জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ জিপিএ-৪.৭০ পেয়ে দশম শ্রেণীতে উঠেছে মেয়েটি। নতুন বছর, সবাই স্কুলে যাচ্ছে। অথচ সে টানা দুই মাস ধরে শুয়ে আছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিছানায়। প্রথমে কিছুদিন ওয়ার্ডে তারপর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) এবং বর্তমানে শামীমা ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) বিছানায় শুয়ে দিন কাটাচ্ছে। যেখানে রেখে সরকারী খরচে নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। টানা ১৫ দিন পর ৬ জানুয়ারি মেয়েটির জ্ঞান ফিরেছিল। চিকিৎসকদের ধারণা ছিল, ক্রমেই শামীমা সুস্থ হয়ে উঠবে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। কিন্তু ক্রমশ শামীমাকে বাক্্শক্তিহীন নীরবতা গ্রাস করে নিচ্ছে। কি হয়েছিল ২৩ ডিসেম্বর রাতে? তার কি মনে আছে দুর্বৃত্তরা কে বা কারা ছিল? মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় শামীমা এখনও সেদিনের ঘটনা কাউকে বলতে পারেনি।
শামীমা খুবই মেধাবী ছাত্রী। তার মা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমার মেয়ে পড়ালেখার পেছনে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করত। সামনের বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে আমার মেয়ে। ভাল রেজাল্ট করে এ বছর যখন দশম শ্রেণীতে উঠল কত খুশি হয়েছিল সে। শামীমা বলল, মা আমি এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে দেখাবো। মেয়ের বান্ধবীরা স্কুলে ক্লাস করছে। কিন্তু আমার শামীমা এখন হাসপাতালে।’ কি ঘটেছিল ২৩ ডিসেম্বর রাতে? চোখ মুছতে মুছতে শামীমার মা বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে দুই রুমের একটিতে শামীমা একাই থাকত। পাশের ঘরে আমি ওর বাবা ও আমার ছোট দুই ছেলে থাকি। সেদিন রাতে ভোরের দিকে আমি নামাজ পড়তে উঠে দেখি শামীমার ঘর খোলা। তার ঘরে ঢুকে দেখি আমার মেয়ের মাথা ও মুখ রক্তে ভিজে আছে। পুরো বিছানায় রক্ত আর রক্ত...। আর বলতে পারলেন না তিনি।
ঢামেকে ভর্তি হওয়ার পরপরই শামীমার মাথায় অস্ত্রোপচার চালানো হয়। এরপর টানা ১৫ দিন পর শামীমার জ্ঞান ফেরে। এরপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়। জ্ঞান ফিরলেও শামীমা টানা ১০ দিন কোন কথা বলতে পারেনি। তারপর ধীরে ধীরে দু-একটি কথা বললেও তা অস্পষ্ট শোনায়। সবসময় নিশ্চুপ থেকেই দিন কাটাচ্ছে সে। ঢামেকের নিউরো সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ অসিত কুমার সরকার জনকণ্ঠকে জানান, ‘মেয়েটির জ্ঞান ফেরার পর ভেবেছিলাম আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সে একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে আছে। তার স্মৃতিশক্তি ঠিক আছে কি না জিজ্ঞাসা করলে নিউরো সার্জন বলেন, ‘আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার নাম কি? কোন ক্লাসে পড়? সে প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর দিয়েছে। মাথায় গুরুতর জখম পাওয়ার কারণে মানসিকভাবে কিছুটা বিকারগ্রস্ত হয়েছে সে। অনেক কিছু হয়ত মনে করতে পারছে না সে। তার মাথার সমস্ত আঘাত এখন শুকিয়ে গেছে। আমরা একমাস হলো শামীমাকে ওসিসি সেন্টারে পাঠিয়ে দিয়েছি। সেখানে রেখেই তার চিকিৎসা করা হবে।’
ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সমন্বকারী বিলকিস বেগমের কাছে শামীমার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এখন সে শারীরিকভাবে মোটামুটি সুস্থ। হাঁটাহাঁটি করতে পারছে, খাওয়া-দাওয়াও ঠিকঠাক করছে। তবে তার পুরোপুরি স্মৃতি ফেরেনি। আমরা তার সঙ্গে মজার মজার কথা বলার চেষ্টা করা হলেও কোন সাড়া দেয় না সে। সবসময় চুপচাপ থাকছে। এ জন্য তাকে মানসিক চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এখন অবশ্য দু-একটা কথা বলছে। ঢামেক হাসপাতালের মনোরোগবিদ ডাঃ আবদুল্লাহ আল মামুনের কাছে শামীমা বর্তমানে চিকিৎসারত রয়েছে। এক মাস চিকিৎসা চলবে। এর মধ্যেই তার স্মৃতি পুরোপুরি ফিরে আসবে বলে জানিয়েছেন ডাক্তার। তবে এখনও শামীমার দাঁতে একটা অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। তার মুখের চোয়ালের এক পাশ একটু বেঁকে গিয়েছে। মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তার মুখের অস্ত্রোপচার করা সম্ভব না। সেই সঙ্গে তাকে সেদিনের ঘটনা মনে করানোর জন্যও চাপও দেয়া যাচ্ছে না। আশা করছি, শামীমা দ্রুত মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে, এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গত ২৯ ডিসেম্বর বানদীঘি গ্রামের মোঃ মাহাবুল (৪০) ও এযাবুল সরকারকে (২৮) গ্রেফতার করে কালাই থানার পুলিশ। তারা দুজনেই মেয়েটির প্রতিবেশী। গ্রেফতারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও প্রকৃত অপরাধীর সন্ধান এখনও জানতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তা। তবে, সন্দেহভাজন অপরাধীদের এখনও হেফাজতে রাখা হয়েছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: