ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষ সাক্ষাতকারে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক

বিচার বিভাগ ভুল করলে জনগণ তা শুধরে দিতে পারবে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৮ আগস্ট ২০১৭

বিচার বিভাগ ভুল করলে জনগণ তা শুধরে দিতে পারবে

আরাফাত মুন্না ॥ আইন কমিশন চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেছেন, নির্বাহী বিভাগ বা সংসদ কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিলে যেমন বিচার বিভাগ সে ভুল ঠিক করে দিতে পারে তেমনি বিচার বিভাগ ভুল করলে জনগণ তা শুধরে দিতে পারবে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রীমকোর্টে বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতির বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে বৃহস্পতিবার দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকারে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, সংবিধানে জনগণকে সকল ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তারাই দেশের মালিক। জনগণের টাকায়ই বিচারকরা বেতন পান। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে তিনি বলেন, এই অনুচ্ছেদের অজুহাত আপীল বিভাগের ৭ বিচারপতিই দিয়েছেন। সম্পূর্ণ ভুলভাবে দিয়েছেন। আমি তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি। ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেয়া যাবে না। আমরা কিন্তু দলের বিরুদ্ধে ভোটাভুটি একবারের জন্যও দেখি নাই। যা ভোটাভুটি হয় সেটা বিলের পক্ষে বা বিপক্ষে। অনাস্থা প্রস্তাব এলে তখন দলের পক্ষে বা বিপক্ষের প্রশ্ন আসবে। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ‘তির্যক’ মন্তব্য ভবিষ্যতে জাতির কাছে ভুল বার্তা দেবে বলেও মনে করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি। প্রশ্ন : রায়ের বিষয়ে খুব তড়িঘড়ি করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন? খায়রুল হক : তড়িঘড়ি করেই করেছি। কারণ আমরা যখন শুনলাম, আইনমন্ত্রী বৃহস্পতিবার কথা বলছেন। তখনই আমরা মনে করলাম, আইনমন্ত্রী সরকারের পক্ষ থেকে বলবেন এবং সরকার একটা পক্ষ। সে কারণে আমাদের কিছু বলার থাকলে সরকারের পূর্বেই বলা উচিত। আমি সব সময়ই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে থাকি। তবে ওই ব্রিফিংটা ছিল আইন কমিশনের পক্ষ থেকে। তার কারণ হচ্ছে, আমরা আইন নিয়ে কাজ করি। আইনের অন্যতম উৎস হচ্ছে রায়। জাজমেন্ট আইন। এটা সংবিধিবদ্ধ আইন না হলেও জাজমেন্ট আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যেহেতু এটা আইন। তাই এ বিষয়ে কথা বলার অধিকার, দায়-দায়িত্ব রয়েছে বলেই আমরা বলেছি। কারণ আমাদের প্রচুর মানুষ ফোন করেছে। এটা আইন সঙ্গতভাবেই আমরা করেছি। প্রশ্ন : আপনার আপত্তির বিষয় কি রায়ের কোন নির্দিষ্ট অংশ নিয়ে? খায়রুল হক : এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, রায়ের সঙ্গে আমরা একমত পোষণ করি বা না করি, যতক্ষণ রায় থাকবে ততক্ষণ ‘উই অল আর বাউন্ড বাই ইট।’ কিন্তু আমরা রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করতেও পারি, নাও করতে পারি। এটা আমারও অধিকার, আইন কমিশনের অধিকার। এই ক্ষেত্রে আমরা বিশেষ বিশেষ যে সব তত্ত্বের ভিত্তিতে রায় দিয়েছেন, সেটাকেও আমরা সঠিক বলে মনে করিনি এবং এখনো করি না। মূল রায়ও আমাদের কাছে মনে হয়েছে ভ্রমাত্মক। পর্যবেক্ষণগুলোও মনে হয়েছে আরও বেশি ভ্রমাত্মক। প্রশ্ন : সাত বিচারপতির রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন? খায়রুল হক : হ্যাঁ, প্রশ্ন তুলছি। সেই অধিকার আমার আছে। প্রথমেই বলেছি, আই এ্যাম বাউন্ড বাই দ্য জাজমেন্ট। কিন্তু সেই রায়ে সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার অধিকার বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের আছে। তারা বলতেই পারেন যে, এই রায় আমরা একমত পোষণ করি না। প্রশ্ন : আপনার দেয়া কিছু রায় নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে, এ বিষয়ে কি বলবেন? খায়রুল হক : আমি টেলিভিশন খুললেই দেখি, টকশোগুলোতে হরদম এগুলো বলতেই থাকে যে, পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় উনি কিভাবে দিলেন, যেখানে এটা মুন সিনেমা হল সংক্রান্ত বিষয়ে ছিল। আমার মনে হয়, উনারা কেউই পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় পড়েননি। পড়লেই দেখতেন, ওখানে কী প্রেক্ষাপটে রুল ইস্যু করা হয়েছে, সেখানে পঞ্চম সংশোধনীকেই চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এবং মুন সিনেমা হল তো বটেই। রুলটাও সেভাবেই ইস্যু হয়েছে। প্রথম রুল দেয়া হয়েছিল ৭৫ সালে সম্ভবত। তখন পঞ্চম সংশোধনী ছিলও না। তখন ছিল মুন সিনেমা হলের মালিকানা সংক্রান্ত। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন এবং অন্য এক বিচারপতি তারা এই রুলকে এবসোলিউট করলেন এবং মুন সিনেমাকে মালিকের কাছে ফেরত দেয়ার আদেশ দিলেন। কয়েকদিন পরই এমএলআর-৭ এল। এর ফলে ওই রায় বাতিল হয়ে গেল। পরে আবার ওনারা চ্যালেঞ্জ করেন, তখন হাইকোর্ট বাতিল করে দেয়। আপীল বিভাগ বাতিল করলেন, কিন্তু শেষে গিয়ে বললেন, যেহেতু পঞ্চম সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ হয়নি। কাজেই এই রিট চলতে পারে না। এরপরই ১৯৯৯ সালে বা ২০০০ সালে এই পঞ্চম সংশোধনী মামলাটা নতুন করে দায়ের হয়। সেখানে পঞ্চম সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। প্রশ্ন : ত্রয়োদশ সংশোধনী রায় নিয়েও বিতর্ক আছে? খায়রুল হক : এ জিনিস প্রায়ই শুনি, আমাদের সংক্ষিপ্ত আদেশে যেটা দেয়া হয়েছিল, আমাদের অর্ডার অব দ্য কোর্টে সেটা নাই কেন? অনেক বোদ্ধা ব্যক্তিগণ এটা বলেন। কিন্তু ওনারা মনে হয়, আমাদের রায়টা মনোযোগ দিয়ে পড়েননি। কারণ রায় পড়লেই প্রথমেই দেখতেন, ‘আমাদের এই আপীলের বিচার্যর বিষয় হচ্ছে, ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা’। সেটাই আমাদের একমাত্র ইস্যু। আমরা আমাদের অর্ডার অব দ্য কোর্টে সেটা দিয়েছি। তারপরও আমাদের কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। পর্যবেক্ষণ সব সময়ই পর্যবেক্ষণ। এটা কখনও ‘অর্ডার অব দ্য কোর্টে’ যায় না। যেতে পারে না। সে কারণে অর্ডার অব দ্য কোর্টে আমাদের মূল ইস্যুর বাইরে কিছু যায়নি। যাওয়ার কোন কারণও ছিল না। দেয়া সম্ভবও ছিল