ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

দ্রুত বাড়ছে নদীর পানি

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১৩ আগস্ট ২০১৭

দ্রুত বাড়ছে নদীর পানি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অধিকাংশ নদীর পানি অব্যাহত থাকায় আবারও দেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। হুহু করে বাড়ছে নদ-নদীর পানি। একদিনের ব্যবধানে শনিবার দেশের ১৪ নদীর পানি ১৭টি পয়েন্টে বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অথচ গত শুক্রবারও এসব নদী বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে আগামী এক সপ্তাহ নাগাদ নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। তারা জানিয়েছে ভারি বৃষ্টিপাতের পাশাপশি উজান থেকেও নেমে আসছে পানি। এদিকে যমুনা নদীসহ অধিকাংশ নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় ইতোমধ্যে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সারাদেশে প্রবল বর্ষণের আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। দুই মিলে এই মাসেই বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে রাজধানীসহ সারাদেশে শুক্রবার রাত থেকেই শুরু হয়েছে অবিরাম বর্ষণ। তা শনিবার সারাদিনই অব্যাহত ছিল। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে শনিবার সকাল ৬টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ঢাকায় ২২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া সকাল ৬টা থেকে ১২টা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রয়েছে সীতাকু-ে ২১৮ মিলিমিটার। একই সময়ে গোপালগঞ্জে ১১০ মিলিমিটার, চাঁদপুরে ১শ’ মিলিমিটার এবং সৈয়দপুরে ১২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তারা জানায় আজ রবিবার সারাদিন ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণের আশঙ্কা রয়েছে। সারাদেশে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় আর কয়েকদিন সারাদেশে ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে বলে তারা জানায়। এদিকে জনকণ্ঠের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে জানা গেছে, উজান থেকে নেমে আসা পানি এবং ভারি বর্ষণের কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রামে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পাহাড় ধসের কারণে চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ভারি বর্ষণ এবং নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করার কারণে নীলফারামীতে ২০ লাখ লোক চরম দুর্ভোগে পড়েছে। কুড়িগ্রামের চরের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়ে ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভারি বর্ষণের কারণে ঠাকুরগাঁওয়ে ৫ হাজার মানুষ এবং বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে লালমনিরহাটে ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। নেত্রকোনার দুর্গাপুরের ৭ ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গাইবান্ধায় টানা বর্ষণে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। সুনামগঞ্জে ফের বন্যার কারণে ২৮৫টি বিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অতিবর্ষণের কারণে খুলনা মহানগরীর রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়ে পড়েছে। ভোগাই নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে শেরপুরের অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে। বগুড়ায় আবার বন্যার আশঙ্কায় নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় থেকে ফিরে যাওয়া লোকজন আবারও বাঁধের ওপর আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে আবহাওয়া অফিস জানায়, মৌসুমি বায়ুর বর্ধিতাংশের অক্ষ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে। এ কারণে আজ রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দম্কা হাওয়াসহ হাল্কা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা (১-২) ডিগ্রী সেঃ হ্রাস পেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম অফিস/রাঙ্গামাটি/ খাগড়াছড়ি/ বান্দরবান/ কক্সবাজার দু’দিনের টানা বর্ষণে চট্টগ্রাম মহানগরীর নি¤œাঞ্চলসমূহ আবারও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এছাড়া বৃহত্তর চট্টগ্রামের কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানের বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিস আরও দু’তিনদিন ভারি বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে। শনিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত এ দফতর ১৭০ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। অপরদিকে, ভারি বর্ষণে নতুন করে পাহাড় ধস হওয়ায় চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের ঘাগড়া ও চাম্পাতলি এলাকায় মাটি পড়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে শনিবার সকাল থেকে পুনরায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগে শুক্রবার এ এলাকায় দুপুর থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিকেল থেকে হালকা যানবাহন চলাচল শুরু করেছিল। ভারি বর্ষণের কারণে মহানগরী ও এর আওতাধীন জেলাসমূহ এবং কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের নি¤œাঞ্চলসমূহ অথৈই পানিতে তলিয়ে যায়। ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকলে নতুন করে আরও পাহাড় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। খাগড়াছড়িতে চেংড়ি-মাইনি-ফেনী নদীতে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কাপ্তাই লেকে পানি আবারও বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঁধের ১৬টি স্টিলওয়ের প্রত্যেকটি খুলে দেয়া হয়েছে। খাগড়াছড়ি এবং রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ধসের আশঙ্কায় এর পাদদেশসমূহ থেকে লোকজনকে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। খুলনা অফিস ॥ অতিবর্ষণে শনিবার খুলনা মহানগরীর ছোট বড় সকল রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়। বহু বাড়ি-ঘরের নিচতলা ও দোকানে পানি প্রবেশ করে। ব্যাহত হয় জীবনযাত্রা ও রিক্সাসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল। বৃষ্টি ও রাস্তায় পানি জমে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ী, ক্রেতা, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীসহ সকল শ্রেণীর মানুষ বিপাকে পড়েন। বগুড়া অফিস ॥ যমুনা তীরবর্তী জনপদের মানুষ আবার বন্যা ও দুর্ভোগের আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। আকস্মিকভাবে গত দু’দিন থেকে যমুনার পানি বাড়ছে অস্বাভাবিক ভাবে। যমুনায় অস্বাভাবিক গতিতে এই পানিবৃদ্ধি নদী পাড়ের লোকজনকে নতুন করে শঙ্কায় ফেলেছে। গত দু’দিনেই যমুনার পানি প্রায় ৮০ সেন্টিমিটার বেড়ে শনিবার বিকেলে তা বিপদসীমা অতিক্রম করে। সুনামগঞ্জ ॥ ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে সুনামগঞ্জে বন্যার পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। জেলার তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার ও ধর্মপাশা উপজেলার প্রায় ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। অনেক ঘর বাড়িতে পানি উঠে যাওয়ায় রান্না বান্নাসহ গবাদি পশুর খাবার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। লালমনিরহাট ॥ ২৪ ঘণ্টার ভারি বৃষ্টিতে ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে জেলার পাঁচ উপজেলার তিস্তা নদী উপকূলে পানি ঢুকে পড়ে বন্যা দেখা দিয়েছে। প্রায় ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী পরিবারগুলোর গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছে। কুড়িগ্রাম ॥ দুদিন থেকে অবিরাম বৃষ্টি আর পাহাড়ী ঢলে কুড়িগ্রামের ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে ধরলা নদীর পানি বাড়ছে দ্রুত গতিতে। পঞ্চগড় ॥ অতি বর্ষণ আর উজানের পানিতে পঞ্চগড় জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত সবক’টি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদীর দু’পাড়ের শতাধিক গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। নীলফামারী ॥ ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে জেলাসহ পার্শ¦বর্তী এলাকাসমূহ নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। বাড়িঘর, সড়ক, ফসলি জমি সব কিছুই ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। শতশত পুকুরের কয়েক কোটি মাছ ভেসে গেছে। সেই যে গত বুধবার হতে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তা থামবার নাম নেই। জেলার প্রতিটি নদী এখন বিপদসীমায়। অবিরাম বর্ষণে জনজীবন থমকে গেছে। রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচল কমে গেছে। নওগাঁ ॥ গত তিন দিনের লাগাতার মুষলধারে বৃষ্টিতে নওগাঁ জেলার সর্বত্র জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অতিবর্ষণে শহরের পুরনো হাসপাতাল রোড, মহিলা কলেজের সামনে, এটিম মাঠের সামনে, উকিলপাড়া সড়ক, রুবির মোড়, হাসপাতাল সড়কসহ শহরের বিভিন্ন এলাকা জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। জয়পুরহাট ॥ জেলায় গত ৩দিন ধরে অবিরাম বর্ষণে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। বৃষ্টির কারণে দিনমজুররা কর্মহীন হওয়ায় তাদের জীবনযাত্রা দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। বাজারে সরবরাহ কম থাকায় পটল, বেগুন, ঝিঙ্গা, কাঁচামরিচ, ভে-িসহ বিভিন্ন সবজির দাম বেড়ে গেছে। ঠাকুরগাঁও ॥ তিনদিনের টানা বর্ষণে ঠাকুরগাঁওয়ের নিম্ন অঞ্চলের ২০টি গ্রামের কয়েক হাজার ঘড়বাড়ি প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘরে পানি ওঠায় শত শত লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। নেত্রকোনা থেকে ॥ টানা দু’দিনের বিরামহীন বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে জেলার দুর্গাপুর উপজেলার সদরসহ সাতটি ইউনিয়নের নিম্ন অঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলার ৩১টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি ঢুকেছে। হবিগঞ্জ ॥ ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে হবিগঞ্জের খোয়াই নদী আবারও ফুঁসে উঠেছে। আগের দিন শুক্রবার রাত থেকে খোয়াই নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় শনিবার দুপুর ২টা পর্যন্ত ভারত-বাল্লা সীমান্তবর্তী পয়েন্ট এবং হবিগঞ্জ শহরতলীর মাছুলিয়া পয়েন্ট থেকে প্রাপ্ত পরিমাপ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট নদীর পানি এখন বিপদ সীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শেরপুর ॥ দুই দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার পাহাড়ী নদী ভোগাইয়ের অন্তত ১৩টি স্থানে তীব্র ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। নদীর তীর গড়িয়ে প্লাবিত হচ্ছে চেল্লাখালী নদীর পানি। এতে পৌরসভাসহ এ উপজেলার অন্তত অর্ধশত গ্রাম আকস্মিক বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে।
×