ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভয়াবহ লোডশেডিং ॥ ময়মনসিংহ জোনে কৃষকদের ভোগান্তি

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ভয়াবহ লোডশেডিং ॥ ময়মনসিংহ জোনে কৃষকদের ভোগান্তি

রশিদ মামুন ॥ সেচ মৌসুমে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ময়মনসিংহ জোনে দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যুত থাকে না। বোরো ক্ষেতে সেচ না দিতে পেরে আরইবির স্থানীয় কার্যালয় ঘেরাও করেছে কৃষকরা। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে বিদ্যুত সচিবের হস্তক্ষেপ চেয়ে আরইবি চেয়ারম্যান সম্প্রতি একটি চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু এরপরও পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি। দেখা গেছে, বিদ্যুত থাকতেও কেবলমাত্র সরবরাহ ত্রুটি আর পিডিবির গাফিলতিতে বিদ্যুত পাচ্ছে না এসব জেলার মানুষ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ এবং টাঙ্গাইলে ভয়াবহ লোডশেডিং করা হচ্ছে। আরইবি স্বীকার করেছে এই জোনের সাতটি পল্লী বিদ্যুত সমিতিতে ৩৯৬ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সর্বনিম্ন সরবরাহ করা হয়েছে ২০৬ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ১৯০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। দিনে রাতে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ৫২ ভাগ। অর্থাৎ দিন-রাতের হিসেবে ১২ ঘণ্টাই লোডশেডিং করতে হয়েছে। সরল হিসেবে ১২ ঘণ্টা হলেও মন্ত্রণালয়ে যে অলিখিত নির্দেশনা রয়েছে তাতে দেখা যায় গ্রামের মানুষ বিদ্যুত পায়ই না। মন্ত্রণালয় আরইবিকে যে নির্দেশনা দিয়েছে তাতে দেখা যায় প্রথমে বিভাগীয় শহর এরপর জেলা এবং পরবর্তী সময়ে উপজেলার চাহিদা মেটাতে বলা হয়েছে। এরপর বিদ্যুতের অবশিষ্ট অংশই গ্রামে দেয়া হয়। ফলে আরইবির স্থানীয় কার্যালয় থেকে যত দূরে বিতরণ এলাকা ততই কমে যায় বিদ্যুতের হিস্যা। যদিও একই পরিমাণ বিল দেয় সবাই। কিন্তু শহরের মানুষকে খুশি করতেই গ্রামকে বঞ্চিত করার এই নীতি নিয়েছে বিদ্যুত বিভাগ। সেচ মৌসুমে কৃষি সেচের জন্য অতিরিক্ত বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হয়। কিন্তু এখানের সেচের চাহিদা পূরণ তো দূরের কথা মানুষের সাধারণ চাহিদাই পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর আগে সেচ মৌসুম শুরুর আগে বিদ্যুত এবং জ্বালানি বিভাগ বিশেষ প্রস্তুতি নিত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এক ধরনের অবহেলা দেখা গেছে বিদ্যুত বিভাগের মধ্যে। সেচের প্রস্তুতি কোথাও কোন সমস্যা হলে তা সমাধানের জন্য আগেভাগে তেমন প্রস্তুতিও নেয়া হয় না। দেশের এই এলাকায় বিদ্যুত পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নয়নে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয় না বিদ্যুত বিভাগ। এর আগেও বিদ্যুত বিতরণ নিয়ে এসব জেলাগুলোতে ভোগান্তির চিত্র নানাভাবে উঠে এলেও প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। গত ৭ ফেব্রুয়ারি আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন বিদ্যুত সচিব ড. আহমেদ কায়কাউসকে লেখা এক চিঠিতে বিদ্যুত বিতরণ পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। চিঠিতে আরইবি চেয়ারম্যান উল্লেখ করেছেন এই অঞ্চলে ২ বছর ধরেই বছরে অন্তত নয় মাস লোডশেডিং করা ছাড়া উপায় থাকে না। বিদ্যুত বিতরণের এই অঞ্চলের