‘ভলান্টারি ন্যাশনাল রিভিউ’য়ের মাধ্যমে তুলে ধরেছি, বলেন তিনি । প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক দুই চার শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ৩২.১ বিলিয়ন ডলার। দারিদ্র্যের হার ১৯৯১ সালের ৫৬.৭ শতাংশ হতে কমে বর্তমানে ২৩.২ শতাংশ হয়েছে। তিনি বলেন, মাথাপিছু আয় ২০০৫-০৬ অর্থবছরের ৫৪৩ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছরে উন্নীত হয়েছে। এসব সূচক মূলত আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়নকেই নির্দেশ করে। শেখ হাসিনা বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং সকলের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে আমরা সারাদেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি। তিনি বলেন, ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীর আওতায় আমরা সমাজের সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি যেমন বয়স্ক ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী, পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী এবং আর্থিকভাবে দুর্দশাগ্রস্তদের সহায়তা করছি। শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধীদের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অটিজমসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য ১০৩ সেবাকেন্দ্র এবং ৩২ মোবাইল থেরাপি ভ্যান কাজ করছে। তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে সারাদেশে সাড়ে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জেলা ও উপজেলা হাসপাতাল হতে মোবাইল ফোন ও ওয়েব ক্যামেরার মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিটি গ্রামে একটি করে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। দেশের ৩৮ হাজার ৩৩১ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল এবং মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। যুবসমাজকে কারিগরি এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করতে চাই যে, এ বছরের মধ্যেই আমরা প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করার পরিকল্পনা নিয়েছি।’ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে আমাদের যুবসমাজ মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা এমন একটি পরিবেশ তৈরির জন্য কাজ করছি যেখানে তারা যুগোপযোগী শিক্ষা গ্রহণ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে এবং প্রকৃত অর্থেই বিশ্ব নাগরিকে পরিণত হবে।’
×