ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুই সন্তান হত্যার পর মায়ের আত্মহত্যা ॥ আর্থিক অনটন দাম্পত্য কলহের পরিণতি

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১২ জানুয়ারি ২০১৭

দুই সন্তান হত্যার পর মায়ের আত্মহত্যা ॥ আর্থিক অনটন দাম্পত্য কলহের পরিণতি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ পারিবারিক অশান্তির সূত্র ধরেই মিরপুরে দুই সন্তানকে বটি দিয়ে গলা কেটে হত্যার পর মা ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। মর্মান্তিক এ ঘটনার মূল কারণ আর্থিক অভাব বলে অনেকটাই নিশ্চিত তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। আদরের সন্তান হত্যার পর যন্ত্রণা সইতে না পেরে গর্ভধারিণী মা নিজেও শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেন। প্রেমের বিয়ের এমন পরিণতি সিনেমার কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। এ ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগে আনিকার মা বাদী হয়ে দারুস সালাম থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় মেয়ের জামাই শামীম হোসেনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। পুলিশ শামীম হোসেনকে গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ডের আবেদন করে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করেছে। আজ রিমান্ডের বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করেছেন বিচারক প্রণব কুমার। স্থানীয় বাসিন্দা আবুল হোসেন (৫৭) বলছিলেন, বছর বিশেক আগের কথা। তখন শামীমের বয়স প্রায় নয় বছর। অভাবের তাড়নায় ছেলেটি ছোটদিয়া বাড়ির ঢালের বাজারে একটি সেলুনে কাজ নেয়। সেখানে অনেক দিন কাজ করে। মেসে থাকত। মেসে থাকা অবস্থায়ই আস্তে আস্তে কাজ শিখে। চোখের সামনে ছোট শামীম আস্তে আস্তে যুবক হয়ে ওঠে। বছর দশেক আগে ছোটদিয়া বাড়ি রাস্তার কাছে ভাঙ্গাড়ি ব্যবসায়ী রবিউলের বোন লাভলীর সঙ্গে শামীমের বিয়ে হয়। শামীম আগাগোড়াই একটু উদাসীন প্রকৃতির মানুষ। মাথায় বড় চুল রাখে। তা আবার মেয়েদের মতো পেছনে ঝুঁটি করে বাঁধা থাকে। এক সময় ঢোল নিয়ে বিভিন্ন মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়াত। সংসারের প্রতি খেয়াল কম। বিয়ের পরেও সেই স্বভাব পাল্টাতে পারেনি। এমন অবস্থায় স্বাভাবিক কারণেই সংসারে অশান্তি নেমে আসে। শেষ পর্যন্ত লাভলী স্বামীকে ছেড়ে চলে যায়। অন্যত্র বিয়ে করে সংসার করছে। শামীম যথারীতি বাজারের দোকানেই নরসুন্দরের কাজ করছিল। বাজারের কাছেই থাকত আত্মহত্যা করা শামীমের দ্বিতীয় স্ত্রী আনিকা (২১)। সে স্থানীয় একটি গার্মেন্টসে কাজ করত। তার পিতার নাম গেদু মিয়া। মা নাদিরা বেগম। বাড়ি নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর থানাধীন বনগ্রামে। অভাবের সংসারের ঘানি টানতে টানতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে চলে আসে ঢাকায়। বসবাস শুরু করে ছোটদিয়া বাড়ি ঢালের বাজারের একটি মেয়েদের মেসে। আনিকা নিত্য দিন সেলুনের পাশ দিয়ে গার্মেন্টে যাতায়াত করত। যাতায়াতের সূত্রধরেই শামীমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে ভাললাগা। আর ভাললাগা থেকেই প্রেম। এভাবেই কাহিনী এগিয়ে যায়। বছর দুয়েক এভাবেই দু’জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক চলে। বছর সাতেক আগে তারা বিয়ে করে। বসবাস শুরু করে ছোটদিয়া বাড়ি এলাকায়। সর্বশেষ ছোটদিয়া বাড়ির সাইদ মাস্টারের টিনশেড ২৯/১ নম্বর বাসার একটি কক্ষ মাসিক ২২শ’ টাকা ভাড়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রী বসবাস শুরু করে। সবকিছু ভালই চলছিল। দ্বিতীয় স্ত্রী দেখতে এবং আচার ব্যবহারে খুবই ভাল। সংসারে অভাব ছিল। তবে সুখের কমতি ছিল না। বড় মেয়ে শামীমা জন্ম নেয়ার আগ পর্যন্ত আনিকা গার্মেন্টসে চাকরি করেছেন। মেয়ে হওয়ার পর আর চাকরি