ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাবির ফজলুল হক হলের পূণর্মিলনীতে পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন

প্রকাশিত: ০১:২৭, ১৯ মে ২০১৭

ঢাবির ফজলুল হক হলের পূণর্মিলনীতে পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ॥ শত কর্মব্যস্ততা ভুলে দেশের নানান আন্দোলন-সংগ্রামে জড়িয়ে থাকা পুরনো সোনালী দিনের স্মৃতি রোমন্থনে পুরো একটি দিন অতিবাহিত করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। সহপাঠীদের সঙ্গে মাতলেন গল্প, আড্ডা গান আর করলেন সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি। শুক্রবার দিনব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সবুজ প্রাঙ্গনে স্মৃতির টানে মুখরিত হয় হাজারো নবীন-প্রবীনেরা ঐতিহাসিক হল জীবনের পুরনো সোনালী দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে। ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত ফজলুল হক হলের এই পূণর্মিলনী ও প্রথম সাধারণ সভায় অনুষ্ঠানে ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণ করেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মূখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক হোসেন মনসুর প্রমুখ। কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী স্মৃতি চারণ করে বলেন, স্মৃতী আত্মজীবনেরই অংশ। আমাদের কিছুই হারিয়ে যায়নি। আমাদের স্মৃতি এখনও বেচে আছে। অসাধারণ প্রতিবাদের সময় ফজলুল হক হলের সেই সময়। সেই সময় হলে বসে রাত জেগে জেগে অনেক প্রতিবাদী কবিতা লিখেছিলাম। ছাত্রলীগের বর্তমান যে সংগীত ‘শিক্ষা শান্তি প্রগতির নামে মোরা মুজিবের সৈনিক’ সে সংগীত ফজলুল হকে হলে বসে লিখেছিলাম। সেই সময়টা ছিল আমদের সৃজনশীলতার সময়। আমরা ডাকসু রাজনীতি করতাম। তিনি আরও বলেন, আজকে যে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে আমরা দাঁড়িয়েছি সেই অগ্রযাত্রার সবাই একসাথে সামিল হতে হবে। শুধুমাত্র অতীতকে রোমন্থত করার মাধ্যমে আমাদের স্বপ্নকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইনা। সারা দেশকে বদলে দেয়ার যে রূপকল্প হাতে নিয়েছে প্রধানমন্ত্রী তা বাস্তবায়নে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। এইচ টি ইমাম বলেন, তখন শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির দারুন চর্চা হতো। আনন্দ খেলাধুলা আর পড়াশোনা একসাথে চলত। সেই সময় ডাকসু নির্বাচন হতো এবং ডাকসু ছিল খুব শক্তিশালী। বঙ্গবন্ধু এই হলে আসতেন ও সভা সমিতি করতেন। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও ছিলেন এই হলের শিক্ষাথী। তাদের জন্য আমরা ধন্য। তিনি বলেন, আমরা বেশ কয়েকজন করাচি গিয়েছিলাম স্কলারশিপ নিয়ে সেটা আমাদের অনেক বেশি উৎসাহিত করেছিল। তখন আমরা করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তখন আমার যেই সুযোগ সুবিধা ও সহানুভূতি পেয়েছি সেটি স্মরণীয়। সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য এ সময় তিনি আহ্বান করেন। কে এম নুরুল হুদা বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলনের ডাক দেয়ার পর পরই পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের মধ্যে নতুন একটা চেতনা ও একটি সংগ্রামী মনোভাব জাগ্রত হয়েছিল। তারপরে ধারাবাহিকভাবে অনেক সংগ্রাম ত্যাগ ও নির্যাতন হয়েছে ছাত্রদের উপর। তখন ফজলুল হক হলসহ সব হলগুলোর সামনে ইপিআর বাহিনী অস্র নিয়ে পাহাড়া দিত যেন শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করতে না পারে। স্বাধীনার জন্য সব আন্দোলনে