ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

রবিবার এই কলাম লেখা শুরু করতে না করতেই শুনতে পেলাম সেই প্রত্যাশিত আগমনী আওয়াজ। হ্যাঁ, ঝমঝম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঈদের পর ঢাকায় প্রথম ভারি বর্ষণ, হোক স্বল্পস্থায়ী তবু পরিবেশ পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। সারাটা দিনই অবশ্য মেঘলা। গত কয়েকটা দিন ঢাকার তাপমাত্রা ৩৫-এর ওপর-নিচ করছিল। তালপাকা এই গরমে ডাব বিক্রি হুট করেই বেড়ে গিয়েছিল। প্রধান সড়কে নয়, চোখকান খোলা রেখে খুঁজলে আশপাশের রাস্তায় ঠিকই পাওয়া যায় ডাব। রেট যেন বেঁধে দেয়া- ৫০ আর ৬০ টাকা। দেখেশুনে কিনলে ডাব মেলে, না হলে নারকেল। অনেকে আবার পানি আর শাঁস দুটোই চান। আর সত্যিকারের পিপাসার্ত ডাব-খেকোরা ঠিকই চিনে নেন কচি ডাব। স্ট্র লাগিয়ে ডাব খাওয়ার চল শুরু হয়েছিল কবে মনে নেই, প্রথম প্রথম বিসদৃশ লাগতো কেউ স্ট্র দিয়ে ডাব খেতে দেখলে। এখন আমরা সবাই খাই। ডাব কিনে খেতে গেলে এছাড়া উপায়ও নেই। হাঁসফাঁস ভাদ্রের গরমে কথা বলতে গিয়ে ডাবের মতো উপকারী স্বাদু পানীয়ের প্রসঙ্গ এসে পড়ল। রবিবারের বৃষ্টিতে ঢাকাবাসী স্বস্তি-শান্তি পেলোÑ এটা মানতেই হবে। ঢাকাবাসীদের সবাই ঈদ শেষে ঢাকায় ফিরেছে এমনটা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। মানে রবিবার সকাল পর্যন্ত ঢাকা অনেকটাই যানজটহীন নগরী। ঈদের পর সাত দিন না কাটলে ঢাকা ত্যাগকারীদের ঢাকা ফিরতে মন চায় নাÑ এমনটা তো দেখেই আসছি দশকের পর দশক ধরে। নিজস্ব ছন্দে ফেরার আগের কয়েকটা দিন ঢাকার রীতিমতো ঝিমুনি ভাব চলে আসে। গলির এ মাথা ও মাথা তাকিয়ে থেকে অনেক সময় একখানা খালি রিক্সার দেখা মেলে না। বড় রাস্তায় বাস-মিনিবাসের সংখ্যাও কমে আসে। কুড়ি মিনিটের রাস্তা পেরুতে কুড়ি মিনিটই লাগে, দুই ঘণ্টা কুড়ি মিনিট নয়, এটাই পরম স্বস্তি। তবে যানবাহনের জন্য অনেক সময় অপেক্ষাও করতে হয়। ওই যে বললাম, বাস-মিনিবাসের সংখ্যা কমে যায়। উত্তরা-মতিঝিল রুটের এসি বাসের কাউন্টার বন্ধ ছিল সাত-সাতটা দিন। ঢাকার রাস্তায় এই সাতদিন কোন এসি বাস দেখা যায়নি বিআরটিসির। তার মানে কি পরিকল্পনা করেই এই সংস্থার সবাই এক সপ্তাহ ছুটি কাটিয়েছেন! তা কিন্তু নয়। ঈদের মৌসুমে অনেক কোম্পানির বাসই ঢাকার বাইরে দূরপাল্লার সার্ভিস দিয়ে থাকে। ঢাকায় যখন মানুষই নেই বলা যায়, তখন ঢাকার বাইরে যাওয়া মানুষদের ফিরিয়ে আনার কাজটাও তো করতে হবে। তাতে মুনাফাও বেশ। তাই ঢাকায় গণপরিবহনে সংকট বেড়ে যায়। ঢাকার অলিগলি অনেকটাই জনহীন হয়ে পড়ায় চুরি ও ছিনতাইয়ের আশঙ্কাও যে এই সময়টায় বেড়ে যায়, সেকথা বলাই বাহুল্য। সন্ধ্যার পর ফাঁকা গলিতে ঢুকতে গিয়ে অনেকেরই গা ছমছম করে। অভিজাত রেস্টুরেন্ট নয়, সাধারণ মানের হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলো কয়েকটা দিন বন্ধ থাকে। ফলে পুরুষ ব্যাচেলরদের খানিকটে অসুবিধায় পড়তে হয় ঈদের ছুটির কয়টা দিন। কেননা অনেক সময় মেসের বুয়াও কোরবানির মাংস সংগ্রহ এবং তা নিয়ে দেশের বাড়িতে যাওয়ায় মেসবাড়ির চুলো বন্ধ থাকে। গৃহকর্মী বা গৃহপরিচারিকারা, মানে বুয়ারা ঈদের সময় দীর্ঘ ছুটিতে গিয়ে ফিরে এসে আর আগের বাসাবাড়ির