ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ মইনুল ইসলাম

হেফাজত বনাম উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ১৮ জুন ২০১৭

হেফাজত বনাম উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন

ইতোমধ্যে এটা সবার জানা যে জাস্টিশিয়া নামক ভাস্কর্যটি মূলত হেফাজতের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিমকোর্টের সম্মুখ থেকে অপসারিত হয়েছে। কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক হেফাজতে ইসলাম নামক সংগঠনটি গত কয়েক বছর ধরে ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতিতে বেজায় তৎপর হয়ে উঠেছে। এই ধর্মান্ধ মৌলবাদী দলটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্যজোট নামক দুয়েকটি ক্ষুদ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। তাদের আন্দোলন ছিল এই দাবিতে যে ভাস্কর্যটি এক গ্রীক দেবির মূর্তি। তাই এটি ইসলামবিরোধী এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে এর অপসারণ করতে হবে। এর সঙ্গে তারা ‘ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের পুরনো এবং পশ্চিমা মধ্যযুগীয় আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী এখনও দেশে বিচারকার্য পরিচালনার নিন্দা জানিয়ে এর গোলামী থেকে মুক্তি কামনা করেন।’ অন্যদিকে তারা দেশের বিচারব্যবস্থা এবং আইনী প্রক্রিয়া ইনসাফের ভিত্তিতে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানান। পুরনো পশ্চিমা আইনের গোলামীর বিরুদ্ধে এবং ইনসাফ বা ন্যায়বিচারের পক্ষে ডাক দিয়ে আসলে তারা শরিয়াহ আইনের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। প্রাচীনপন্থী মাদ্রাসা শিক্ষিত হুজুররা বোধহয় জানেন না যে, বর্তমান বিশ্বে একমাত্র সৌদি আরব ছাড়া প্রায় সমস্ত মুসলিম বিশ্বই পশ্চিমা বিশ্বের আইন বহুলাংশে অনুসরণ করে। ব্রিটেনসহ সব পশ্চিমা বিশ্বের আইনের উৎস হলো রোমান আইন। রোমান আইনকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা পশ্চিমা বিশ্বের আইন আজ সারা বিশ্বে সর্বোৎকৃষ্ট আইন বলে বিবেচিত এবং নন্দিত। ব্রিটিশরা এদেশে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য এসেছিল বটে, তবে তাদের রেখে যাওয়া অন্যতম সেরা বস্তুটি হচ্ছে আইন ও বিচারব্যবস্থা। হুজুরদের স্বপ্নের দেশ পাকিস্তানে ও সেটি বেশ বহাল তরিয়তে আছে। উল্লিখিত সৌদি আরবের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দুয়েকটি ক্ষুদ্র উপসাগরীয় দেশ ছাড়া আর অন্য কোন মুসলিম দেশে হাতকাটা-মাথাকাটার মতো অমানবিক এবং মধ্যযুগীয় বিচার নেই। আইনের শাসন ও সুশাসন কাকে বলে এবং ন্যায় ও সত্যের ব্যাপারে শিল্পোন্নত দেশগুলোর আপোসহীনতা আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অনুকরণীয় আদর্শ বলা যায়। এ সমস্ত ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো যে আমাদের চেয়েও পশ্চাদপদ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন আসা যাক জাস্টিশিয়ার ব্যাপারে। জাস্টিশিয়া একটি রোমান শব্দ, যার অর্থ বিচারক। তিনি একজন নারী, সভ্য জগতের বহু দেশে একেÑ ন্যায় বিচারের ‘প্রতীক’ বিবেচনা করা হয়। তাই আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনেও ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে, মূর্তি হিসেবে নয়। ভাস্কর্যটি দেশে ন্যায় বিচারের একটি মূর্ত নান্দনিক প্রতীক হিসেবে বিরাজমান। এ কথাটি অজ্ঞ মূর্খ মানুষকে কি করে বুঝাব! