ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মৃতের সংখ্যা ১০৭;###;গর্জন শোনা যাচ্ছে মানিকগঞ্জ ফরিদপুর মুন্সীগঞ্জেও

এবার মধ্যাঞ্চলে বন্যার ধাক্কা ॥ ফুঁসে উঠছে পদ্মা

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৭ আগস্ট ২০১৭

এবার মধ্যাঞ্চলে বন্যার ধাক্কা ॥ ফুঁসে উঠছে পদ্মা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। উত্তরের পাশাপাশি দেখা দিয়েছে মধ্যাঞ্চলের জেলা মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর এবং মুন্সীগঞ্জেও বন্যা। বাড়ছে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ২ হাজারের ওপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। কয়েক হাজার একর জমির আমন ধান তলিয়ে গেছে। বন্যাদুর্গতদের বিশুদ্ধ পানি এবং খাদ্য সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশু নিয়েও চরম বিপদে পড়েছে তারা। বন্যায় এখন পর্যন্ত ১০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। জনকণ্ঠের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বুধবার নতুন করে আরও ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই জানানো হয়েছে ২১ জেলায় বন্যায় ৩২ লাখ ৮৭ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১ লাখ ৭২ হাজার ২১৭ হেক্টর ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, বুধবার কয়েকটি নদীর পানি কমলেও অধিকাংশ নদীর পানিই বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার কারণে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ছে। তারা জানায়, প্রধান নদী পদ্মা এবং যমুনার পানি বৃদ্ধি এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত পদ্মার পানি বৃদ্ধির আভাস তারা দিয়েছে। অপরদিকে যমুনা নদীর পানি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্থিতিশীল হয়ে আসবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তারা জানায়, বুধবার ৯০ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে সমতলে ৬০ পর্যবেক্ষণ এলাকার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ২৯ পয়েন্টের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে যমুনা নদীর ৫ স্থানে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে কাজীপুরে ১৫১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নদীর পানি। অপরদিকে বাহাদুরাবাদ ঘাটে ১৩৪ সেন্টিমিটার এবং সারিয়াকান্দিতে ১২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নযন বোর্ড জানিয়েছে, যমুনা নদীর পানি আগে কখনও বিপদসীমার এত ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়নি। এদিকে পদ্মা নদীর পানিও মহাদেবপুর এবং গোয়ালন্দে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তারা জানায়, উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া বিহারের বন্যার কারণে পদ্মা নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে রাজধানীর চারদিকে নদীতে পানি বাড়লেও এখনও বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আগমী ৫ দিনের মধ্যে রাজধানীর চারদিকে নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে আসার সম্ভাবনা নেই। তবে রাজধানী পূর্বাঞ্চলে কোন বাঁধ না থাকায নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জনকণ্ঠের প্রতিনিধিরা জানান, বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়ার কারণে রংপুরের ১ হাজার ৭৩৮ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাঠদান বন্ধ হয়ে গেছে। শাহজাদপুর বন্যা পরিস্থিতি চরম অবনতি হচ্ছে। সিরাজগঞ্জের বেলকুচির বগুড়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। রাজশাহীতে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে বিস্তীর্ণ এলাকায় তলিয়ে গেছে। বন্যার পানি বৃদ্ধির কারণে হুমকির মুখে পড়েছে গাইবান্ধা শহর রক্ষা বাঁধ। বন্যার পানি পড়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। দিনাজপুরে বন্যায় ২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। জামালপুর পানিতে ডুবে ছাত্রসহ ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফরিদপুরে শহর রক্ষা বাঁধে ফাটল দেখা দিযেছে। কুড়িগ্রাম এবং