ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৩৫ এলাকায় বিরোধের চিত্র

সীমানা বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানিগুলো

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১২ জানুয়ারি ২০১৭

সীমানা বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানিগুলো

রশিদ মামুন ॥ সীমানা বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানিগুলো। পল্লী বিদ্যুত সমিতির (পবিস) সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এবং ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) বিরোধ সব থেকে বেশি। বিদ্যুত বিভাগ গঠিত একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি সারাদেশের ৩৫টি এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে বিরোধের চিত্র তুলে ধরেছে। কমিটির দেয়া প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে ক্ষেত্রবিশেষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিদ্যুত বিতরণ করা হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে বিরোধে গড়ে ওঠা লাইনের কারণে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, সরকারী বিতরণ কোম্পানি নিজেদের এলাকা বৃদ্ধি করতে একে অন্যের এলাকায় অনৈতিকভাবে প্রবেশ করছে। গাছ, বাঁশ দিয়ে খুঁটি বানিয়ে গ্রামের পর গ্রামে সংযোগ দেয়া হচ্ছে। যা বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থাকে ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ করছে। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি বিতরণ কোম্পানি লাইন কেটে ফেলে অন্য কোম্পানি সংযোগ দিচ্ছে। সম্প্রতি বিদ্যুত বিভাগে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানিকে ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম না করার কঠোর নির্দেশ দেন। ভবিষ্যতে নিজেদের ইচ্ছামতো বিদ্যুত লাইন সম্প্রসারণ করলে বিদ্যুত বিভাগ কঠোর হবে বলে তিনি সতর্ক করেন। একই বৈঠকে বিদ্যুত সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে ওই এলাকার সংশ্লিষ্ট বিতরণ কোম্পানির দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। বৈঠকে বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানির প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যুত বিভাগ বলছে কোন উপজেলার বিদ্যুত ব্যবহার তিন মেগাওয়াটের কম হলে তা আরইবিকে দিয়ে দিতে হবে। ভবিষ্যতে সীমানা এলাকা জিএসআইতে নির্ধারণ করতে হবে। অনুপ্রবেশকারীদের আগামী এক মাসের মধ্যেই তাদের সরে আসার নির্দেশও দিয়েছে বিদ্যুত বিভাগ। জানা যায়, বিদ্যুত বিভাগের তরফ থেকে বারবার উদ্যোগ নেয়ার পরও সীমানা আইন মানছে না কোন বিতরণ কোম্পানি। উপরন্তু এসব বিষয়ে কোম্পানিগুলো উচ্চ আদালতে মামলা মকদ্দমা পর্যন্ত করছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে একাধিকবার এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দিলেও বিতরণ কোম্পানিগুলো তা মানছে না। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছর ২৪ মে বিদ্যুত বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে গত ৮ জানুয়ারি একটি বৈঠক করে বিদ্যুত বিভাগ। সেখানে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে দেখা যায় কমিটি ওজোপাডিকো এবং পবিস এলাকার মধ্যে ২০টি স্থান পরিবর্শন করেছে। এগুলো হচ্ছে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর পবিস-১ ও ২, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, শরীয়তপুর, মাদারীপুর এবং বরিশাল পবিস-১ ও ২। এছাড়া পিডিবি এবং পবিসের মধ্যে ১৫টি বিরোধপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করেছে। এগুলো হচ্ছে রাজবাড়ী, নওগাঁ, বগুড়া, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলছে সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ভোলা, গোপালগঞ্জ এবং শরীয়তপুরে পবিসের এলাকায় ওজোপাডিকোর মিটার লাগানো দেখাগেছে। এসব জেলায় পবিসের এলাকার জোর করে ওজোপাডিকো বিদ্যুত সংযোগ দিয়েছে। একই চিত্র খুলনা, ঝিনাইদহ, বাহেরহাট, ফরিদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, যশোর পবিস-১ এ দেখেছে কমিটি। খুলনা এবং পটুয়াখালীতে পবিসের এলাকায় পল্লীবিদ্যুতায়ন বোর্ডের এলাকায় তাদের সরবরাহ লাইনের সমান্তরালভাবে ওজোপাডিকো বিদ্যুত লাইন নির্মাণ করেছে। কমিটি যে স্বচিত্র প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে দেখা যায়, ওজোপাডিকো এলাকায়ও পবিস ঝুঁকিপূর্ণভাবে লাইন সম্প্রসারণ করেছে। খুলনার মহম্মদনগর এলাকায় ওজোপাডিকো এলাকায় পবিস ঝুঁকিপূর্ণভাবে লাইন সম্প্রসারণ করেছে। সেখানে পবিসের খুঁটি ওজোপাডিকোর সাবস্টেশনের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। কমিটি বলছে যে কোন মুহূর্তে এই লাইন সাবস্টেশনের ওপর পড়লে তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শুধু খুলনাতেই নয় যশোরের কদমতলা, সন্ন্যাসী দিঘিপাড়া যশোর ছাড়াও আরও কিছু জায়গায় পবিস ওজোপাডিকোর এলাকায় লাইন নির্মাণ করেছে। একই অবস্থা দেখা গেছে পিডিবি এবং পবিসের মধ্যে। চট্টগ্রামের শিল্প এলাকায় পবিস এবং পিডিবি উভয়ই বিদ্যুত সংযোগ দিয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পবিসের সংযোগ কেটে দিয়ে পিডিবি নতুন করে সংযোগ দিয়েছে। বড় গ্রাহকদের ক্ষেত্রে এসব ঘটনা ঘটেছে। একাধিকবার এসব নিয়ে মন্ত্রণালয় সালিশ বিচারও করেছে। কিন্তু তাতে কেউই কথা শোনেনি। কমিটি বলছে চট্টগ্রামে টি কে পেপার মিল, কনফিডেন্স সল্ট এবং কেএস সল্টকে এর আগে চট্টগ্রাম পবিস-১ বিদ্যুত সংযোগ দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে এদের পিডিবি বিদ্যুত দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে এছাড়া ময়মনসিংহ-১, ২, ৩, শেরপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং জামালপুরে পবিসের এলাকায় জোর করে পিডিবি বিদ্যুত লাইন সম্প্রসারণ করেছে। একই চিত্র রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁয়ে। এসব এলাকাতেও পিডিবি গিয়ে আরইবির লাইনের ওপর দিয়ে বিদ্যুতের তার টেনেছে। কমিটির স্বচিত্র প্রতিবেদনে দেখা যায়, বগুড়া, গাইবান্ধায় পিডিবি বাঁশ এবং গাছে বেঁধে পবিসের এলাকায় বিদ্যুত লাইন সম্প্রসারণ করেছে। আবার নাটরে পবিসের খুঁটিতেই পিডিবি নিজেদের লাইন সম্প্রসারণ করেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পল্লী বিদ্যুত সমিতিগুলোও পিডিবির বিতরণ এলাকায় নিজেদের লাইন সম্প্রসারণ করেছে। চাঁপাইনবানগঞ্জ, রাজশাহীর তানোর ছাড়াও আরও বেশ কিছু এলাকাতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে মানুষ বিদ্যুত সংযোগের জন্য দীর্ঘদিন আবেদন করার পরও বিদ্যুত পায় না। এতে করে এক কোম্পানির কাছ থেকে না পেলে মানুষ অন্য কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুত সংযোগ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিছু অসাধু কর্মকর্তা এই সুযোগে বিদ্যুত লাইন সম্প্রসারণ করে। পিডিবি এবং ওজোপাডিকোর গ্রিড সাবস্টেশনের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে আরইবিকে পৃথক সাবস্টেশন এবং কন্ট্রোলরুম স্থাপন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
×