করতে পারেননি। এরপর আব্দুল্লাহ নামের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। দুই সন্তানকে সামাল দিয়ে আনিকার আর চাকরি করা হয়নি। অন্যদিকে শামীম একার রোজগার দিয়ে কোনমতে সংসার চালাচ্ছিল। তারপরেও সংসারে অভাব থাকলেও, অশান্তি ছিল না। স্থানীয় যুবক শামীমের বন্ধু চঞ্চল জানান, সবকিছু ভালভাবেই চলছিল শামীমের। কিন্তু সব এলোমেলো করে দেয় মিরপুর থেকে গাবতলীগামী পাকা রাস্তাটি। রাস্তাটির পাশে শামীম ও তার স্ত্রীর চাকরি থেকে জমানো টাকা দিয়ে একটি সেলুন ঘর তৈরি করেছিল। রাস্তা করার কারণে সেটি ভাঙ্গা পড়ে। এরপর শামীম ১৫ হাজার টাকা ধার নিয়ে ছোটদিয়া বাড়ির নৌকা ঘাটের কাছে একটি সেলুনের দোকান ভাড়া নেয়। মাসিক ৩ হাজার টাকা ভাড়া। ভাড়ার পাশাপাশি দোকানের সিকিউরিটি মানি দিতেও কয়েক জনের কাছ থেকে শামীম ধারদেনা করে। এছাড়া থাকার ঘর ভাড়া ২২শ’ টাকা। দুই সন্তানের পেছনে প্রতি মাসে অন্তত হাজার দেড়েক টাকা খরচ ছিল। সংসার চালানোর ব্যয়। স্বামী-স্ত্রীর কাপড়-চোপড়, ঘরের আসবাবপত্রসহ অন্যান্য খরচ যোগাতে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল স্বামী। আরেক বন্ধু নুুরুল ইসলাম বলছিলেন, অভাবের সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। মাঝে মধ্যেই কথা কাটাকাটি হতো। প্রায় আট মাস আগে শামীমের স্ত্রী রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল। মাস তিনেক আগে শামীম স্ত্রী সন্তানদের ফিরিয়ে আনে। টাকার অভাবে একেবারেই দিশেহারা হয়ে পড়েছিল শামীম। সেলুনের যা রোজগার, তা দিয়ে কোনমতে সংসার চালানোও কঠিন ছিল। আর ধারের টাকার জন্য প্রতি সপ্তাহেই কিস্তি দিতে হতো। এতে করে পরিবারে অশান্তি চরম আকার ধারণ করেছিল। মূলত অভাবের কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। অভিমানে স্ত্রী দুই সন্তানকে হত্যার পর নিজেও আত্মহত্যা করে থাকতে পারে বলে মনে হয়। বাড়ির অন্য বাসিন্দারা জানান, তারা চুপচাপে ঝগড়া করত। সহজেই কেউ বুঝতে পারত না। বাড়ির মালিকের ভাড়া আদায়ের খাতা খুলে দেখা গেছে, শামীমের বাড়ি ভাড়া বাবদ ১৫ হাজার ৮শ’ টাকা বকেয়া। চলতি মাস থেকে মাসিক ভাড়া একশ টাকা বাড়িয়ে ২৩শ’ টাকা করা হয়েছে। দারুস সালাম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ফারুক-উল-আলম জানান, মর্মান্তিক এ ঘটনায় আনিকার মা বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় শামীমের বিরুদ্ধে আনিকাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগ করা হয়েছে। শামীমকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক কলহ চলছিল। ঘটনার দিন সকাল আটটার দিকে শামীম দোকান খোলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। স্ত্রীর কাছে খেতে চায়। স্ত্রী স্বামীকে বাসি ভাত খেতে দেয়। শামীম বাসি ভাত খাবে না বলে জানায়। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়। অনেকক্ষণ ঝগড়াঝাটির পর শামীম না খেয়েই দোকানে চলে যায়। পরে দোকান বন্ধ করে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের মহাসমাবেশে চলে যায়। এরপর স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ ঘরটির চৌকির ওপর থেকে শামীমা ও আব্দুল্লাহর জবাই করা লাশ ও রক্তমাখা একটি বটি জব্দ করে। আর আনিকাকে ঘরের ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচানো মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি চিঠি উদ্ধার হয়। তাতে লেখা রয়েছে, শামীম তোমার ভুলের জন্য আমি চলে গেলাম। সঙ্গে নিয়ে গেলাম ছেলে মেয়ে। আমি যেখানে থাকব- ছেলেমেয়েও সেখানেই থাকবে। তুমি ভাল থেকো। ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করতে শামীমকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বুধবার বিকেলে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গ্রামের বাড়িতে তাদের দাফন করার কথা রয়েছে।
×