ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নওগাঁয় বন্যাদূর্গত মানুষের মাঝে ত্রাণের জন্য হাহাকার ॥ গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে বানভাসিরা

প্রকাশিত: ২৩:৩৬, ২১ আগস্ট ২০১৭

নওগাঁয় বন্যাদূর্গত মানুষের মাঝে ত্রাণের জন্য হাহাকার ॥ গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে বানভাসিরা

বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ ॥ ঘরে প্রায় কোমর সমান পানি। বাইরে আরো বেশী। কেউ কেউ সেখানেই থাকছেন কষ্ট করে পানি কমার আশায়। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধ, রাস্তা কিংবা উঁচু কোনো স্থানে। নৌকা নিয়ে কাছে যেতেই বানভাসি মানুষগুলো ছুটে আসে ত্রাণের আশায়। তারপর যখন শোনেন কেউ তাঁদের জন্য ত্রাণ নিয়ে আসেনি, তা শুনে তখনই মুখ মলিন হয়ে যায় তাঁদের। বানভাসি মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে নারী, শিশু ও পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা। বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব সেখানে প্রকট। প্রশাসন বা বিভিন্ন সংগঠন থেকে এখন পর্যন্ত যে ত্রান দেয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত অপ্রতুল। জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও আশ্রয় নিয়েছে বানভাসি মানুষ। উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে নওগাঁর আত্রাই ও ছোট যমুনা নদীর বাঁধ ভেঙ্গে নওগাঁ সদর, মান্দা, রাণীনগর, আত্রাই, বদলগাছী, পত্মীতলা, মহাদেবপুর, ধামইরহাট ও সাপাহার উপজেলার ৬৫টি ইউনিয়নের প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে দুর্গত এলাকা মান্দায় রয়েছেন, প্রায় ১ লাখ মানুষ। রবিবার নওগাঁর মান্দা উপজেলার নুরুল্যাবাদ ইউনিয়নের পশ্চিম নুরুল্যাবাদ, উত্তর নুরুল্যাবাদ, জোতবাজার, কুশুম্বা ইউনিয়নের বড় বেলালদহ, ছোট বেলালদহ, শামুকখোল, প্রসাদপুর ইউনিয়নের বুড়িদহ, ঋষিপাড়া ও বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের হুলিয়াপাড়া, চকশল্লা, চক কামদেব, দাসপাড়া, পাড়ইটঙ্গি এলাকায় নৌকা নিয়ে ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া যায়। বানভাসীরা জানান, রবিবার দুপুর থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। কিন্তু দুর্ভোগ কমেনি। বিষ্ণুপুর ইউনিয়নে আত্রাই নদীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে গবাদিপশু সঙ্গে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে শতাধিক পরিবার। নৌকা নিয়ে সেখানে যেতেই ১০-১২ মানুষ ছুটে এসে ত্রাণের জন্য নিজেদের নাম লিখতে বলেন। তারপর সাংবাদিক পরিচয় জেনে, সবার মুখ মলিন যায়। তাঁরা জানান, সব কিছু ছেড়ে এক সপ্তাহ্ ধরে তাঁরা সেখানে আশ্রয় নিলেও এখন পর্যন্ত কেউ ত্রাণ নিয়ে আসেননি। ওই বাঁধে আশ্রয় নেয়া দাসপাড়া গ্রামের জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষের খাবার জুটলেও গরু-ছাগল নিয়ে মহা-যন্ত্রনায় পড়ে গেছি। গরু-ছাগলের কষ্টের শ্যাষ নাই। ঘাস নাই। খ্যাড় (খড়) নাই। সব ডুবা গেছে। বেশি দাম দিয়াও কোনোটে (কোথাও) খ্যাড় -ঘাস পাওয়া যাচ্ছে না। খাবার না পেয়ে গরু-ছাগলগুলা দুর্বল হয়ে য্যাচ্ছে।’ দাসপাড়া গ্রামের মজিদা বেগম বলেন, ‘হামরা দিন এ্যানে দিন খাওয়া মানুষ। হামার স্বামী ভ্যান চালায়। বানে পথঘাট ডুবা যাওয়ায় সাত দিন ধরা ভ্যান চালাতে পারেনি। পোলাপান নিয়া চিড়া-মুড়ি খ্যায়া আছি। ইলিপ দিবে বলে নাম লেখ্যা নিয়া গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক ছটাকও ইলিপ পাইনি। যে কয়টা টাকা আছিল তাও শ্যাষ। ইলিপ না প্যালে মরা ছাড়া গতি নাই।’ বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম জানান, তাঁর ইউনিয়নের ৩০ হাজারের বেশি মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ত্রাণ বরাদ্দ এসেছে মাত্র ২ মেট্রিক টন। প্রশাসনের তরফ থেকে যেটুকু ত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে, এখানকার লোকজন সেটুকুই পাচ্ছে। সড়কপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায়, বেসরকারিভাবে এখানে কেউ ত্রাণ দিতে আসছে না। ফলে অন্য এলাকার চেয়ে এখানকার লোকজন বেশি কষ্টে আছে। ওই ইউনিয়নের প্রসাদপুর-জোতবাজার রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন পাঁচ শতাধিক পরিবার। সেখানে আশ্রয় নেয়া কিছু মানুষ ত্রাণ পেলেও অধিকাংশই ত্রাণ পাননি বলে জানায়। পশ্চিম নুরুল্যাবাদ গ্রামের জায়েদা বানু বলেন, ‘হামার মতো কষ্টে কেউ নাই। ম্যানষের কাছ থ্যাকা চিড়া-মুড়ি চ্যায়া-ম্যাঙ্গা খ্যাচ্ছি। এখনও কেউ এ্যানা ইলিপ দিল না। স্বামী নাই। জোয়ান বেটাও নাই। হামি বেটি ছোল মানুষ ইলিপ চাতে কার কাছে যামু।’ নুরুল্যাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ ম-ল বলেন, ‘যেটুকু ত্রাণ পাওয়া গেছে তা খুবই সামান্য। আমার এলাকায় দেড় হাজার পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত বরাদ্দ এসেছে ২ মেট্রিক টন। তিন ভাগের এক ভাগ পরিবারকেও ত্রাণ দিতে পারিনি।’ বড় বেলালদহ মাদ্রাসা আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, মাদ্রাসা মাঠে প্রায় দুই-তিনশ গরু বাঁধা। শামুকখোল গ্রামের হাসেম আলী নামে এক কৃষক বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রতি পরিবারে ১০ কেজি করে চাল দিয়ে গেছে। নিজেদের পেটে তাও একটু খাবার যাচ্ছে। কিন্তু গরু-বাছুর নিয়ে খুব কষ্টে আছি। তিনটা গরু ও একটা বাছুর নিয়ে এখানে রয়েছি। টাকা দিয়েও খড় পাওয়া যাচ্ছে না।’ মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘দুর্গত মানুষদের মাঝে এখন পর্যন্ত ৪৭ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। যাঁরা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদেরকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। তবে অনেকে যাঁরা বিভিন্ন রাস্তার ওপর কিংবা পানির মধ্যে কষ্ট করে বাসা-বাড়িতে রয়ে গেছে। তাঁরা হয়তো কেউ কেউ তালিকা থেকে বাদ পড়ার কারণে ত্রাণ পাচ্ছেন না।’ জেলা ত্রাণ ও পুনবার্সন কর্মকর্তার আব্দুল মান্নান জানান, গত শুক্রবার পর্যন্ত বন্যাদুর্গত মানুষের মধ্যে ২৪৭ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৭ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
×