ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘জজ মিয়া নাটকে’র তিন কুশীলব জামিনে

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২১ আগস্ট ২০১৭

‘জজ মিয়া নাটকে’র তিন কুশীলব জামিনে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ইতিহাসের জঘন্যতম একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে জজ মিয়া নাটকের কুশীলব তিন সিআইডি কর্মকর্তা জামিনে রয়েছেন। তাদের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। তাদের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল মামলায় আসামি করা হয়েছে। এ জন্য তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জজ মিয়া নাটক সাজানোর অভিযোগে দায়ের মামলার তদন্ত হিমাগারে চলে গেছে। মামলাটির আলোর মুখ দেখার আর কোন সম্ভাবনা নেই। যতদূর তদন্ত হয়েছে, অতটুকুই শেষ। নতুন করে মামলাটির আর তদন্ত হচ্ছে না। তবে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নানা ঝামেলা হতে পারে বলে সিআইডি কর্মকর্তাদের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জজ মিয়া তার মা ও পরিবারের সদস্যরা। সরকারের তরফ থেকে জজ মিয়া ও তার পরিবারকে সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরদিন রাজধানীর মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। প্রথম দফায় মতিঝিল থানার এসআই আমীর হোসেন মামলা দুটির তদন্ত করেন। এরপর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক শামসুল ইসলাম তদন্ত করেন। তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর তড়িঘড়ি করে মামলা দুটি সিআইডি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। বাবরের নির্দেশে শুরু হয় তদন্তের নামে প্রহসন। প্রথম দফায় মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় বিএনপি-জামায়াতের আশীর্বাদপুষ্ট সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সী আতিকুর রহমানকে। তদন্তের দায়িত্ব পেয়েই তিনি ঢাকার ৫৪নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার মোখলেছুর রহমান, শৈবাল সাহা পার্থ, আব্বাসসহ ২০ জনকে পরিকল্পিতভাবে গ্রেফতার করেন। পরবর্তীতে ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে দরিদ্র পরিবারের সন্তান জজ মিয়াকে গ্রেফতার করে। তাকে সোজা মালিবাগ সিআইডি অফিসে নেয়া হয়। দরিদ্র পরিবারের সন্তান জজ মিয়া। সামান্য দিনমজুর। জজ মিয়ার পুরো পরিবারকে আজীবন ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়ার লোভ দেখায় সিআইডি। প্রথম দিকে সিআইডির প্রস্তাবে রাজি হয়নি জজ মিয়া। এরপর জজ মিয়ার ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। সিআইডির কথামতো না চললে জজ মিয়াকে কমপক্ষে খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হবে। ফলে সারাজীবন জেলের অন্ধকারে থাকতে হবে। এ জীবনে আলোর মুখ দেখা হবে না। এমন ভয় দেখানো হয় জজ মিয়াকে। সর্বশেষ এতেও রাজি না হলে জজ মিয়াকে চোখ বেঁধে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে নিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যার প্রস্তুতি নেয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে যায় জজ মিয়া। শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে জজ মিয়া সিআইডির কথামতো রাজি হয়। রাজি হওয়ার পর জজ মিয়ার পরিবারকে আজীবন ভরণপোষণ দেয়া হবে বলে সিআইডির তিন কর্মকর্তা জজ মিয়াকে প্রতিশ্রুতি দেন। এমন প্রতিশ্রুতি জজ মিয়ার পাশাপাশি তার পরিবারকেও দেন সিআইডি কর্মকর্তারা। চাপের মুখে জজ মিয়াকে দিয়ে আদালতে গ্রেনেড হামলার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে বাধ্য করেন আলোচিত এই তিন সিআইডি কর্মকর্তা। জজ মিয়াকে গ্রেফতারের পরদিন ২০০৫ সালের ১০ জুন গুলশান থানায় তদন্তাধীন থাকা এক ব্যবসায়ী হত্যার পুরনো মামলায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে গ্রেফতার হয় দুই ভায়রা আবুল হাশেম রানা ও শফিকুল ইসলাম। তাদেরও গ্রেনেড হামলা-মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এ দু’জনকে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে বাধ্য করেন সিআইডির আলোচিত এই তিন কর্মকর্তা। এমন জবানবন্দীকে পুঁজি করেই ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর ১৫ জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে ১১ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট দাখিলের অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চার্জশীটের অনুলিপি দেয় সিআইডির এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান। মুন্সী আতিকের তদন্ত নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রশ্ন তুললে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশীদকে দায়িত্ব দেয়া হয়। আবদুর রশিদ ও ঢাকা মেট্রোর ওই সময়ে দায়িত্বে থাকা স্পেশাল সুপারভাইজার (এসএস) এসপি রুহুল আমিন মামলা তদন্তের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। মামলার তদন্ত নিয়ে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বরাবরই