ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জয়িতা আরিফা শোনালেন তৃতীয় লিঙ্গ বৃহন্নলাদের কথা

নীতিমালায় অনুমোদন মিললেও হিজড়াদের ভাগ্যবদল হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২০ মে ২০১৭

নীতিমালায় অনুমোদন মিললেও হিজড়াদের ভাগ্যবদল হয়নি

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ বেঁচে থাকার জন্যই হিজড়া সম্প্রদায়ের অনেকে ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়। কারণ আমাদেরও তো খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে। একজন সাধারণ মানুষের চলার পথ আর আমাদের চলার পথ এক না। ছোটবেলাতেই আমরা পরিবার থেকে বিতারিত হই। এরপর নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই নিজেদেরই করে নিতে হয়। সকলেই বলে হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষরা চাঁদা তোল, অশ্লীল অঙ্গভক্তি ও কদর্য ব্যবহার করে। কিন্তু সমাজের ভদ্র মানুষরা তো পারে এই সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে। আমরা সমাজ থেকে বঞ্চিত। আমরা এখনও তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পাইনি। বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীকে বিশেষ লিঙ্গ অর্থাৎ তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করে সরকার একটি বিশেষ নীতিমালার অনুমোদন দিলেও তা হিজড়া সম্প্রদায়ের ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে পারেনি। অনেক হিজড়া ভিক্ষাবৃত্তি করতে চায় না। তাদের জন্য সরকার যদি কোন ব্যবস্থা নেয়, তাহলে সমাজের মানুষও বাঁচবে, হিজড়ারাও বাঁচবে।’ অনেকটা উদ্বেগ প্রকাশ করে নিজ সম্প্রদায় সম্পর্কে কথাগুলো বলছিলেন জয়িতা আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী। সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় সম্প্রতি আরিফাকে ‘জয়িতা পদক-২০১৬’-তে ভূষিত করেছে। তৃতীয় লিঙ্গের অন্যান্য মানুষের মতোই নিজের পরিচয় নিয়ে ছোটবেলা থেকে নানা পর্যায়ে হোঁচট খেতে হয়েছে আরিফাকে। অন্য হিজড়াদের তুলনায় তিনি পারিবারিকভাবে সুবিধাভোগী। তার পরিবার তাকে তাড়িয়ে দেয়নি। তাই বলে সামাজিকভাবে যে বঞ্চনার শিকার হননি, তা নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সনদে তার নাম আরিফ। তবে সমাজে তিনি পরিচিত আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী হিসেবে। সেই পরিচয়ে এখনও জাতীয় পরিচয়পত্রও মেলেনি। আরিফা জানালেন, ‘শৈশবে অন্যান্য ছেলে শিশুর মতোই আনন্দের দিন কাটলেও বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মে আরিফা বুঝতে পারে তার আচরণ মেয়েদের মতো। মেয়েলি আচরণের কারণে প্রথমেই পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বিভিন্ন লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার হতে থাকি। অনেকেই ‘এই হিজড়া এই দিকে আয়’ বলে সম্বোধন করত। অনেকটা গ্লানি নিয়ে শুরু করলাম জীবন সংগ্রাম। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে গেছি। ময়মনসিংহ পলিটেকনিক থেকে লেখাপড়া করে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার (ইলেক্ট্রিক্যাল) হয়েছি। ডিপ্লোমা পাসের পরও শুধু পরিচয়ের কারণে কোন চাকরি মেলেনি আমার। তবে যে হিজড়া পরিচয় নিয়ে এত বঞ্চনা, সেই পরিচয়েই স্বীকৃতি পেয়েছি ‘জয়িতা’ হয়ে।’ এ পরিচয়েই তিনি দেশে প্রথমবারের মতো হিজড়া সম্প্রদায় থেকে গত বছর ঢাকা বিভাগের ‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী’ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ ‘জয়িতা’ পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৫ সালের ২ জুন আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী জন্মগ্রহণ করেন। নানা বাধা-বিপত্তির পরও লেখাপড়া শিখতে পিছপা হননি। তিনি পড়ালেখার পাশাপাশি একটি স্থানীয় এনজিওতে পার্টটাইম চাকরি নেন। এরপর নিজ উদ্যোগে শুরু করেন সমাজসেবা সংস্থা। নিজ প্রয়াসে কিভাবে সমাজ কল্যাণ সংস্থা গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ হলেন এ প্রশ্নের জবাবে আরিফা জনকণ্ঠকে বললেন, ‘হিজড়া সম্প্রদায় বরাবরই অবহেলিত। পরিবার ও সমাজ এদের কখনও স্বীকৃতি দেয় না। হিজড়া হয়ে জন্মাগ্রহণ করায় তো আমাদের দোষ ছিল না। তাহলে কেন সমাজ আমাদের অবজ্ঞা করবে। ২০১০ সালে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাসের পরও ভাল একটি চাকরি পাইনি। ভাবলাম আমার সম্প্রদায়ের মানুষগুলোকে সহায়তা করব। এজন্যই ’১৩ সালে সিঁড়ি সমাজ কল্যাণ সংস্থা নামক হিজড়াদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তুলি। বর্তমানে আমি সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি।’ বর্তমানে তিনি তার স্থায়ী ঠিকানা জামালপুর জেলার দাপুনিয়া গ্রামে বসবাস করছেন। জামালপুরের আরিফা হিজড়াদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও ভিক্ষাবৃত্তি থেকে ফিরিয়ে আনতে ‘সিঁড়ি সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ সংগঠনটির মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত তৃতীয় লিঙ্গের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন সংক্রান্ত কার্যক্রমে অনুপ্রাণিত হয়ে হিজড়াদের স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন আরিফা। তার এ সংগঠনের সদস্য মোট ৮৭ হিজড়া। এর মধ্যে ১৫ হিজড়া এ সংগঠনের মাধ্যমে ‘সিঁড়ি হস্তশিল্প’-এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন হস্তশিল্প তৈরি করছেন। এ জন্য তারা পারিশ্রমিক পান। এতে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি নামক সংগঠন। আরিফা বলেন, ‘বর্তমান সরকার তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়েছে। সরকারের কাছ থেকে জয়িতা পুরস্কারের সম্মাননা পেয়েছি। কিন্তু শুধু স্বীকৃতি, সম্মাননা দিয়ে তো জীবন চলে না। হিজড়া বলে আমরা চাকরি পাই না। হিজড়া পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র করতে পারি না। নিজের একটি সংগঠনের মাধ্যমে হিজড়াদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার সংগঠনই তো চলে না। হস্তশিল্প সামগ্রী কোন মাসে বিক্রি হয়, কোন মাসে হয় না। দেশে ১৫ হাজারেরও বেশি হিজড়া রয়েছে। তাদের কল্যাণে সরকার যদি ব্যবস্থা করে তাহলে অবশ্যই আমরাও দেশের জন্য কিছু করতে পারব। একই দেশে বাস করে অন্যান্য জনগণের থেকে আমাদের আলাদা চোখে দেখা হয়। আমরা মৌলিক চাহিদা থেকেও বঞ্চিত। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হলে হিজড়া সম্প্রদায়কে আর রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তি করতে হবে না।’
×