ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মানস ঘোষ

বাংলাদেশের রাজনীতি ও একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ২০ মার্চ ২০১৭

বাংলাদেশের রাজনীতি ও একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত

আমি যখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যু সংবাদ পেলাম তখন নিজের এক পরমাত্মীয়ের বিয়োগের ব্যথা অনুভব করলাম। কারণ, সুরঞ্জিত ছিলেন আমার খুবই কাছের মানুষ। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারাল এক দক্ষ, পূর্ণতাপ্রাপ্ত সংসদবিদ যার সংসদীয় রীতি-নীতি, জ্ঞান, ভূমিকা ও বক্তব্য তাঁর দেশের সীমানা ছাড়িয়ে নন্দিত হয়েছে দেশে বিদেশে। তাঁর প্রয়াণ বাংলাদেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর সংসদীয় বাগ্মিতা তাঁকে এমন এক উচ্চাসনে আশীন করেছিল যা তাঁর সমগোত্রীয়দের কাছে ঈর্ষণীয় বিষয় হয়ে উঠেছিল। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও তাঁর সঙ্গে কেমন যেন এক একাত্মতা বোধ করতাম। বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কিত কোন প্রশ্ন থাকলেই ফোন করতাম উত্তর খুঁজতে। বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলোর ব্যাপারে তিনি ছিলেন আমার ‘মেন্টর’। যেটা এককালে ছিলেন ‘সংবাদের’ বজলুর ভাই। এখন সেটা হচ্ছেন মামুন, শাহরিয়ার, স্বদেশ, পঙ্কজ, বারকাত, ডাঃ আতিউর রহমান। বাংলাদেশের জটিল রাজনীতির অঙ্ক সুরঞ্জিত এত সুন্দর ও প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন, যা আমার কাছে মুশকিল আসান হয়ে যেত। সুরঞ্জিতের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্রীহট্টের বাড়াছেড়ায়Ñ যা ছিল অসমের কাছাড়ের লাগোয়া এক মুক্তাঞ্চলে। আলাপ ও পরিচয়টা খুবই ক্ষণস্থায়ী ছিল। তখন সে পাঁচ নম্বর সেক্টরের সাব কমান্ডার, কর্নেল মীর শওকত তার প্রধান। সুরঞ্জিত ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাদের যুদ্ধের রসদ নিতে এপারে আসছিল। মাসটা ছিল অক্টোবর। হানাদার বাহিনী পিছু হটছে। সুরঞ্জিত বলেছিলেন ‘আমাদের কথা বলার সময় নেই, ক্যাম্পে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে’ বলে ঘন জঙ্গলে তাঁর দল মিলিয়ে গেল। তাঁর সঙ্গে আমি রণাঙ্গনে যেতে আগ্রহী সেই কথা বলার সুযোগও পাইনি। তার পরে তাঁর সঙ্গে দেখা ঢাকায় চার মাস পরে ন্যাপের (এম) প্রধান কার্যালয়ে সেগুনবাগিচায়, দলের প্রধান প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমেদের এক সংবাদ সম্মেলনে। সাংবাদিকদের সঙ্গে সুরঞ্জিতের পরিচয় করিয়ে প্রফেসর বললেন, ‘এই ছেলেটি ১৯৭০-এর নির্বাচনে মুজিব ও আওয়ামী লীগের ঝড় শ্রীহট্টের সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত হাওড় অঞ্চলে রুখে দিয়ে দিরাই-শাল্লা থেকে নির্বাচিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক আইনসভায় সাড়া ফেলে দেয়। সেই সুবাদে সে এখন বাংলাদেশে গণপরিষদের সদস্য এবং সংবিধান রচনায় ব্যস্ত।’ তারপর সুরঞ্জিত এক উপনির্বাচনে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিরোধী আসনে যখন বসলেন তখন তাঁর দেয়া সংবিধান সংক্রান্ত বেশ কয়েকটা বক্তৃতা শুনি। আইনী জটিলতা এড়ানোর জন্য সুরঞ্জিত সেনের প্রস্তাবগুলো শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেন খুবই গুরুত্বের সঙ্গে শুনে তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। সুরঞ্জিত সাতবার জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়ে সভার কার্যবিবরণীকে এতটাই সমৃদ্ধ করেছিলেন যে, দলের ভেতরে ও বাইরের প্রতিপক্ষরা তাঁকে অত্যন্ত সমীহ করে চলত। সংসদে বিরোধীদের সৃষ্ট যে কোন কঠিন পরিস্থিতিকে যুক্তি ও উপস্থিত বুদ্ধির মাধ্যমে