ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাধা ২২ সেতু ॥ বুড়িগঙ্গার আদিরূপে ফেরাতে এগোচ্ছে না কাজ

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বাধা  ২২ সেতু ॥ বুড়িগঙ্গার আদিরূপে ফেরাতে এগোচ্ছে না কাজ

আনোয়ার রোজেন ॥ উদ্যোগ গ্রহণের ছয় বছর পরেও দখল-দূষণে জর্জরিত বুড়িগঙ্গার আদি রূপ ফেরানো গেল না। বুড়িগঙ্গার গতিপথে অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ২২ সেতু নদীর আদি রূপে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেতুগুলোর ফাউন্ডেশন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় খনন কাজ ঠিকমতো করা যায়নি। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে ‘বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার (নতুন ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম)’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যথাযথ অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। এর মধ্যে নদীর মরফোলজি (নদীর গতি প্রকৃতি ও প্রবাহ) পরিবর্তন হওয়ায় যমুনায় ২ কিলোমিটার চর সৃষ্টি হয়েছে। অত্যাধিক পলি বহন করায় টাঙ্গাইল অংশে আগের বছর যা খনন করা হয় পরবর্তী বছর আবার ভরাট হয়ে যায়। নতুন ধলেশ্বরীর অফটেক হতে প্রায় ৪০ কিলোমিটার ভাঁটি পর্যন্ত দৈর্ঘ্যে পলি ভরাটের পরিমাণ অত্যাধিক। এছাড়া প্রকল্পের অগমেন্টশন রুট (বাস্তবায়ন এলাকা) বরাবর পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার ২২ সেতু রয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত এসব সেতুর ফলে প্রকল্পটির সুফল মেলেনি। তবে সেতুগুলোর বিষয়ে প্রতিবেদনে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। সূত্র জানায়, যমুনা নদী হতে পানি ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগের মধ্য দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে সরবরাহ করার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেয়া হয় ২০১০ সালের এপ্রিলে। ‘বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার (নতুন ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম)’ শীর্ষক এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৯৪৪ কোটি টাকা। ৫ বছর মেয়াদী (ডিসেম্বর, ২০১৪ পর্যন্ত) প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল শুষ্ক মৌসুমে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করে নাব্য বজায় রাখা, পানির গুণগত মান বৃদ্ধি, নৌ চলাচল অব্যাহত রাখা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। খনন কাজ শেষ না হওয়ায় পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর (ডিসেম্বর, ২০১৫) বাড়ানো হয়। কিন্তু অর্থের সংস্থান না থাকায় অবাস্তবায়িত অবস্থায় শেষ হয় প্রকল্পের মেয়াদ। এখন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বলছে, যে উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল, উপরে উল্লিখিত কারণগুলোর জন্য বাস্তবায়নে যথাযথ অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। অথচ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাধিকারভুক্ত প্রকল্পগুলোর অন্যতম। নদী সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ নদীতে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ ছিল অপরিকল্পিত। সেতুগুলো নির্মাণের সময় নদীর কথা ভাবা হয়নি। রাজধানী ঢাকার পাশ দিয়ে প্রবাহিত একসময়ের প্রমত্তা বুড়িগঙ্গা এখন দখলে-দূষণে অস্তিত্ব সঙ্কটে। সম্প্রতি নদী সংলগ্ন বাবুবাজার, পোস্তগোলা, শ্মশানঘাট, ওয়াইজঘাট, কেরানীগঞ্জ প্রভৃতি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীর পাড়ে ইট রাখা হয়েছে স্তূপ করে। আর পুরো নদীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশনের অসংখ্য পাইপ এসে পড়েছে বুড়িগঙ্গার বুকে। এই পাইপগুলো বেশির ভাগই নদীর আশপাশের শিল্প কারখানার। আবাসিক ঘরবাড়ির পয়ঃনিষ্কাশনের বোঝাও বইতে হচ্ছে বুড়িগঙ্গাকে। তবে কেবল ব্যক্তি নয়, ঢাকা ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্যরে লাইন-পাইপও পড়েছে নদীর বুকে। নদীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে টংঘর ও একাধিক ধর্মীয় উপাসনালয়। নদীর পাড় দখল করে দেদার চলছে বালু, কাঠ বিক্রির রমরমা ব্যবসা। গতবছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাস্টারপ্ল্যান তৈরির মাধ্যমে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার সব নদী উদ্ধার ও পুনঃখনন এবং দখলমুক্ত করার নির্দেশ দেন। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, ঢাকা ওয়াসা, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার নানা উদ্যোগ রয়েছে বুড়িগঙ্গাকে দখল-দূষণ মুক্ত করার। কয়েক হাজার কোটি টাকার এসব উদ্যোগের মাধ্যমে নতুন ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ নদী পুনঃখনন করার কাজ চলছে। বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকা মহানগরীর চারপাশে বহমান নদীগুলোতে পানিপ্রবাহ বজায় রাখার লক্ষ্যেই এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে সব উদ্যোগের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারীভাবে বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন স্থানে নির্মিত ২২ সেতু। অপরিকল্পিত ও সম্ভাব্যতা যাচাইবিহীন নির্মিত এসব সেতুর ফলে পুনঃখনন কার্যক্রম সম্ভব হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে নগর গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি ড. নজরুল ইসলাম বলেন, পরিকল্পিত নগরায়ণ না হলে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। বুড়িগঙ্গার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সেতু নির্মাণসহ নগরীর প্রতিটি নির্মাণ কাজেই সম্ভাব্যতা যাচাই করে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া উচিত। সূত্র জানায়, প্রকল্পটির আওতায় শেষ পর্যন্ত সম্পাদিত কাজ, উৎস মুখে নতুন ধলেশ্বরী নদী খনন, প্রয়োজন অনুযায়ী রক্ষণাবেক্ষণ ও ড্রেজিং, ফিজিক্যাল মডেল স্টাডিসহ বিভিন্ন সমীক্ষার সংস্থান রেখে সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এতে মেয়াদ ধরা হয় ২০১০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। এ পর্যায়ে প্রকল্পের ব্যয় ১৮০ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। এরই মধ্যে একনেক প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছে। এখন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, বুড়িগঙ্গার অনেক স্থানেই এক মৌসুমে পুনঃখনন কার্যক্রম চালানোর পরের বছর পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। এমন অবস্থায় ৪০ কিলোমিটার এলাকায় একই মৌসুমে পুনঃখনন কার্যক্রম চালানো দরকার। সরকারের দেয়া ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা এক্ষেত্রে অপ্রতুল। এক্ষেত্রে চীনা সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা এ উদ্যোগের সফলতা এনে দিতে পারে বলে মনে করে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পুনঃখনন ও পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গার নাব্য বৃদ্ধির প্রকল্পটি বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বেশ জটিল। মানুষের তৈরি বাধার সঙ্গে রয়েছে প্রাকৃতিক বৈরী আচরণও। বাংলাদেশের অপ্রতুল প্রযুক্তিগত সুবিধা, বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ জনবলের ঘাটতি হাজার কোটি টাকায় নদী পুনঃখননের এ উদ্যোগের সফলতার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন অবস্থায় বুড়িগঙ্গাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে চীনা সহযোগিতা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি দরকার কারিগরি সহযোগিতাও। চীনা প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞ, দক্ষ জনবল এক্ষেত্রে বুড়িগঙ্গাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে। এ প্রকল্পের বাস্তবতা তুলে ধরে এক চিঠিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চীনা কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা পাওয়ার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে অনুরোধ জানিয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান বলেন, বুড়িগঙ্গার পুনঃখনন কাজ চলছে। এ জন্য বাড়তি অর্থ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে চীনা অর্থ আমাদের জন্য সহায়ক হতে পারে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কাছে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। প্রকল্প ঠিকমতো বাস্তবায়িত হলে বুড়িগঙ্গা তার আদি রূপ ফিরে পাবে বলে তিনি জানান। এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) উপ-সচিব ড. এ কে এম মতিউর রহমান জানান, বুড়িগঙ্গা পুনঃখননে চীনা সহযোগিতার সংক্রান্ত একটি চিঠি এসেছে। এ বিষয়ে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×