অংশগ্রহন আমাদের সুযোগ হয়েছিল। তাই হল জীবনে আমরা অত্যন্ত দূর্বল। অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, হলের জীবন খুবই সুখময় ও সোনালী। হলের স্মৃতি সবচেয়ে সুন্দর ও সোনালী স্মৃতি। আমাদের অতীত ইতিহাস ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সেই অতীত ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, অত্যন্ত কঠিন সময়ে আমাদের পদযাত্রা শুরু হয়েছিল। কারণ সে সময় আমরা পরাধীন ছিলাম। কি উত্তাল সময় আমার কাটিয়েছি! সেই সময়ে উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু ৭ ই মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন। সেইসব কথা আজও খুব মনে পড়ছে। নিজ বন্ধুর গল্প বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার বন্ধু নজরুলের কথা খুব মনে পড়ছে। মার্চে যখন বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন তখন আমার ফজলুল হক হলে গঠন করেছিল সূর্যসেন স্কোয়ার্ড যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য। সেই স্কোয়ার্ডের সদস্য ছিলেন নজরুল। সব সময় সে মিছিলের সামনে থাকত। যখন ২ মার্চ স্বাধীন বাংলা পতাকা উত্তোলন করা হলো তখন সেই মিছিলে স্বাধীন বাংলার পতাকাটি ছিল নজরুলের হাতে। নজরুল এখন আর নেই! ১৯৭১ সালে ট্রেনিং শেষ করে যখন ফিনে আসছিলেন তখন পাক বাহিনীর হাতে অনেক বিস্ফোরকসহ ধরা পড়ে। পাকিস্তানীরা তাকে বেধে সেই বিস্ফোরক তার শরীরে ব্যবহার করে। নজরুলের মাংশ, রক্ত, শরীর, আত্মা বাংলার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। আজকে তাকে খুবই স্মরন করছি। তিনি বলেন, সেই সময় মানুষেরা বা তার আগের মানুষেরা অনেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উজ্জ্বল হয়েছে। আমরা সেই মধুর স্মৃতিগুলো ধরে রাখব। তিনি আরও বলেন, আমদের মুক্তির সংগ্রাম ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এই হলের শিক্ষার্থীরা। কারণ সেই সময় ছাত্র রাজনীতিতে মেধাবীরা ছিল। আর ছিল ছাত্র সংসদ। ঢাকা বিশ্ববিবিদ্যালয়ে পথ দেখাতে ডাকসু নির্বাচন খুব দরকার। তার মধ্যে থেকে ছাত্র নেতৃত্ব বেড়িয়ে আসবে। আমরা যেন সেই ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারি। ক্ষোভ প্রকাশ করে এ সময় তিনি বলেন, কোথায় গেল সেই রাজনীতি? কোথায় গেল সেই ছাত্র সংসদ? কোথায় গেল সেই নির্বাচন? নির্বাচন আছে শিক্ষকদের জন্য। নির্বাচন আছে কর্মচারীদের জন্য। নির্বাচন নেই ছাত্রছাত্রীদের জন্য। এর থেকে পরিহাসের কথা আর কি হতে পারে? আজকে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই বাংলাদেশের হাল ধরতে হবে মেধাবীদের। তাহলেই সোনার বাংলা সিংহ ধারে পৌছে যাওয়া সম্ভব হবে এবং বঙ্গবন্ধু সেই স্বপ্ন দেখেছেন। অধ্যাপক হোসেন মনসুর বলেন, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থানসহ সব সময় এই হল থেকে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য হলের শিক্ষার্থীদের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, সেই সময় ছাত্ররা গান পরিবেশন করতেন। ছাত্রদের মধ্যে থেকে যে সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল তারা অত্যন্ত পারদর্শীতার সাথে সংগীত পরিবেশন করত। সামাজিক কর্মকান্ডে মানুষের জন্য মানুষ নামে জনকল্যানে কাজ করতে। অনুষ্ঠানে আরও অংশ নেন হলের সাবেক শিক্ষার্থী ও পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক, সাবেক হল প্রাধ্যক্ষ আবু জাফর মোহাম্মদ, হল প্রভোস্ট অধ্যাপক হারুন অর রশীদ, প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক কবির বিন আনোয়ার প্রমুখ।
×