ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চাঁদের মাহাত্ম্য

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ২০ জুন ২০১৭

চাঁদের মাহাত্ম্য

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেনÑএলো রমজানেরি চাঁদ এবার দুনিয়াদারি ভোল/সারা বরষ ছিলি গাফেল এবার আঁখি খোল। নজরুলের এ বাণীকে এখন সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক বিধায় চাঁদ নিয়ে এ লেখা। আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখতে পায়। জন্মান্ধরা পায় কি? তারা কি বোঝে চাঁদের মাহাত্ম্য, আকর্ষণ, সৌন্দর্য এবং রূপ-রহস্য? না, পায় না, বোঝে না। যে কারণে আকাশে চাঁদ ওঠা না ওঠায় তাদের মনে কোন প্রণোদনা, ভাবান্তর, প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। আবার এমন অনেকে আছেন জন্মান্ধ নন; কিন্তু মন অন্ধ, চাঁদের সৌন্দর্য, রহস্য দেখা-বোঝা-জানার কোন বিন্দুমাত্র আগ্রহ-ইচ্ছা তাদের নেই এক অর্থে তারাও কিন্তু অন্ধ। তারা চোখ থাকতেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। দেখেন, কিন্তু উপলব্ধির ক্ষমতা নেই। আর যারা যথার্থ চক্ষুষ্মান, যাদের চাঁদের মাহাত্ম্য বোঝার ক্ষমতা আছে, মন আছে, ইচ্ছা-আগ্রহ আছে চাঁদের অপার্থিব সৌন্দর্য অবলোকনের বা উপলব্ধির তারা নিশ্চুপ বসে থাকতে পারে না। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে না হোক অন্তত জানালার পাশে, পর্ণ কুটিরের ছিদ্র দিয়ে হলেও চাঁদের মিষ্টি হাসি দেখার প্রয়াস নেন। চাঁদের ভেতর থেকে ঠিকরে পড়া আলো যাকে আমরা জ্যোৎস্না বলি, অন্ধকারে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে যে ভাবনাভূতি, ভাল লাগার জন্ম দেয়, তা ব্যাখ্যাতীত। সে ভাল লাগার সীমা-পরিসীমা নির্ণয় করাও দুরূহ। চাঁদকে নিয়ে কতজন কত আঙ্গিকে ভেবেছেন, চিন্তা করেছেন। আর কতজন যে কত গান- গল্প-কবিতা লিখেছেন, লিখছেন এখনও তার যদি পরিসখ্যান করা যেত তা হলে হয়ত অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করত। এই যে চাঁদ নিয়ে এত লেখালেখি, গল্প-গান, এর অর্থ কি? অর্থ এই যে, চাঁদের আলো জোছনা আমাদের মনকে নাচায়, আন্দোলিত করে। যে কারণে মনের গভীরে এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে অর্থাৎ আমরা এর দ্বারা ভীষণ প্রভাবিত হই। আমাদের মধ্যে আবেগ-অনুভূতির জোয়ার আসে। আমরা যারা অতি সাধারণ তারা হয়ত এই ভাল লাগাকে সেভাবে প্রকাশ করতে পারি না। কিন্তু যারা অসাধারণ তারা কিন্তু এই ভাললাগা মুগ্ধতা, বিস্ময় বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ করেছেন, করছেন। যার অংশীদার হয়েছি, হচ্ছি আমরাও। এই যে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুল প্রসাদ, যতীন্দ্র মোহন বাগচী, প্রণব রায়, গৌরি প্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়সহ কতজন যে চাঁদ নিয়ে গান লিখেছেন, যে গান মনে কাঁপন ধরিয়ে দেয় তারই একটু নিদর্শন তুলে ধরতে চাই। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে উছলে পড়ে আলো / ও রজনী গন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢাল ॥ ... আবার রবীন্দ্রনাথ এও লিখেছেন- ও আমার চাঁদের আলো, আজ ফাগুনের সন্ধ্যাকালে/ ধরা দিয়েছ যে আমার পাতায় পাতায়, ডালে ডালে...॥ আবার রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে/ বসন্তের এই মাতাল সমীরণে। এবার লক্ষ্য করুন চাঁদ নিয়ে নজরুল কি লিখেছেন- আমি চাঁদ নহি, চাঁদ নহি অভিশাপ/ শূন্য হৃদয়ে আজও নিরাশায় আকাশে করি বিলাপ ॥ চাঁদ নিয়ে নজরুল আবার লিখেছেন- এলো ঐ পূর্ণশশী ফুল- জাগানো বহে যায় বকুল-বনে ঘুম ভাঙানো ॥ চাঁদ নিয়ে নজরুল আরও কত কি লিখেছেন, যেমন- একাদশীর চাঁদরে ওই রাঙা মেঘের পাশে/ যেন তাহার ভাঙা কলস আকাশ গাঙে ভাসে ॥... আবার লিখেছেনÑ এলো রমজানেরি চাঁদ এবার দুনিয়াদারি ভোল/ সারা বরষ ছিলি গাফেল এবার আঁখি খোল ॥ আবার লিখেছেন ঈদ জ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ এলো আবার দুস্রা ঈদ... নজরুল চাঁদকে শুধু প্রেম-বিরহ, ভাল লাগা-মন্দ লাগা নয়, দেখেছেন সময় ক্রমের অনুষঙ্গ হিসাবেও। যতীন্দ্র মোহন বাগচীর কাছে চাঁদ ধরা দিয়েছে স্মৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে। তিনি বলেছেন তাঁর মাকে-বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ/মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই? পুকুর পাড়ে লেবুর তলে/থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে। ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না তাই তো জেগে রই॥ সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো, দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো। লেবুর তলে পুকুর পাড়ে, ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে, ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই। রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?॥ কাজলা দিদিকে না দেখার, কাছে না পাওয়ারই আক্ষেপ আকুতি এতে ফুটে উঠেছে আর সেটা কিন্তু ঐ চাঁদকে উপলক্ষ করেই। আবার প্রণব রায় লিখেছেনÑ নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে/চুপি চুপি বাঁশি বাজে বাতাসে, বাতাসে ॥ ভাঙা ঘরে দুদিনের এই খেলাঘর/চোখ ভাঙা তবু এলো জোছনা।... চাঁদ নিয়ে গৌরি প্রসন্ন মজুমদার লিখেছেনÑ ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত, আসেনি তো বুঝি আর জীবনে আমার। এই চাঁদের তিমিরে বরণ করি, ওগো মায়া ভরা চাঁদ আর ওগো মায়াবিনী রাত ॥.... চাঁদ নিয়ে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেনÑ ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে, কারো নজর লাগতে পারে। মেঘদের উড়ো চিঠি, উড়েও তো আসতে পারে ॥... অতুল প্রসাদ লিখেছেনÑ চাঁদনী রাতে কে গো আসিলে? উজল নয়নে কে গো হাসিলে? আবার মান্নাদে লিখেছেন- চাঁদের আশায় নিভায়ে ছিলাম যে দ্বীপ আপন হাতে অন্ধ পরান খুঁজেছে তাহারে জীবনেরও আঙ্গিনাতে... এই যে চাঁদ নিয়ে এত সব আবেগমথিত ভাল লাগা, অনুভূতিপ্রবণ গান এর রেশ, দ্যোতনা-ব্যঞ্জনা কি কভু ম্লান হবার? এক একজনের কল্পনায় চাঁদ কতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে! লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×