কাজে যোগ দেয় না। নতুন কাজ নেয়। অথচ ঈদের আগে ঈদের বোনাস বা নতুন কাপড় পাওয়ার জন্য তারা নানা কথা বলে। তাই ঈদ এলে ঢাকার গৃহিণীদের সাধারণ দুশ্চিন্তা শুরু হয় ঈদশেষে বুয়া ফিরে না এলে নতুন বুয়ার খোঁজ লাগাতে হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য সমবেদনা ঈদের আগে থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নাফ নদী পেরিয়ে আসতে শুরু করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায়। নিজভূমি থেকে তারা অমানবিকভাবে বিতাড়িত হয়েছে, বহুজনের পরিবারের সদস্যরা নির্যাতিত এমনকি নিহত পর্যন্ত হয়েছে। এইসব রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ মুসলমান। এরই মাঝে কোরবানির ঈদ বা বলতে পারি আনন্দ ও ত্যাগের উপলক্ষ গেল। শরণার্থী রোহিঙ্গাদের জন্য ঈদের দিনটি সামান্যতম আনন্দ নিয়ে আসেনি। সরকারী উদ্যোগ ছাড়া বেসরকারীভাবে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক অথবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঈদের সময় রোহিংগাদের একটি ক্ষুদ্র অংশের জন্য হলেও একবেলা খাবার যোগানোর খবরের আশায় ছিলাম। এমন কোন মাননবতার দৃষ্টান্ত জানতে পারিনি। ঢাকার বিভিন্ন সংগঠন অবশ্য ধীরে ধীরে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায় রাজধানীতে প্রতিবাদ-সমাবেশ অব্যাহত আছে। শনিবার দুপুর পর্যন্ত জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অন্তত নয়টি সংগঠন মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ ও অনশন কর্মসূচী পালন করে। এসব কর্মসূচীতে বক্তারা মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের নেতা অং সান সু চির তীব্র সমালোচনা করেন। সমাবেশ থেকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করারও দাবি জানানো হয়। রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদে মিয়ানমার দূতাবাসে বৌদ্ধ সমাজের পক্ষে স্মারকলিপি প্রদান করা হয় রবিবার। এদিন সকালে রাজধানীর গুলশান-২ নম্বর চত্বরে সমাবেশ করে ‘বাংলাদেশের সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজ’। গুলশান-২ নম্বর গোল চত্বরের সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সহসভাপতি পি আর বড়ুয়া বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চলছে। বাংলাদেশ মুসলমানপ্রধান দেশ হয়েও সব সম্প্রদায় কত শান্তিতে বসবাস করছে; সেখানে মিয়ানমার বৌদ্ধপ্রধান দেশ হলেও যেভাবে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, তাতে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষরা মুখ দেখাতে পারছে না। তিনি বলেন, আজ মিয়ানমার দূতাবাসে স্মারকলিপি দেওয়া হলো। এরপর জাতিসংঘের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হবে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের কাছেও স্মারকলিপি পৌঁছানো হবে। সাংবাদিক-শিক্ষার্থীরাও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে মিয়ানমার দূতাবাসে প্রতিবাদলিপি প্রদান করেছেন। এ সময় সাংবাদিক-শিক্ষার্থীদের পাঁচজন প্রতিনিধি দূতাবাসের ফটকে গিয়ে প্রতিবাদলিপি প্রদান করেন। প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে সংগঠিত নৃশংসতা এবং মানবিক বিপর্যয়ের কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এটি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাঁরা মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা নাগরিকদের হত্যা বন্ধ করতে এবং বর্তমান পরিস্থিতির আশু সমাধানের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। সুস্থ হয়ে উঠছেন মেয়র আনিসুল হক ঢাকার অন্যতম মেয়র আনিসুল হক লন্ডনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন দীর্ঘদিন। এদিকে ঢাকায় কেউ কেউ গুজব ছড়াচ্ছেন তার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে। এমন একটি পরিস্থিতিতে মেয়রের পরিবারের ঘনিষ্ঠজন টিভিব্যক্তিত্ব আবদুন নূর তুষার মেয়রের স্ত্রী রুবানা হকের রেফারেন্স দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন। শনিবার এক ঘণ্টার ব্যবধানে তার এই পোস্ট দুটি ছিল গুজবের অবসানে জোরালো পদক্ষেপ। পরদিন এরই ভিত্তিতে পত্রিকায় মেয়রের শারীরিক উন্নতির সংবাদ প্রকাশিত হয়। এখানে পোস্ট দুটি তুলে দেয়া হলো। তুষারের প্রথম পোস্ট : আল্লাহর ওয়াস্তে থামেন! রুবানা হক, আনিস ভাইয়ের ছেলে মেয়েরা সবাই পালাক্রমে তাকে প্রতিদিন হাসপাতালে দেখতে যাই! এক মিনিট আগে আমি রুবানা হক এর সঙ্গে কথা বলেছি! তিনি তাকে হাসপাতালে দেখে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন। আনিসুল হকের অসুস্থতার নাম সেরিব্রাল ভ্যাস্কুলিটিস, তিনি দীর্ঘ সময় আইসিইউতে ঘুমে ছিলেন, এখন ধীরে ধীরে তাকে ওষুধ কমিয়ে এনে ডাক্তাররা পরবর্তী ধাপের চিকিৎসা দিচ্ছেন। আপনারা এত হৃদয়হীন যে প্রতিদিন তার মৃত্যুর গুজব ছড়াচ্ছেন! কেউ অমর নন! কিন্তু কারো চিকিৎসা চলাকালীন তার ব্যাপারে কিছু না জেনে, নিশ্চিত না হয়ে তার নাম দিয়ে গুজব ছড়িয়ে আপনারা তার আত্মীয় পরিজনদের, যেভাবে দুঃখ দিচ্ছেন, সেটা বোঝার ক্ষমতা আপনাদের আল্লাহ দেননি। আপনারা কি আশা করেন যে আমরা এখন তার হাসপাতাল থেকে প্রতিমুহূর্তে লাইভ সম্প্রচার করব ? এতটা বুদ্ধি বিবেচনা হীন হয়েছেন কেউ কেউ, যে এটাও বোঝার ক্ষমতা নাই আপনাদের যে এখানে হাসপাতালগুলো অন্যরকম। এখানে ডাক্তার ও রোগী ছাড়া আত্মীয়দেরও অনুমতি নিয়ে রোগীর কাছে যেতে হয়। ইনফেকশন কন্ট্রোল করার জন্য তাকে চাইলেই দেখা যায় না। আমি নিশ্চিত করছি যে আনিস ভাই এখনও চিকিৎসাধীন আছেন, দোআ করতে পারলে করেন, গুজব ছড়াবেন না। তুষারের দ্বিতীয় পোস্ট : রুবানা হকের লেখা। প্রতিদিন ভোরে গুজব শুনলে তিনি কেবল এটাই ভাবেন যে আনিস ভাই আরেকটু সেরে উঠবেন। তিনি পুরো বিবরণ দিয়েছেন। চিকিৎসক কি বলেছেন, কতটুকু অপেক্ষা, কি প্রত্যাশা। তার কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র খুলে ফেলা হয়েছে। তিনি নিজে শ্বাস নিচ্ছেন। তার রক্তচাপ স্বাভাবিক আছে। তিনি চোখ খুলছেন, পলক ফেলছেন, ডাক্তারের দিকে তাকাচ্ছেন। দীর্ঘ সময় ধরে পাওয়া চেতনানাশক ওষুধের প্রভাব হাল্কা হয়ে আসছে। ডাক্তাররা আশা করছেন তিনি ধীরে ধীরে উন্নতি করবেন। অপরিসীম ধৈর্যরুবানা আপার। তার ছেলে মেয়েদের। আল্লাহ তাদের মঙ্গল করুন। ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ [email protected]
×