ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্মরণ ॥ শংকর গোবিন্দ চৌধুরী

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

স্মরণ ॥ শংকর গোবিন্দ চৌধুরী

আজ ১৩ সেপ্টেম্বর শংকর গোবিন্দ চৌধুরীর ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ছিলেন আমাদের মাতামহ। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন এবং দাদুর ঘনিষ্ঠজনদের মুখেই আমরা শুনে এসেছি তাঁর মহত্ত্ব ও অমায়িক গুণাবলীর কথা। সবার মুখে শুনেই বুঝতে পারি, মানুষ হিসেবে তিনি মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্বের যে নিদর্শন রেখে গেছেন তা কখনই ভোলার নয়। তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। নাটোরবাসীর ছায়া ও ভরসার জায়গা ছিলেন শংকর গোবিন্দ চৌধুরী। প্রায় সবারই ‘শংকর কাকা।’ বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট বাবা জ্ঞানদা গোবিন্দ চৌধুরী ছিলেন নাটোরের ভবানীর জমিদার। শিক্ষিত পরিবারে শংকর গোবিন্দ চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালের ৪ মার্চ। তিনি নাটোর, বগুড়া এবং কলকাতায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ার সময় তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু। তিনি ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হতে সব ধরনের আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি ছিলেন সক্রিয়। রাজপথ থেকে সংসদ, সবখানে তাঁর উপস্থিতি ছিল সরব। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, আবার নিজে একজন সাধারণ কর্মীর মতো কাজ করেছেন। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার পরবর্তী শাসনামলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কোন প্রলোভন বা হুমকি তাঁকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য তাঁকে এক বছর কারাবরণ করতে হয়। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি একাধিকবার ঐতিহ্যবাহী নাটোর পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন। বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষের একজন ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৭নং সেক্টরের জোনাল কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্যও ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে নাটোরের গবর্নর নিযুক্ত করেন। ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নাটোর সদর আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার সিএমএইচ-এ তিনি পরলোকগমন করেন। আমৃত্যু তিনি নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। মনুষ্যত্ব, নীতি ও আদর্শের পথিক শংকর গোবিন্দ চৌধুরীকে কখনও কোন ধরনের হুমকি বা প্রলোভন ছুঁতে পারেনি। তিনি আমৃত্যু লড়েছেন গণতন্ত্রের অগ্রসৈনিক হিসেবে এবং মানবসেবাকে জীবনের পরম ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি নাটোর রানী ভবানী মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এছাড়া, নাটোর বনলতা হাইস্কুল, বড়গাছা হাইস্কুল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী উচ্চ বিদ্যালয়সহ নাটোরের ডায়াবেটিক সেন্টার ও সুগার মিল তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে। আমরা শুনেছি, ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পোস্টারে ছেঁয়ে গেছে দেয়ালের পর দেয়াল। তারপরও তিনি পোস্টার লাগাবেন না। তাঁর কঠোর হুঁশিয়ারি ‘ছবি দিয়ে চেনাতে হবে শংকর গোবিন্দ চৌধুরী কে?’ ছবি দিয়ে তাঁকে চেনানোর প্রয়োজন হয়নি। সাধারণত তৎকালীন সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের সদস্যরা সাধারণ জনগণের সঙ্গে কোন ধরনের সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব করতেন না। কিন্তু তিনি কখনও জাতি-ধর্ম-বর্ণকে মনুষ্যত্বের উর্ধে স্থান দেননি। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’- তিনি ছিলেন এ নীতিতে বিশ্বাসী। কোন গোঁড়ামি বা সংকীর্ণতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে ছিলেন সমান জনপ্রিয়। আজও তিনি নাটোরবাসীর কাছে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। সমাজে আজও তাঁর মতো মানুষ বড়ই প্রয়োজন।
×