না। সেখানে আমার সঙ্গে যারা ছিলেন, তারা পড়েছেন, সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং সই করেছেন। অর্ডার অব দ্য কোর্ট ড্রাফট করা হয়েছে। সবাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। সন্তুষ্ট হয়ে লিগ্যাল গ্রামার অনুসারেই অর্ডার অব দ্য কোর্ট দেয়া হয়েছে। ইস্যুর বাইরে অর্ডার দ্য কোর্ট যেতে পারে না, যায় নাই, যাবেও না। প্রশ্ন : ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে কি বলবেন? খায়রুল হক : ২০০৬ সালে সম্ভবত আমি ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে রায় দিয়েছি। সেই ৭০ অনুচ্ছেদ কিন্তু এখন আর নেই। মূল ৭০ অনুচ্ছেদের খুবই সামান্য চতুর্থ সংশোধনীতে পরিবর্তন হয়। বড় পরিবর্তন হয় ১৯৯২ সালের ১২তম সংশোধনীতে। সত্যিকথা বলতে কী, সেই পরিবর্তনে প্রতিটি সাংসদকে অনুগত হতে বাধ্য করা হয়েছে। যখন আমি ২০০৬ সালে রায় লিখি, তখন ১২তম সংশোধনীতে যে ৭০ অনুচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে, সেটার কথাই বলা হয়েছে। মূল রায়ে আমি বলেছি, এটা উপায় ছিল না। উপায় ছিল না এই কারণে যে, মধ্য পঞ্চাশের দশকে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশিক সরকারে একদিন পরপরও সরকার বদলাতো। এই খয়রাত হোসেনের মিনিস্ট্রি, আগামীকাল বা পরশু আবুল হোসেনের মিনিস্ট্রি। পরেরদিন আরেকজনের। যার ফলে একটা লেজে গোবরে অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। এতে গবর্নরের শাসন চলে আসে। অনাস্থা প্রস্তাবের কারণে এটা হতো। কেন্দ্রীয় সরকারেও তাই। এই খান সাহেবের, এই চৌধুরী মাহমুদ আলী, এই খালিকুজ্জামান-এটা হতে থাকে। এই জিনিসগুলো আর যাতে কখনও না হয়, সে কারণে ৭২ সালে যারা সংবিধান প্রণয়ন করেন, তারা যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করে করেছিলেন। এটা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে দেশ অর্জিত হয়েছে। সেই দেশের সংবিধানে তারা যথেষ্ঠ যতœবান ছিলেন। প্রতিটি জিনিসের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তারা ৭০ অনুচ্ছেদটা দিয়েছিলেন। যাতে অনাস্থা প্রস্তাবে ‘হর্স ট্রেডিং’ হওয়ার সুযোগ না থাকে। প্রশ্ন : ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে বিচারক অপসারণ এমপিদের থাকা ঠিক হবে না, রায়ের এ বিষয়ে কি বলবেন? খায়রুল হক : বর্তমানে ৭০ অনুচ্ছেদ কোন অবস্থায় প্রয়োগযোগ্য। যারা বলে এটা সব সময় প্রয়োগযোগ্য। না, এটা সব সময় প্রয়োগযোগ্য না। ওখানে বলা হচ্ছে, দলের বিরুদ্ধে ভোট দেয়া যাবে না। আমরা কিন্তু দলের বিরুদ্ধে ভোটাভুটি একবারের জন্যও দেখি নাই। বাংলাদেশের পক্ষে-বিপক্ষে একবারের জন্যও ভোটাভুটি হয় নাই। যা ভোটাভুটি হয় সেটা বিলের পক্ষে বা বিপক্ষে। অনাস্থা প্রস্তাব আসলেই তখন দলের পক্ষে বা বিপক্ষের প্রশ্ন আসবে। হুইপের বিষয়ে ইংল্যান্ডেও আছে। সেখানে প্রথম সারিতে বললে হুইপের নির্দেশ মানতে বাধ্য। সম্ভবত এটা ভারতেও আছে। আমাদের বাঙালী একজন সাংসদ ছিলেন, সম্ভবত টিউলিপ, তিনি যে সংসদীয় এলাকা থেকে এসেছিলেন, সেখানকার মানুষ ব্রেক্সিটের বিপক্ষের। অন্যদিকে ওনার দল লেবার পার্টির পক্ষে ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তখন