ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শত শত সেনা মোতায়েন ॥ উদ্বেগ উৎকণ্ঠা

রাখাইন রাজ্যে ফের রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের প্রস্তুতি!

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ১৩ আগস্ট ২০১৭

রাখাইন রাজ্যে ফের রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের প্রস্তুতি!

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ দমন নিপীড়ন বর্বরতার যেন শেষ নেই। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু নিজ দেশে পরবাসীর মতো জীবনযাপন করছে সার্বক্ষণিক উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও জীবন মরণের শঙ্কা নিয়ে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকার নিশ্চিত ও তাদের ওপর বর্বরতা বন্ধে আন্তর্জাতিক সকল মহলের অনুনয় বিনয়, আবেদন নিবেদন মিয়ানমার সরকার পাত্তাই দিচ্ছে না। সর্বশেষ জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও সুনির্দিষ্টভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতম অমানবিক আচরণের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এতেও কোন বর্ণপাত নেই সে দেশের এনএলডি সরকারের। এমনি পরিস্থিতিতে রাখাইন রাজ্যে আবারও রোহিঙ্গাবিরোধী সেনা অভিযান পরিচালনা করার ইঙ্গিত মিলছে। রাখাইন রাজ্যজুড়ে গত শুক্রবার থেকে মোতায়েন করা হয়েছে শয়ে শয়ে সেনা সদস্য। কি হতে যাচ্ছে এ রাখাইন রাজ্যে। সীমান্তের ওপারের মংডু শহর থেকে বিভিন্ন সূত্রে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে জানানো হয়েছে, গত ৩ আগস্ট মংডু শহরের একটি পাহাড় থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ৬ নর-নারীর মৃতদেহ উদ্ধারের পর হঠাৎ করে পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিতে শুরু করেছে। মংডু, বুচিদং, রাচিদং শহরসহ বেশকিছু এলাকায় সশস্ত্র সেনা সদস্যদের আনাগোনায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সব সদস্য সার্বক্ষণিক শঙ্কিত অবস্থায় রয়েছে। রাখাইন প্রদেশের সরকারী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সেখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনা টহল মোতায়েন করা হয়েছে। ওই দিনের ঘটনায় কয়েক বৌদ্ধ নাগরিককে হত্যা করার ঘটনায় পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে এ আশঙ্কায় রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। গেল বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের ওপর অতর্কিত এক হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য প্রাণ হারায়। ওই ঘটনার জের ধরে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপর হামলে পড়ে। ফলে রোহিঙ্গারা দলে দলে দেশান্তরি হয়। প্রাণ হারায় অগণিত। এ ঘটনায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকার প্রকৃত ঘটনা প্রকাশে সেখানে গণমাধ্যম কর্মীদের যেতে দেয়নি। এমনকি জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলকেও সেখানে যেতে প্রকাশ্যে বাধা প্রদান করে। ৯ অক্টোবরের ঘটনার পর ১ লাখ রোহিঙ্গা নর-নারী ও জনগোষ্ঠী আশ্রয় গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে এসব রোহিঙ্গাদের মৃত্যুমুখে ঢেলে না দিয়ে সে দেশের সরকারের প্রতি তাদের ফিরিয়ে নেয়ার বার বার আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু কোনভাবেই সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। এমনিতর অবস্থায় গত শুক্রবার উগ্রপন্থী জঙ্গীদের হাতে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনার পাশাপাশি ২ তরুণী এখনও নিখোঁজ রয়েছে। অসমর্থিত সূত্রে এদের দুজনকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। দেশটির মাইয়ু এলাকা থেকে ৩ নারী ও ৩ পুরুষের মরদেহ উদ্ধার হয়। এদের শরীরে গুলি ও চাপাতির আঘাত রয়েছে। ঘটনার জন্য সে দেশের সরকার উগ্রপন্থীদের দায়ী করেছে। নিহতদের মধ্যে ম্রো সম্প্রদায়ের সদস্যও রয়েছে। অক্টোবরের ঘটনার ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই রাখাইন প্রদেশজুড়ে সেনা মোতায়েনের ঘটনায় সেখানকার রোহিঙ্গা ও এপারে আশ্রিত রোহিঙ্গা সদস্যদের মাঝে নানা শঙ্কার পাশাপাশি গুজবের ডালপালা বিস্তৃত হয়ে আছে। মূলত সেখানে প্রতিনিয়ত যা ঘটছে তা প্রকাশে সে দেশের সরকারের নানামুখী বাধা রয়েছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। ইতোপূর্বে তাদের প্রদত্ত নাগরিকপত্র বাতিরও করে দিয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গা নামে কোন আলোচনায় এজেন্ডা দিতেও সে দেশের সরকারের ঘোরতর আপত্তি রয়েছে। ফলে জাতিসংঘসহ বিশ্বের শক্তিশালী দেশসমূহের পক্ষে এ সমস্যা সমাধানে সকল পথ বন্ধ হয়ে আছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন মুসলিম দেশ ও ওআইসির পক্ষ থেকে বার বার মিয়ানমারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও কোন কিছুই ধোপে টিকছে না। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে রোহিঙ্গাবিরোধী দমন নিপীড়ন ও নির্যাতনকে মানবাধিকার পরিপন্থী বলেও যেন মনে করা হচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে এরা বাঙালী এবং সুদূর অতীত থেকে এ অঞ্চলে তৎকালীন আরাকান প্রদেশে তারা বসতি গেঁড়েছে। তাই তারা তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে। এর পাশাপাশি এদের সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে গবেষণা ও সাহায্য সহযোগিতা নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে নির্যাতনের সচিত্র প্রতিবেদন ও রিপোর্ট সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরার পরও কোন সফলতা আসেনি। প্রকারান্তরে বর্বর কায়দায় নিপীড়ন নির্যাতন অব্যাহত থাকায় এ জনগোষ্ঠীর লোকজনই কেবলই দেশান্তরিত হচ্ছে। সর্বশেষ ভারত সরকারও সে দেশে বিভিন্নভাবে বসবাসরত প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করার উদ্যোগ নেয়ার খবর চাউর হওয়ায় এ জনগোষ্ঠীর মাঝে দুশ্চিন্তা যেন নতুন করে ভর করেছে। তাই এরা বাংলাদেশকেই নিরাপদ স্থান হিসেবে বিবেচনায় এনে দিন দিন এদেশমুখী হচ্ছে। যা আগামীতে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে বলে ইতোমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে বলা হয়েছে। গত শুক্রবার থেকে নতুন করে সেনা মোতায়েনের ঘটনার পর কি হতে যাচ্ছে তা এখনও কক্সবাজার অঞ্চলে আশ্রিত ও শরণার্থী হিসেবে বসবাসরত রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তাদের কি বা করার আছে। নিজ দেশে একদিকে এরা যেমন পরবাসী, অপরদিকে বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে বসবাস করে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার পন্থাই এদের জন্য একমাত্র উপায় বলেই ধারণাও জন্মেছে।
×