গ্রাহকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। তীব্র লোডশেডিং চলায় এসব জেলায় কোন কোন এলাকায় পল্লী বিদ্যুতের অফিস ভাংচুর করা হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে আরইবির কর্মীদের নাজেহালও করছেন গ্রাহক। বিদ্যুত না পেয়ে সাম্প্রতিক সময়ে এমন বেশ কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। বিদ্যুত না পেয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সাধারণ কৃষক আরইবির নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ অফিস ঘেরাও করেন। এ সময় স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কৃষক বাড়ি ফিরে গেছেন ঠিকই। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। শুক্রবার নেত্রকোনা সদর উপজেলার দুধকুড়া গ্রামের সুপ্লয় সেন জানান, তারা এই মৌসুমে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের স্বীকার হচ্ছেন। দিনের পর দিন সেচ দিতে পারছেন না। এসব বিষয়ে তারা পল্লী বিদ্যুত অফিসেও যোগাযোগ করেছেন কিন্তু কোন সুরাহা হচ্ছে না। একই রকম অভিযোগ করেছেন কেন্দুয়ার আশুজিয়া গ্রামের কৃষক সোহাগ মিয়া। তিনি বলছেন, আমরা সেচ দিতে না পারলেও কারও এ বিষয়ে মাথা ব্যথা নেই। আমাদের ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কেউ কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ বছর এই দশা চললে ফলন অনেক কম হবে বলে জানান তিনি। আরইবি চেয়ারম্যানের দেয়া চিঠির সঙ্গে দেয়া ২০ দিনের বিদ্যুত সরবরাহ তলিকায় দেখা যায়, গত ১৫ জানুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২১ দিনের শেষদিকে এসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এই ২১ দিনে গড়ে চাহিদা ৩৯৬ মেগাওয়াটের বিপরীতে ১০০ মেগাওয়াটের ওপর লোডশেডিং করা হয়েছে। বেশির ভাগ দিন হিসেব করে দেখা গেছে, অন্তত আট থেকে ১০ ঘণ্টাই বিদ্যুত থাকে না। কোন কোন দিন ১২ ঘণ্টাই বিদ্যুত থাকে না। জানা গেছে তিন কারণে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে এই এলাকার পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) ময়মনসিংহ গ্রিড উপকেন্দ্র (আশুগঞ্জ-ময়মনসিংহ) ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন ওভারলোডেড অবস্থায় রয়েছে। সঙ্গত কারণে বিদ্যুত থাকলেও গ্রিড ওভার লোডেড থাকায় বিদ্যুত নিতে পারছে না আরইবি। এছাড়া এখানে জামালপুরে পিডিবির একটি বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। কেন্দ্রটি তরল জ্বালানিতে বিদ্যুত উৎপাদন করে। কিন্তু কেন্দ্রটিতে ঠিকঠাকভাবে জ্বালানি সরবরাহ করা হয়না। জ্বালানি সঙ্কটে কেন্দ্রটির বিদ্যুত উৎপাদন বিঘিœত হয়। অন্যদিকে আরপিসি এলের একটি বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে গ্যাসচালিত। এই কেন্দ্রও জ্বালানি সঙ্কটে পূর্ণ মাত্রায় উৎপাদন করতে পারে না। নেত্রকোনা পল্লী বিদ্যুত সমিতির জিএম মোঃ মজিবুর রহমান বিদ্যুত সঙ্কটের কথা স্বীকার করে বলেন, এ অঞ্চলের বিদ্যুত সরবরাহ হয় ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ ও জামালপুরের বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র থেকে। কিন্তু কেন্দ্র দু’টির জ্বালানি হিসেবে পর্যাপ্ত গ্যাস ও ফার্নেস ওয়েল সরবরাহে ঘাটতির কারণে বিদ্যুত উৎপাদন কম হচ্ছে। আর এ কারণেই চাহিদামতো সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, বিষয়টির দ্রুত সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
×