তিনি প্রথম সারি থেকে পদত্যাগ করে শেষ বেঞ্চে চলে গেলেন। যাতে তিনি তার সংসদীয় এলাকার মানুষের ইচ্ছা অনুসারে বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন। আমাদের দেশের হুইপরাও সাংসদদের ডাকেন, সভা করেন। কিন্তু অনাস্থা প্রস্তাব ছাড়া ৭০ অনুচ্ছেদ কোথাও প্রয়োগ হবে না। এই অনুচ্ছেদের অজুহাত আপীল বিভাগের ৭ বিচারকই দিয়েছেন। সম্পূর্ণ ভুলভাবে দিয়েছেন। আমি তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি। কেবল তাই না, বাইরে যে সব বোদ্ধা রয়েছেন, তারা ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে এই কথাগুলো বলেন। কিন্তু কথাগুলো সঠিক নয়। প্রশ্ন: বিচারপতিরা কি ইচ্ছাকৃতভাবে এমন রায় দিয়েছেন? খায়রুল হক: আমি কখনই বলব না, এটা ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমি বলব, তারা যথাযথভাবে এটাকে ইন্টারপ্রিট করতে পারেননি। প্রশ্ন: রায়ে সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য সম্পর্কে কি বলবেন? খায়রুল হক: নির্বাহী বিভাগ কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিলে সুপ্রীমকোর্ট সেটা ঠিক করে দিতে পারে। সংসদ যদি সংবিধান বহির্ভূতভাবে কোন আইন পাস করে, সেটাও কোর্ট ঠিক করে দিতে পারে। কিন্তু সুপ্রীমকোর্ট যদি কোন ভুল করে তাহলে আমরা কোথায় যাব? অর্থাৎ রিভিউতেও যদি সুপ্রীমকোর্ট এটা বহাল রাখে, তাহলে আমরা কোথায় যাব? মূল রায়ে কেউ যদি বলেন, সংসদ ইমম্যাচিউরড। তাদের হাতে বিচারকদের ভবিষ্যত দেয়া যাবে না। যদি তিনি বলেন, গণতন্ত্রও ইমম্যাচিউরড। কারণ অনির্বাচিত নারীরা সেখানে বসতে পারছে। তিনি যদি বলেন, সংসদ আমাদের এই নির্দেশনা মানেনি। কিন্তু সংসদকে নির্দেশনা দেয়ার ক্ষমতা তো সুপ্রীমকোর্টের নেই। এ রকম কথা বললে তখনই প্রশ্ন ওঠে। তারপর যদি বলেন সুডো ডেমোক্র্যাসি। আমরা কোথায় বাস করি। এটা কি ঠিক? আমার কাছে মনে হয়, কথাগুলো একেবারে অপ্রয়োজনীয় ছিল। রাজনীতি এবং সংসদ সম্পর্কে অত্যন্ত অবমাননাকর বক্তব্য দিয়েছেন। অথচ আমাদের বেতন সংসদ দেয়। তারা পাস না করলে আপনি কোন বেতন পাবে না। সেক্ষেত্রে সংসদ ঠিক আছে। এখানে সুডো ডেমোক্র্যাসি বলেছেন। তিনি সংসদকে ‘ডিজফাংশনাল’ বলেছেন। তাহলে তো সরকারও ‘ডিজফাংশনাল’ হয়ে যায়। আর সরকার যদি ‘ডিজফাংশনাল’ হয়ে যায়, তাহলে তো প্রজাতন্ত্রও থাকে না। এটা কোন সভায় বলছেন না। এটা রায়ে বলছেন। এটা তো আইন। মূল সংবিধান কি উনারা বাদ দিতে পারেন? অষ্টম সংশোধনী মামলা, পঞ্চম সংশোধনী মামলা, ১৩তম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী; সব মামলায় মূল সংবিধানকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। এবারই প্রথম মূল সংবিধান বাদ দিয়ে মার্শাল ল’র বিধান গ্রহণ করেছিলেন। বিচারপতি ইমান আলী আরেকটা বিষয়ে কিছু কথা বলেছেন যে, মাদার কনস্টিটিউশনের সঙ্গে এটা সাংঘর্ষিক কি-না। তাহলে কিন্তু এটা সংবিধানবহির্ভূত হবে। কিন্তু শেষেরদিকে উনি খেই হারিয়ে ফেলেছেন। যে দুটি অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, ১৬তম সংশোধনী কি সেটাকে লঙ্ঘন করেছে? উনারা কিছুই বলেননি। বলেননি, কারণ ভায়োলেট করেনি। করলে তো বলতেন। ডিজফাংশনাল গণতন্ত্রই