নওগায় বন্যার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এদিকে বুধবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে এখন পর্যন্ত বন্যায় ১০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্য গত ৪৮ ঘণ্টায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যায় সবচেয়ে বেশি পানিতে ডুবে ৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে। অধিদফতরের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, দেশের বন্যা উপদ্রুত ২১ জেলায় ১ হাজার ৮২৪টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। প্রতিটি জেলায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ, খাবার স্যালাইন ও পানি শোধনের বড়ি মজুদ আছে। এদিকে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব মোঃ গোলাম মোস্তাফা বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এ পর্যন্ত বন্যায় ২১ জেলায় বন্যায় ৩২ লাখ ৮৭ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার ২১৭ হেক্টর। তিনি জানান, প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ লাখ ৫২ হাজার পরিবার আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছে ৩৭ জন। আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ১ হাজার ৫৯৯টি। এগুলোতে আশ্রয় নেয়া মানুষের সংখ্যা ৪ লাখ ১১ হাজার। রংপুর ॥ দ্বিতীয় দফায় ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল, নদীর তীব্র ভাঙ্গনে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। নদ-নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৬৭৭টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও ৬১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। পানিতে বিদ্যালয়ের মাঠ, দেয়াল, কক্ষের মেঝে ধসে বা তলিয়ে যাওয়ার কারণে ১ হাজার ৬৭৭টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান স্থগিত করা হয়েছে। এদিকে বদরগঞ্জে বন্যার পানিতে ডুবে দুলাল মিয়া (৪৫) ও হৃদয় (১২) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার সকালে বদরগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউপির বুজরুক বাগবাড় ওকুতুবপুর ইউপির নাগেরহাট গাছুয়াপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। রাজশাহী ॥ রাজশাহীর মোহনপুরে শিবনদ এবং বাগমারায় ফকিন্নি নদীর বাঁধ ভেঙ্গে গত তিনদিনে তলিয়ে গেছে দুই পৌর এলাকা এবং ৭ ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। পানির নিচে এখন দুই উপজেলায় প্রায় দেড় হাজার হেক্টর ফসলি জমি। ভেসে গেছে ৩০০ পুকুরের মাছ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে কোটি টাকা। দিনাজপুর ॥ বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ৩টি প্রধান নদীসহ বিভিন্ন এলাকার পানি কমতে শুরু করেছে। ২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ত্রাণ তৎপরতার অংশ হিসেবে বন্যার্তদের মাঝে খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। গাইবান্ধা ॥ জেলার সবগুলো নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্যানুযায়ী, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, পলাশবাড়ী, গোবিন্দগঞ্জ ও সদর উপজেলার ৪২টি ইউনিয়ন এবং গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এদিকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পানিতে ডুবে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তালুককানুপুর ইউনিয়নের তালুককানুপুর গ্রামের রিয়ামনি নামে আড়াই বছরের এক শিশু মারা গেছে। সে ওই গ্রামের রফিকুল ইসলামের মেয়ে। এদিকে গাইবান্ধা শহর রক্ষা বাঁধের ডেভিড কোম্পানীপাড়া, বাহারবন, চকমামরোজপুর, কাজলঢোপের ৮টি পয়েন্ট একেবারে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। জামালপুর ॥ বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলা সদরের সঙ্গে রেলপথ ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও বকশীগঞ্জ উপজেলায় বন্যা দুর্গত এলাকায় তীব্র ত্রাণ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সরিষাবাড়ী ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পানি উঠায় চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জামালপুর-তারাকান্দি-বঙ্গবন্ধু সেতু রেলপথে বুধবার সকাল থেকে সকল প্রকার ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। মঙ্গলবার রাত থেকে সরিষাবাড়ী থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছ। জেলার বিভিন্ন স্থানে পানিতে ডুবে ছয়জন এবং বন্যার পানিতে পড়ে থাকা বিদ্যুতের সচল তারের স্পর্শে একজন মারা গেছে। টাঙ্গাইল ॥ যমুনা নদীর পানি অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে বিপদসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে যমুনা নদী রক্ষা বাঁধের টাঙ্গাইল-তারাকান্দি সড়কটির অন্তত ১০টি স্থানের বাঁধ ছিদ্র হওয়ায় বাঁধটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। যে কোন সময় ধসে যাওয়ার আশঙ্কা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এদিকে অব্যাহতভাবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে পাঁচ উপজেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। জেলার গোপালপুর, ভূঞাপুর, কালিহাতী, টাঙ্গাইল সদর ও নাগরপুর উপজেলার বানভাসিদের অভিযোগ, এখন পর্যন্ত সরকারী বেসরকারী কোন প্রকার ত্রাণ সহযোগিতা পায়নি তারা। দ্রুত শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার দাবি জানিয়েছেন তারা। পানি বৃদ্ধির ফলে বেশ কয়েকটি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। চরম হুমকির মুখে পড়েছে টাঙ্গাইল-তারাকান্দি যমুনা নদী রক্ষা বাঁধটি। বাঁধের পূর্বদিকের তারাই, গাড়াবাড়ী, কুটিবয়ড়া, চুকই নগর, অর্জুনা, জগৎপুড়াসহ অন্তত ১০ স্থান দিয়ে বাঁধের নিচ দিয়ে ছিদ্র হয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে পানি। সিরাজগঞ্জ ॥ যমুনা পারে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। যমুনায় পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে এখনও বিপদসীমার ১৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতি তিন ঘণ্টায় পানি দুই সেন্টিমিটার করে পানি বাড়ছে। যমুনায় পানি বৃদ্ধির এই হার ১০০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অপরদিকে শাহজাদপুরের গোপালপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটির প্রায় ১০০ মিটার বুধবার সকালে পানির প্রবল তোড়ে ভেঙ্গে গেছে। এতে শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী, জালালপুর, বেলতৈল ইউনিয়নের অন্তত হাজার একর আমন ধান তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধির ফলে কিছু ঘরবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও তলিয়ে গেছে। কুড়িগ্রাম ॥ পানি সামান্য কমতে শুরু করলেও কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির আরও অপরির্বতিত রয়েছে। এখনও ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উলিপুর, সদর ও চিলমারী উপজেলায় আরও ১০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। ভেঙ্গে গেছে বহু কাঁচা-পাকা সড়ক। কুড়িগ্রাম-রংপুর সড়কে যানবাহল চলাচল শুরু করলেও কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী সড়কের ৩টি স্থান ভেঙ্গে যাওয়ায় এখনও যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়নি ভুরুঙ্গামরী-সোনাহাট সড়কটিতেও। বন্যার ফলে কুড়িগ্রামের সঙ্গে ফুলবাড়ী, নাগেশ^রী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার সড়ক ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বিকল্প নৌপথে যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে। নীলফামারী ॥ বন্যার পানিতে পড়ে নীলফামারীর সোনারায় ইউনিয়নের উলটপাড়া গ্রামে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার বিকেল সোয়া চারটার দিকে এই ঘটনা ঘটে। শিশু দুইজন হলোÑ ওই গ্রামের কেশব চন্দ্র রায়ের শিশুপুত্র ডালিম চন্দ্র রায় (৭) দিলীপ চন্দ্র রায়ের মেয়ে দিপা রানী (৮)। সোনারায় ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান দিপা রানী ও ডালিম খেলার ছলে দুপুরে বন্যার পানিতে ভরা স্বরমঙ্গলা শাখা নদীর পানিতে ডুবে যায়। বিকেলে লাশ ভেসে উঠলে এলাকাবাসী দুই শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে। জয়পুরহাট ॥ অতি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে জয়পুরহাটে আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জয়পুরহাট-বগুড়া সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় ভারি যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে ওই সড়কে। এদিকে জেলার ৪টি নদীর মধ্যে তুলশীগঙ্গা নদীর পানি বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া জেলার আক্কেলপুর উপজেলার তুলশীঙ্গা বাঁধের মাদারতলী ঘাট এলাকায় ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে। নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আক্কেলপুর পৌর এলাকায় পানি উঠেছে। জেলা ত্রাণ বিভাগ জানিয়েছে, বন্যার পানি জেলার ৬০টি গ্রাম প্লাবিত করেছে। এতে ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বগুড়া ॥ বগুড়ার সারিয়াকান্দি ধুনট ও সোনাতলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বুধবার বিকেল পর্যন্ত যমুনা বিপদসীমার ১২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বেড়ে যাওয়া অব্যাহত রয়েছে। সারিয়াকান্দি ধুনট ও সোনাতলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ১২টি পয়েন্টে সিপেজ ও ছোট ছোট ফাটল দেখা দিয়েছে। সারিয়াকান্দিতে বন্যা আক্রান্তের সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তিন উপজেলায় পানিবন্দির সংখ্যা অন্তত ৮০ হাজার। পানি উঠেছে ৯২টি গ্রামে। ৮৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাঁধের ওপরে আশ্রিতদের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে এই সংখ্যা ৩ হাজারেরও বেশি। বন্যা এলাকায় জেলা প্রশাসন পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পুলিশ সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। নওগাঁ ॥ বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার প্রধান দুই নদী আত্রাই ও ছোট যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যন্ত জেলার ৯টি উপজেলার ৫৩টি ইউনিয়নের ২৫৬টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। উপদ্রুত এলাকার ৩৯ হাজার ১৭৫টি পরিবারের মোট ১ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সরকারীভাবে ঘোষিত ৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে মোট ১৫৬টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। সম্পূর্ণভাবে ৯৬০টি এবং আংশিকভাবে বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭ হাজার ৬০৪টি। ১৬ হাজার ৫৯৯ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় দেড় হাজার পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। ঠাকুরগাঁও ॥ জেলায় কমেছে বন্যার পানি। আস্তে আস্তে পানি কমলেও কমেনি দুর্ভোগ। বানভাসি এলাকায় অনেক ঘরবাড়িতে এখনও পচা কাদা পানি জমে আছে। সেখানে দেখা দিয়েছে সুপেয় পানি এবং পুনর্বাসনের জন্য নগদ অর্থ সঙ্কট। জেলার প্রায় ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দী ৬৫টি কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। অনেক এলাকায় আস্তে আস্তে পানি নামতে শুরু করায় বের হয়ে এসেছে ভাঙ্গা ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ ও ভেঙ্গে যাওয়া রাস্তাঘাট। এর সঙ্গে বেড়েছে বিশুদ্ধ পানি, খাবার ও পুনর্বাসনের জন্য নগদ অর্থ সঙ্কট। গবাদিপশুর খাদ্যেরও চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফরিদপুর ॥ পদ্মা নদীর পানি অস্বাভাবিক গতিকে বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। পদ্মার তীর সংরক্ষণ বাঁধের আনুমানিক ৩০ ফুট অংশ ধসে গেছে। ফরিদপুর সদরের ডিক্রির চর ইউনিয়নের বালিয়াঘাট এলাকায় পদ্মা নদীর তীর সংরক্ষণ কাজের অন্তত ৩০ ফুট ধসে গেছে। ফরিদপুর সদরের ডিক্রির চর ইউনিয়নের ১০টি গ্রামে ৩০০ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়া ১০০ পরিবারের বাড়ি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। সদরের চর মাধবদিয়া ইউনিয়নে ৪০টি গ্রামের চার হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়া ২০০ পরিবার নিমজ্জিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে ২৬টি সড়ক। সদরের আলিয়াবাদ ইউনিয়নের দুটি গ্রামে ২৫০ পরিবার পানিবন্দী এবং শতাধিক পরিবারের বাড়িঘর পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। ফরিদপুর সদরের পদ্মার চর অধ্যুষিত নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের দুটি ওয়ার্ডের ১২টি গ্রামের দুই হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। মুন্সীগঞ্জ ॥ বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বুধবার নিম্নাঞ্চলের আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় ভাগ্যকুল পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় এখানে ২০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া মাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল। এ কারণে লৌহজং, টঙ্গীবাড়ি ও শ্রীনগরের নতুন নতুন এলাকা জলমগ্ন হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের ভাগ্যকুল মঙ্গলবার রাতে পদ্মার পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ৬ দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার বিপদসীমা হলেও মঙ্গলবার রাত ৯টায় পদ্মার পানি ৬ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটারে প্রবাহিত হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জ জেলার নি¤œাঞ্চল বন্যাকবলিত এখন। শ্রীনগর, লৌহজং, টঙ্গিবাড়ী ও সদর উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী একাধিক গ্রাম জলমগ্ন হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার। মানিকগঞ্জ ॥ জেলার অভ্যন্তরীণ নদনদী ধলেশ্বরী, ইছামতি, কালিগঙ্গাতেও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। জেলার শিবালয়, দৌলতপুর, হরিরামপুর ও ঘিওর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কালীগঙ্গা নদীর তীব্র স্রোতে ভেঙ্গে গেছে সাটুরিয়া উপজেলার পশ্চিম চরতিল্লী গ্রামের দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাঁধ। গত সোমবার ৭০০ মিটার বাঁধের কিছু অংশ ভেঙ্গে যায়। স্থানীয়দের উদ্যোগে ভাঙ্গা অংশে ফেলা হচ্ছে বালির বস্তা। সিরাজগঞ্জ ॥ এনায়েতপুর থানার পাচিল-গোপালপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সড়ক প্রবল পানির স্রোতে ভেঙ্গে গেছে। বুধবার ভোরে বাঁধটির প্রায় ১০০ মিটার ভেঙ্গে যমুনার পানির প্রবল স্রোত হুরাসাগরে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে অন্তত ১৮টি গ্রামের কয়েক হাজার ঘরবাড়ি, সাড়ে ৫ হাজার একর আবাদি জমি, ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৩২টি তাঁত কারখানা পানিতে তলিয়ে গেছে। বিশেষ করে হাজারো একর আমন ধান তলিয়ে গেছে। এছাড়া এনায়েতপুর দক্ষিণের সঙ্গে শাহজাদপুর উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যমুনার পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌর সদরসহ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। শাহজাদপুর পৌর সদরের পুকুরপাড়, তালতলা, রামবাড়ী, রূপপুর, দাবারিয়া, বাড়াবিল, নলুয়া, মাদলা, শক্তিপুর, শেরখালি, পারকোলাসহ অধিকাংশ এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। রুপপুর উরিরচর এলাকায় অদিকাংশ বাড়িঘর ডুবে গেছে। তাদের চরম মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। পাবনা ॥ বেড়া উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পরেছে। গত কয়েক দিনের অব্যাহত পানি বৃদ্ধিতে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আরও পানি বৃদ্ধির আশঙ্কায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন অনেকেই। সৈয়দপুর ॥ উপজেলার উঁচু এলাকা থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। জেগে উঠছে পানিতে নিমজ্জিত বাড়িঘর, রাস্তাঘাট। তবে বিধ্বস্ত চেহারায়। তবে পানি কমলেও অনেক এলাকায় দুর্ভোগ কমছে না। বিশেষ করে সৈয়দপুর ১০০ শয্য হাসপাতালটির সংশ্লিষ্ট সকলকেই সীমাহীন কষ্টের মধ্যে পড়েছেন। শেরপুর ॥ জেলার পুরাতন ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। বুধবার ভোর থেকে ব্রহ্মপুত্রের পানি বাড়ার কারণে নদের বেড়িবাঁধের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে সদর উপজেলার চরপক্ষীমারি, কামারেরচর ও চরমোচারিয়া ইউনিয়নের অন্তত ২৫ গ্রামে পানি প্রবেশ করছে। এতে ওইসব এলাকার রোপা আমন ও সবজি ক্ষেত তলিয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে পানিবন্দী হয়ে পড়ছে শত শত মানুষ। বুধবার বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে ওই এলাকার বন্যার চিত্র।
×