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নানা জায়গায় মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্মৃতিবহনকারী ভাস্কর্য আছে। একুশের শহীদ মিনারও এদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। মৌলবাদীদের এ ধরনের ধর্মীয় অপব্যাখ্যা নতুন নয়। এক সময় এদের মতে ছবি তোলা ও ঘরে ছবি রাখাও হারাম ছিল। এখন কোন হজযাত্রী কি পাসপোর্ট ছাড়া মক্কা শরীফ যেতে পারবে? ছবি ছাড়া কি পাসপোর্ট হয়? তাছাড়া বাংলাভাষা মুসলমানের ভাষা নয়, হিন্দুর ভাষা, শহীদ মিনার প্রদক্ষিণ এবং ফুলদান নাজায়েজ, ’৫২-এর ভাষা শহীদদের শহীদ বলা গুনাহ, নারী নেতৃত্ব এবং নারী শিক্ষা হারাম, পাকিস্তান আমলে বলা হতো যুক্ত নির্বাচন তথা হিন্দু-মুসলমান একত্রে ভোটদান নাজায়েজÑ এমন অসংখ্য ফতোয়া তথাকথিত আলেমদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে আমরা পেয়ে থাকি। মুসলিম বিশ্বের, বিশেষ করে দুয়েকটি আরব দেশের ভাস্কর্যের দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করলে আলোচ্য ধর্মান্ধ হুজুরদের অজ্ঞতা এবং মূর্খতা স্পষ্টত ফুটে উঠবে। সৌদি আরব সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র বলে বিবেচিত হয়। দেশটির বন্দরনগরী জেদ্দাতে জয় অব লাইফ বলে একটি ভাস্কর্য আছে। সেখানে দুজন মানুষের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে। সম্প্রতি একই শহরে বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজের একটি প্রতি মূর্তি উন্মোচন করা হয়েছে। ২১৬ বর্গমিটার উচ্চতার এই মূর্তিটিকে এ যাবত বিশ্বের সর্বোচ্চ মূর্তি বলে ধরা হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী দুবাইতে ‘টুগেদার’ শিরোনামে আরব নারী-পুরুষদের দৃষ্টিনন্দন একটি ভাস্কর্য আছে। মিসর, লেবানন তুরস্ক প্রভৃতি মুসলিম দেশের উদাহরণ দিয়ে তালিকাটি আরও দীর্ঘায়িত করা যায়। যেমন মিসরে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ পিরামিড এবং কয়েক হাজার বছরের পুরনো মমিকৃত ফেরাওদের মূর্তি। মিসরেই ইসলামী শিক্ষার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। কিন্তু সেখানকার আলেমরাও পিরামিড ও ফেরাওদের মূর্তি ভাঙার ফতোয়া দেয় না। কারণ এগুলো বিশ্বের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ এবং তাদের দেশের ইতিহাসেরও অমূল্য সম্পদ। উগ্র ধর্মান্ধ তালেবান গোষ্ঠী আফগানিস্তানের বাসিয়ানে কয়েক হাজার বছরের পুরাতন বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস করে চরম বর্বরতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে। আফগানিস্তানের তালেবান, পাকিস্তানের তেহরিফে তালেবান এবং ইরাক-সিরিয়ার আইএসের মতো ধর্মান্ধ জঙ্গীদের পথ ধরেই হেফাজত বাংলাদেশে আবির্ভূত হতে চাচ্ছে কিনা সেটা বেশ ভাববার বিষয়। এখানে কিছুদিন আগে পাঠ্যপুস্তক কেলেঙ্কারির ব্যাপারে এই ধর্মান্ধ শক্তির ভূমিকার কথাও বলতে হয়। গেল বছরের এপ্রিল মাসে হেফাজতে ইসলাম সংগঠনটি সরকারের কাছে প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা পাঠ্যপুস্তকে নাস্তিকদের দ্বারা রচিত কিংবা হিন্দু ভাবাদর্শে প্রভাবিত গল্প, কবিতা এবং প্রবন্ধসমূহ বাতিলের দাবি জানায়। বিশ্বাস করার কারণ আছে তারই ফলে এবারের পাঠ্যবইয়ে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মনীষীবৃন্দ যথা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎ চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র, ভরতচন্দ্র রায়ের মতো লেখকদের লেখা বাদ পড়েছে। প্রগতিশীল লেখক এবং কবি হুমায়ুন আজাদের ‘বই’ কবিতাটি বাদ পড়েছে, কারণ তাতে মনের সঙ্কীর্ণতা এবং গোড়ামির হাত থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান আছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ কবিতাটি বাদ পড়েছে এই অভিযোগে যে তাতে হিন্দুদের দেবীর প্রশংসা আছে। অথচ এটি একটি চমৎকার দেশপ্রেমমূলক কবিতা যা বাংলা এবং বাঙালীর হৃদয়কে আবেগে আপ্লুত করে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। এই হেফাজতগোষ্ঠীই ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে এক মহাসমাবেশের মাধ্যমে বিরাট ধ্বংসযজ্ঞের অবতারণা করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করাই ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের যথাযথ বিচার ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে তখন শাহবাগে আন্দোলন চলছিল। হেফাজতের প্রধান দাবি ছিল, শাহবাগের আন্দোলনকারীরা নাস্তিক। তাই তাদের মৃত্যুদ-ে দ-িত করতে হবে। তারা যে নাস্তিক তার কোন প্রমাণ এই ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা দিল না এবং কেউ যদি নাস্তিক হয়ও দেশের প্রচলিত আইনে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিচার করতে হবে। আইন মতে যথাযথ শাস্তিও দিতে হবে। তার আগেই হেফাজত মৃত্যুদ-ের ফতোয়া দিয়ে দিল। উপরোক্ত সমাবেশে যে বিরাট ধ্বংসযজ্ঞের অনুষ্ঠান হয়, তাতে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের বহু ক্ষতি হয় এবং কোরআন-হাদিসসহ বহু পবিত্র গ্রন্থ পোড়ানো হয়। হেফাজতের দাবি ছিল, সমাবেশকারীদের দাঙ্গা থামাতে গিয়ে পুলিশের অভিযানে শত শত লোক নিহত হয়েছে। হেফাজত নিহত শতাধিক লোকের তালিকা দেবে বলেও বলেছিল। অথচ সরকারী মহলের তথ্যমতে, মাত্র ১৭ জনের নিহত হওয়ার বিবরণ জানা গেল। ধার্মিক হেফজত তাদের কথামত শত শত কেন, কোন নিহতেরই তালিকা দিতে পারল না। কোথায় শত শত আর কোথায় মাত্র ১৭ জন। ‘নারী তেঁতুলের মতো’ যাদের শীর্ষনেতা বলেন, তাদের কাছ থেকে মানুষ সভ্যতা এবং সত্যতা খুব বেশি একটা আশা করতে পারে না। আসলে মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতা সর্বপ্রকার প্রগতিশীলতা, আধুনিকতা এবং উন্নয়নের শত্রু। এক অর্থে উন্নয়ন হলো আধুনিকায়ন। পুরনো মান্দাতার আমলের উৎপাদন ব্যবস্থার বদলে উৎপাদনে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার যখন সর্বত্র। উন্নত দেশগুলোতে উৎপাদনসহ জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণেই তারা আজ বিশ্বের সেরা ধনী দেশে পরিণত হয়েছে এবং বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের উন্নয়নের মূল দর্শনটি হচ্ছে পুরনো বিশ্বাস নয়। বিজ্ঞানই শক্তি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পেছনে সক্রিয় দর্শনটি হচ্ছে বুদ্ধি ও যুক্তি। পরীক্ষিত সত্যের ফলে উদ্ভাবিত জ্ঞান বস্তু জগতে প্রয়োগের কারণে উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। শিক্ষা বা জ্ঞান যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি করে, তেমনি উৎপাদন এবং উন্নয়ন শিক্ষা ও সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়। পুরনো বিশ্বাস, পুরনো মূল্যবোধ এবং পুরনো নিয়ামাচারের বদলে গড়ে উঠে নতুন সংস্কৃতি ও সভ্যতা। উন্নয়নের মূল নায়ক হলো মানুষ। মানুষ শিক্ষা, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে বস্তু জগতের পরিবর্তন ঘটিয়ে সভ্যতার জয় রথটিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। মানুষের এই শ্রেষ্ঠত্বের কথাটি চতুর্দশ শতাব্দীতে ইউরোপে যে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ নামক বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলন ঘটে, তারই ফসল। তারই ফলে পোপ, পুরোহিত ও শাস্ত্রের বেড়াজাল ভেদ করে মানুষ তার অসীম শক্তির সন্ধান পায়। এ কারণে বহু প-িত এবং বিজ্ঞানীকে দেশ ছাড়তে এবং প্রাণ দিতে হয়েছে। আজ বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে। তার পেছনে কাজ করছে শিক্ষা এবং বিজ্ঞান। আর এ কারণেই সরকার শিক্ষা তথা আধুনিক শিক্ষার ওপর জোর দিচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, কৃষি এবং শিল্পে উৎপাদনÑ এক কথায় উন্নয়নের সর্বক্ষেত্রে দরকার শিক্ষা এবং বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ মানুষ। কওমী মাদ্রাসার মানুষ দিয়ে তা হবে না। উন্নয়ন মানেই হলো দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মানুষের মুক্তি। হেফাজত-খেলাফত মাঝে মধ্যে উৎপাত করবে বটে। তবে তাতে আমাদের উন্নয়ন থেমে থাকবে না। মনে রাখতে হবে ধর্ম এবং ধর্মান্ধতা এক কথা নয়। ধর্মান্ধতা জাতীয় অগ্রগতির বড় শত্রু। লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×