অভিযোগ করা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলাটির পূর্ণ তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবীরকে। তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে জজ মিয়া নাটকসহ গ্রেনেড হামলা হামলার সব চাঞ্চল্যকর কাহিনী। সিআইডি সূত্র বলছে, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় সমাবেশে বোমা পুঁতে রেখে শেখ হাসিনাকে হত্যার মিশন ব্যর্থ হয়। এরপর শেখ হাসিনাকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করতেই পাকিস্তান থেকে আর্জেস গ্রেনেড আনা হয়েছিল। ২১ আগস্টের পর সারাদেশ থেকে ৭৫ ৮৪ মডেলের আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার হয়েছে, যা পাকিস্তানের তৈরি অধিক উচ্চমাত্রা বিস্ফোরক বলে পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি গ্রেনেড ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর এক খুনীর সেলের সামনে থেকে কারা কর্তৃপক্ষ ও লালবাগ থানা পুলিশ উদ্ধার করে। শেখ হাসিনা গ্রেনেড হামলায় মারা গেলে গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কারাগারের মূল ফটক উড়িয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। গ্রেনেড হামলা-মামলার তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন ২২ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট দাখিল করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মুফতি হান্নান ও আবু জান্দালসহ ১৪ জন বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। বাকি আসামিদের মধ্যে উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজ উদ্দিন পাকিস্তানে পলাতক রয়েছে বলে পুলিশের ইন্টারপোল সূত্রে জানা গেছে। এদিকে জজ মিয়া নাটক সাজানোসহ মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহ এবং মামলার আলামত নষ্টের অভিযোগে ২০০৯ সালের ৩০ মার্চ পল্টন মডেল থানায় আলোচিত তিন সিআইডি কর্মকর্তাকে আসামি করে মামলা দায়ের হয়। গ্রেনেড হামলা মামলার চার্জশীট দাখিলকারী কর্মকর্তা সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবীর বাদী ওই মামলাটি দায়ের করেন। দায়েরকৃত ওই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহ, জোরপূর্বক জজ মিয়া, আবুল হাশেম রানা ও শফিকুল ইসলামকে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে বাধ্য করাসহ মামলার আলামত নষ্টের অভিযোগ আনা হয়। সিআইডির অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, সিআইডির তিন কর্মকর্তাকে মূল মামলার আসামি করা হয়েছে। এ জন্য স্বাভাবিক নিয়মেই তাদের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় দায়েরকৃত মামলাটির আর কার্যকারিতা নেই। মামলাটির তদন্ত যতদূর হয়েছে, অতটুকুই শেষ। নতুন করে মামলাটির আর তদন্ত হচ্ছে না। বলা চলে, মামলাটি হিমাগারে চলে গেছে। তবে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা-মামলায় আলোচিত তিন সিআইডি কর্মকর্তা ছাড়াও পুলিশের সাবেক তিন আইজিপিও জামিনে রয়েছেন। তাদের দেশত্যাগের ওপর স্বাভাবিক কারণেই নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগে তিন সিআইডি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পল্টন থানায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্ত করেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রওনকুল হক চৌধুরী। তদন্তের ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের ৭ এপ্রিল গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়া জজ মিয়া, আবুল হাশেম রানা ও শফিকুল ইসলামের জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। এছাড়া জজ মিয়ার মা জোবেদা বেগম, বোন খুরশীদা বেগম, ভাই আবুল হোসেন, রাজধানীর ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার মোখলেছুর রহমান, শৈবাল সাহা পার্থ, আরিফ, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী গ্রহণকারী দুই বিচারক শফিক আনোয়ার ও জাহাঙ্গীর আলম এবং সিআইডির তিন কর্মকর্তার জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়। সিআইডিকে দেয়া জবানবন্দীতে জজ মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যরা জজ মিয়াকে নিয়ে নাটক সাজানোর কাহিনীর বর্ণনা দেন। তারা বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় গেলে ঝামেলায় পড়বেন বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এছাড়াও নোয়াখালীর সেনবাগ এলাকার বহুল আলোচিত জজ মিয়ার ৬ প্রতিবেশীও সিআইডি পুলিশের কাছে জবানবন্দী দেন। তারা জানান, ২১ আগস্ট জজ মিয়া বাড়িতেই ছিল। প্রতিদিনের মতো জজ মিয়া বাড়ির কাজ সেরে বিকেলে বাড়ির কাছের বাজারে যায়। বিকেলে তাদের সঙ্গে বসে জজ মিয়া বাজারের একটি দোকানে টেলিভিশন দেখছিল। সেখান থেকেই জজ মিয়াকে সিআইডি পুলিশ ঢাকায় নিয়ে যায়। পরে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেশীরা জানতে পারেন, জজ মিয়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা-মামলার আসামি। ঢাকার সিআইডি পুলিশ জজ মিয়াকে গ্রেফতার করেছে।
×