তাদের ভাতাদি বাড়িয়েছে। পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে এটাকে প্রভিশনাললি কনডোন্ড করা হয়। ৯৬ সম্পর্কে ফুললি কনডোন্ড বলেনি। প্রভিশনাললি কনডোন্ড করেছে ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। যদি সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ হতো, তাহলে পুরোপুরি কনডোন্ড করতে হতো। তারা এটা ছেড়ে দিয়েছেন সংসদের হাতে। যদি মূল কাঠামো হয়ে থাকে, তাহলে সংসদও এটাকে বদলাতে পারবে না। সংসদ তখনই বাদ দিতে পারত। তার মানে এটা কখনও মূল কাঠামো নয়, ছিল না। আপনারা এটা সংসদের কাছে পাঠালেন, পরে সংসদ করার পর বাতিল করে দিলেন। উনারা ধরতে পারেননি বা বলতে চাননি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আর দায়বদ্ধতা এক জিনিস নয়। এই বাংলাদেশের সব লোকের দায়বদ্ধতা রয়েছে। দেশের এক নম্বর সিটিজেন রাষ্ট্রপতিও দায়বদ্ধ। প্রধানমন্ত্রীও দায়বদ্ধ। এই রায় অনুসারে বিচারকরা প্রধান বিচারপতির কাছে দায়বদ্ধ। কারণ প্রধান বিচারপতি নিজের রায়ে সেটা লিখেছেন। বিচারকরা কেবল জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। যেহেতু কেবল জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। তাই জনগণের প্রতিনিধিদের কাছেই তারা দায়বদ্ধ। আর কারো কাছে থাকতে পারে না। প্রশ্ন: ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় কি আপনার প্রতি কোন চাপ ছিল? খায়রুল হক: প্রশ্নই ওঠে না। আমাকে কোন রকম চাপ দিতে কোনদিন সাহসই করেনি। চাপ তো দূরের কথা। আর চাপের কথা বলছেন, এ্যাটর্নি জেনারেল আড়াইদিন ত্রয়োদশ সংশোধনীর পক্ষে শুনানি করেছেন। সরকার চাচ্ছিল, ত্রয়োদশ সংশোধনী থাকুক। আমি, আমি চেয়েছিলাম, দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসুক। সে কারণে আমার একটা পর্যবেক্ষণও ছিল। যদি সংসদ ইচ্ছা করে, তাহলে দুই মেয়াদ রাখতে পারত। তারা রাখেনি। পর্যবেক্ষণে সেটা ছিল। তারা যদি রাখেন, তাহলে যেন কোন বিচারপতিকে এর সঙ্গে যুক্ত না করেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলা যদি আমি রায় না দিতাম, যদি আমরা শুনানি না করতাম। তাহলে আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতাম। কিন্তু এটা আমি হতে চাইনি। শুনানিতে না করলেই আমি হতাম। কারণ আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। প্রশ্ন: রায়ে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, সেটা কি সঠিক মনে করেন? খায়রুল হক: রায়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তির্যক মন্তব্য করা হয়েছে। যেটা কোনভাবেই ঠিক হয়নি। রায়ে বলা হয়েছে, কোন একজনের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়নি। এটা ঠিক নয়। কারণ, নেতৃত্ব কিন্তু একজনই দেন। তাকে অনেকে সহযোগিতা করে থাকেন। ধরুন ষোড়শ সংশোধনী মামলা। এই মামলায় তো সাত বিচারপতিই মামলা শুনেছেন। তবে নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। তাই রায়ের ভালমন্দ এসব ক্রেডিট কিন্তু প্রধান বিচারপতিরই থাকে। অন্য বিচারপতিদেরও ক্রেডিট থাকে তবে অথর জাজ নেতৃত্বদানকারী বিচারপতিরই বেশি থাকে। মহান আলেকজান্ডার কি একা একাই যুদ্ধ করেছিলেন? না করেননি। তার সঙ্গে অনেকেই অংশগ্রহণ করেছিল। তবে তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাই তিনি বিখ্যাত। ষোড়শ সংশোধনী রায়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে তা মোটেও ঠিক হয়নি। এই রায় তো ডকুমেন্ট। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে যদি বিদেশ থেকে কেউ এসে এ রায় পড়ে তাহলে ভুল বার্তা পাবে। আগামী প্রজন্মও এই রায়ের মাধ্যমে ভুল বার্তা পাবে। তারা বলবে এই যে রায়ে বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর একা নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়নি। প্রশ্ন: আইনমন্ত্রী রায়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উল্লেখিত বিষয়কে ইতিহাস বিকৃতি বলেছেন, আপনি কি মনে করেন? খায়রুল হক: আইনমন্ত্রী কি বলেছেন সেটা আমার বিষয় নয়। আমি মনে করি এখানে বঙ্গবন্ধুকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেটা মোটেও ঠিক হয়নি। প্রশ্ন: সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কি এখন থেকেই কার্যকর? খায়রুল হক: ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সংবিধানের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনতে হলে আবারও সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধানে যেহেতু সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ছিল না, সেহেতু এটা রাখা সংবিধান পরিপন্থী। সংসদ আইন পাস করেনি। কিন্তু সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তো তাদের কার্যক্রম শুরুও করে দিয়েছেন। এখন কি করার, এটা আমার জানা নেই। প্রশ্ন: রায়ে বিচারপতিদের জন্য আচরণবিধি দিয়ে দেয়া হয়েছে, এ বিষয়ে কি বলবেন? খায়রুল হক: এটা দেখে আমিও অবাক হয়েছি। এই রায়টা তো সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের রায় নয়। এই রায়টা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়। এই রায়ে আচরণবিধি কিভাবে দেয়া যায়। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি ৯৬ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে এই আচরণবিধি দিয়েছেন। তাহলে কি রায়ে স্বাক্ষরের আগেই কি ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হয়ে গেছে। সংসদ সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নতুন করে পাস না করলেও যদি তারা সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে। তবে ওই কমিটি মিটিং ডেকে এজেন্ডা রেখে তার পরে আচরণবিধি পাস করবে। রায়ে আচরণবিধি দেখে অবাকই হয়েছিলাম। প্রশ্ন: এখন সুয়োমোটাভাবে কোন কিছু বাদ দেয়ার সুযোগ আছে কিনা? খায়রুল হক: সুপ্রীমকোর্টের রায়ে যদি ভুল করে কোন বিষয় চলে আসে তবে সেটা সুয়োমোটাভাবেই বাদ দেয়ার সুযোগ আছে। একবার আমাদের একটা রায় আমরা ভুল দিয়েছিলাম। ওই রায়টি লিখতে গিয়ে দেখা গেল ভুল রায় দেয়া হয়েছে। পরে বিচারকরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হলো, সুয়োমোটোভাবে মামলাটি তালিকায় এনে আবার আর্গুমেন্ট করে নতুন করে রায় দেয়া হলো। তাই আদালত চাইলে সুয়োমোটোভাবেই ভুল সংশোধন করতে পারে, রিভিউ করার প্রয়োজন পড়ে না।
×