নস্যাত করতে তার জুড়ি ছিল না। এরশাদ ও খালেদা জমানায় আওয়ামী লীগ সংসদে যখন বিরোধী আসনে তখন দিনের পর দিন দেখেছি মওদুদ আহমদের মতো কুটিল ঝানু ব্যারিস্টার প্রতাপশালী মন্ত্রীর বক্তব্যকে সুরঞ্জিত ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছেন সরল ভাষায় জবাব দিয়ে। তাঁকে আবার দেখেছি গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়ে দিল্লীর হাসপাতাল বেডে ভীষণ যন্ত্রণায় কাতরাতে। তাঁর চরিত্রের মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক মুখটি বেশ কয়েকবার দেখার সুযোগ পেয়েছি। ১৯৭৪ সালে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর চাকমাদের বাঙালী হয়ে যাওয়া সম্ব^ন্ধে এক বিতর্কিত মন্তব্যকে ঘিরে উত্তপ্ত তর্কবিতর্ক চলছে। সুরঞ্জিত ও চাকমাদের অবিসংবাদী নেতা এবং সাংসদ মানবেন্দ্র লারমা ওই বিতর্কের মধ্যমণি। সুরঞ্জিত হঠাৎ তার আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে অনেকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, ‘আপনার এটা অন্যায় আবদার বঙ্গবন্ধু। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের নিজস্ব একটা জাতিসত্তা কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্ম আচার-বিচার আছে। আপনি দেশের সব ভাষাভাষী, ধর্ম, বর্ণ মানুষের পিতা। উপজাতিদের বাঙালী হয়ে যাওয়ার আবদার আপনার মুখে সাজে না, তারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের তাদের মতো করে থাকতে দিন। তাদেরও অনেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তাদের সম্মান দিন।’ বঙ্গবন্ধু সমেত সমস্ত সদস্য নীরবতার সঙ্গে শ্রদ্ধা সহকারে সুরঞ্জিতকে শুনেছিলেন। মনে আছে মানবেন্দ্র লারমা সংসদ বিরতির সময় লবিতে সুরঞ্জিতকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘সমস্ত উপজাতি আপনার কাছে ঋণী হয়ে রইল।’ আবেগপ্রবণ মানবেন্দ্র এই কথা বলেই কাঁদতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধু সুরঞ্জিতের সংসদীয় কাজকর্ম ও ভূমিকা দেখে এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তাঁকে প্রায়শই ডেকে তাঁর চিন্তা-ভাবনা জানার চেষ্টা করতেন। কারণ, সুরঞ্জিত ন্যাপ (মুজাফফর) এর একমাত্র সাংসদ হলেও তিনি তখন সংসদে বিরোধী দলের নেতার মতো ভূমিকা পালন করছেন। বঙ্গবন্ধু সুরঞ্জিতকে বিদেশে সংসদবিষয়ক অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠাতেন। যে কারণে সুরঞ্জিত সংসদ বিষয়ক অনেক রীতি-নীতি ও জ্ঞান রপ্ত করেছিলেন এবং সাংসদ হিসেবে তিনি তাঁর যথার্থ ভূমিকা পালনে সফল হয়েছিলেন। ফলে বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার পর সামরিক শাসকরা তাঁকে তাদের দলে ভেড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এটা অনেকের জানা নেই। বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার প্রধান চক্রান্তকারী খন্দকার মোশতাকও সুরঞ্জিতকে তার দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে যোগ দেয়ার জন্য প্রচুর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। লোভনীয় ক্ষমতার টোপ দিয়ে তাঁকে কেনার চেষ্টা করেন। ১৯৭৮-এ জিয়ার রেফারেন্ডামের সময় মোশতাক আমাকে তার ঢাকার আগামসী লেনের বাড়িতে বসে বলেছিলেন, ‘সুরঞ্জিত আমার দলে যোগ দিলে ভাল হতো। ফণী মজুমদারের মতো কট্টর প্রগতিবাদীও তো আমার সঙ্গে মিলিয়েছিল। কিন্তু বাবু সুরঞ্জিতকে আমি পাশে পাইনি। সে আমাকে খুবই হতাশ করেছিল।’ পরে মোশতাকের এই দাবির সত্যতা যাচাই করার জন্য যখন সুরঞ্জিতকে প্রশ্ন করেছিলাম তিনি আমাকে সরাসরি হ্যাঁ বা না বলে সখেদে একটি মন্তব্য করেছিলেন, ‘শুধু মোশতাক কেন আরও অনেকে আমাকে কেনার চেষ্টা করেছে। যখন প্রলোভনে সাড়া দিইনি তখন আমি ও আমার পরিবার চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছি। এরশাদ আমাকে ও আমার পরিবারকে কম দৈহিক ও মানসিক অত্যাচার করেননি। যার রেশ আমাদের ওপর এখনও পুরো মাত্রায় আছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সফল রাজনীতিক হওয়ার অনেক বিপদ আছে। শেখ হাসিনা যখন জেলে তখনও আমাকে নিয়ে সামরিক শাসকরা একই খেলা খেলার চেষ্টা করে। তখনও ধরা দিইনি।’ সুরঞ্জিতকে নিয়ে একটি ঘটনা এখনও আমার স্মৃতিপটে আঁকা আছে। ১৯৮৫ সালে এরশাদের সামরিক সরকার তখন ক্ষমতায়। এরশাদ মন্ত্রিসভার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। সালাউদ্দিন এরশাদের ‘ইনার সার্কেলের’ বিশ্বস্ত মন্ত্রী ছিলেন। এরশাদ সরকার কেমন চলছে তা নিয়ে সালাউদ্দিন প্রচুর কথা বলতেন। আমাকে তিনি তার সচিবালয় দফতরে একদিন আমন্ত্রণ জানালেন গল্প করার জন্য। এরশাদকে নিয়ে গল্প যখন বেশ জমে উঠেছে তখন হঠাৎ সুরঞ্জিতের প্রবেশ। মন্ত্রীর আপ্ত সহায়ক যতই বলছে, ‘স্যার এখন এক ভারতীয় সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছেন’, সুরঞ্জিত সে সব উপেক্ষা করে মন্ত্রীর টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, ‘ওই সাংবাদিক আমার বন্ধু কোন চিন্তা নেই।’ মন্ত্রী চেয়ার থেকে সালাউদ্দিন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মানসকে তো নিশ্চয়ই চেনো’? সুরঞ্জিতের সটান উত্তরÑ ‘তোমার অনেক আগে থেকেই ওকে চিনি।’ তারপর বলে চলেন, ‘আমি তোমার কাছে একটি সাহায্য চাইতে এসেছি, সেই সাহায্য তুমি দেবে কিনা তা নিয়ে দোটানায় আছি। এক বিদেশী সাংবাদিকের সামনেই সাহায্য চাইছি। তা শুনেই সালাউদ্দিন বলে উঠেন, ‘ভণিতা না করে বলো কী চাও।’ সুরঞ্জিত বললোÑ ‘আমার মন বলছে তুমি সাহায্য করবে না তোমার হিন্দু বিরোধী মানসিকতার জন্য। সালাউদ্দিনের উত্তর ‘ঝেড়ে কাশো।’ সুরঞ্জিত বলেন, ‘একটি ইৎরষষরধহঃ হিন্দু সরকারী ডাক্তার ঈড়সসড়হবিধষঃয ঝপযড়ষড়ৎংযরঢ়-এর জন্য ধঢ়ঢ়ষু করতে চায় ঢ়ষধংঃরপ ংঁৎমৎুতে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে। সে সব অর্থে যোগ্যতাসম্পন্ন এবং প্রয়োজনীয় সব মাপকাঠিতে সর্বোত্তম প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিতও হয়েছে। ডাক্তারটির নড়ংং তাঁকে ঝপযড়ষড়ৎংযরঢ়-এর জন্য রিকমেন্টও করতে চায়। কিন্তু তার জন্য সরকারের ঘঙঈ লাগবে। সেটা কি তোমার সরকার দেবে?’ সুরঞ্জিতের বক্তব্য শুনেই সালাউদ্দিনের চটজলদি উত্তরÑ ‘আমি ঘঙঈ দিলেও এরশাদ দেবে না। হিন্দু ডাক্তারকে আমরা ঝপযড়ষড়ৎংযরঢ় দিয়ে বিলেতে পাঠাব এবং সে দেশে না ফিরে হিন্দুস্তানে চলে যাবে এবং সেখানে গিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠবে। সেটা আমিও হতে দেব না। হিন্দুদের বিশ্বাস নেই।’ সুরঞ্জিত ওই বক্তব্য শুনে ক্ষেপে গিয়ে বলেন, ‘আমার ভয়টা অমূলক ছিল না। ক’টা হিন্দু ডাক্তার ঝপযড়ষড়ৎংযরঢ় নিয়ে বিদেশে পড়ে ইন্ডিয়া গেছে। যে ঝপযড়ষড়ৎংযরঢ়-এর জন্য ধঢ়ঢ়ষু করতে চায় তার পুরো পরিবার বাংলাদেশে থাকে। তার জমি, বাড়ি-ঘরদোর এখানে। সে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতেও প্রস্তুত। সে যদি দেশে না ফেরে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সরকার বাজেয়াফত করতে পারে।’ সুরঞ্জিতের এই বক্তব্য শুনে সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমি ওই সব কথার কোন গুরুত্বই দিই না। আমি বরং এক নিম্ন মেধার মুসলিম ডাক্তারকে ওই ঝপযড়ষড়ৎংযরঢ়-এ পাঠাব। যে দেশে ফিরে আসবে এবং সরকারী হাসপাতাল চালাবে। সুরঞ্জিত ক্ষেপে গিয়ে বলে ফেলেন, ‘মুসলিম ডাক্তার যারা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যান তারা সবাই দেশে ফেরেন? তারা কি বিলেত, আমেরিকায় থেকে যায় না? রিয়াদ, জেদ্দা ও দুবাইয়ের হাসপাতালে এত ভূরি ভূরি বাংলাদেশী মুসলিম ডাক্তার কেন? সালাউদ্দিন গলা চড়িয়ে বলেন, ‘দোস্ত আমি আমার সরকারের অবস্থানের কথা বলেছি। ওই ঝঃধহফ থেকে আমরা সরছি না। আমাদের যতই হিন্দুবিরোধী বলে গাল পাড়ো।’ সুরঞ্জিত রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলে, ‘আমার না আসাই উচিত ছিল।’ সুরঞ্জিত যেই চেয়ার থেকে উঠে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে, সালাউদ্দিন বলে ওঠেন, ‘এরশাদের দলে যোগ দাও সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে।’ প্রত্যুত্তরে সুরঞ্জিত বলেন, ‘আমি তোমার মতো এরশাদের আবদুল হতে চাই না। আমি যা আছি তাতেই খুশি।’ শুধু সালাউদ্দিনই নয়, এরশাদের অনেক অনুগামী ও পারিষদ সুরঞ্জিতকে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়ানোর জন্য বহু চেষ্টা করে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাও কিছু ঘটনার সাক্ষী। কিন্তু সুরঞ্জিত হাজার প্রলোভন সত্ত্বেও হাসিনা বিরোধী ফাঁদে পা দেননি। সুরঞ্জিতের সব ধর্ম-বর্ণ-ভাষাভাষীদের কাছে সমান গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তাঁর চরিত্রের এই দিকটা আমায় অবাক করত। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সঙ্গে তাঁর নির্বাচনী এলাকা দিরাই-শাল্লায় যাওয়ার। এলাকায় ফিরলেই হাওড় অঞ্চলের মুসলিম-হিন্দু কৃষক ও জেলেরা তাঁর কাছে এসে যেভাবে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা উজাড় করে তুলে ধরত এবং সুরঞ্জিত সেভাবে তা লাঘব করার চেষ্টা করতÑ তা আমার কাছে ছিল এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। একবার দিরাই থেকে লঞ্চে করে শেরপুরে ফিরছি। লঞ্চটি যখন মারকুলি নদী বন্দরে ভিড়ল, লঞ্চে এক মুসলিম কৃষক হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে লঞ্চে উঠল। টাকার অভাবে তার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না বলে সে সুরঞ্জিতের পা জড়িয়ে ধরল। সুরঞ্জিত মারকুলির এক হিন্দু ও এক মুসলিম ব্যবসায়ীকে লঞ্চে ডেকে পাঠায় এবং তাদেরকে কৃষকের মেয়ের বিয়ের টাকা যোগাড় করতে বলে। সুরঞ্জিতের মহানুভবতায় আপ্লুত হয়ে কৃষকটি বলে, ‘আপনি এই লঞ্চে আসছেন জেনে আমি সাহায্যের জন্য আসি। আমি জানতাম আপনি আমায় খালি হাতে ফেরাবেন না। সুরঞ্জিতের নির্দেশে লঞ্চটি মারকুলি বন্দরে ১৫ মিনিটের জায়গায় এক ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করে ওই কৃষকের আবেদনে সাড়া দিতে। সুরঞ্জিতের শত্রুর দলও কম ছিল না। দলের এক হেভিওয়েট নেতার অপপ্রচারে তিনি একবার সংসদ নির্বাচনে হারেন। কিন্তু শেখ হাসিনা শেষ দিন পর্যন্ত তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে সরকার ও সংসদীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশীদার করেন। সুরঞ্জিত রেলমন্ত্রী হওয়ার পর আমি তাঁকে বেশ কয়েকবার নিজে থেকে সাবধান করেছিলাম এই বলে যে, তিনি জমি-হাঙ্গরদের পাতা ফাঁদে যেন পা না দেন। কারণ রেলের দেশজুড়ে প্রচুর দামী জমি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যা তারা হাতাতে চায়। সেই লক্ষ্যে তারা তার সুনাম ক্ষুণœ করতে পিছপা হবে না। আর সুরঞ্জিত বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে চলেছেন তাঁকে বানচাল করতে তাঁরই দফতরের আধিকারিকরা বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তিনি আমার কথার কোন মূল্য না দিয়ে বলেছিলেন, অনেকটা বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘আমাকে দাবিয়ে রাখতে কম চেষ্টা হয়নি। কিন্তু দাবিয়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না।’ লেখক : ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা ও ১১ মার্চ ১৯৪৮
×