ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ

ঈদে খাবার হোক পরিমিত ও স্বাস্থ্যসম্মত

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ৪ জুলাই ২০১৬

ঈদে খাবার হোক পরিমিত ও স্বাস্থ্যসম্মত

আর কদিন বাদেই মুসলমানদের অত্যন্ত আনন্দের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদ-উল-ফিতর। এই দিনটিতে নির্মল বিনোদন অথচ পবিত্র এক আবহে সবাই অবগাহন করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব আনন্দ উৎসব রয়েছে, আমাদের আনন্দ উৎসব হচ্ছে এই ঈদ।’ (বুখারী ও মুসলিম)। এক মাস সিয়াম সাধনার পর বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হলো ঈদ, যা ছোট-বড় সকলের অনাবিল আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হবে। উৎসবের রঙ্গিন আকাশের বর্ণিল আভা যেন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আর এতসব খুশি, হাসি আর অনাবিল আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো হরেক রকমের খাবার। ঈদকে উপলক্ষ করে ধনী-গরিব সবারই চেষ্টা থাকে নানা পদের মুখরোচক খাবারের আয়োজন। এক মাসের খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলে এদিন সবাই সকালে নাস্তার টেবিলে বসে পড়েন, মুখে দেন সেমাই, পায়েস, জর্দা, পোলাও-কোর্মাসহ আরও কত টক ঝাল মিষ্টি। নিজের বাসায় তো বটেই, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় ঘুরে ঘুরে প্রায় সারাদিনই টুকিটাকি এটা-সেটা খাওয়া হয়। এ ধরনের আয়োজন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তবে এই আনন্দের মাঝে আমাদের একটু মনে রাখা উচিত ইচ্ছেমতো খাওয়া-দাওয়ার আগে আমরা কি খাচ্ছি, কতটুকু খাচ্ছি অথবা কি খাওয়া উচিত, বিভিন্ন খাবারের প্রতিক্রিয়া কি, রোগাক্রান্ত রোগীরাইবা কি খাবেন ইত্যাদি। আসলে মূল বিষয়টি নিঃসন্দেহে খাবারের উপকরণ ও পরিমাণে। রমজানে খাবারে সংযম হোক বা না হোক, সবার লক্ষ্য থাকে ঈদের দিন সব আনন্দের সঙ্গে ভূরিভোজ করা, যেন এক মাসের খাবার একদিনেই উসুল করতে হবে। নিজের ঘরের তৈরি রকমারি খাবার তো আছেই, আবার বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গেলে অনুরোধের চাপে কমবেশি কিছু তো গিলতে হয়। ফলে চাপ কিন্তু পড়ে পেটের ওপরই। একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণে তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত খাবার খেয়ে অনেকেই হজম করতে পারেন না, বিশেষ করে বয়স্করা। ফলে পেট ফাঁপে, জ্বালাপোড়া করে, ব্যথা করে, বমি বমি ভাব হয়, বারবার পায়খানা হয়। আবার পর্যাপ্ত পানি পান না করার দরুন অনেকে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন। যদিও সাধারণভাবে কোন নির্দিষ্ট খাবার খেতে মানা নেই; কিন্তু পরিমাণ বজায় রাখাটা খুব জরুরী। এক্ষেত্রে শুরু থেকেই পরিকল্পনা থাকা দরকার। সকাল, দুপুর ও রাতের খাবার কখন, কোথায় কি খাবেন ঠিক করে ফেলুন। বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে গেলে, হোটেল-রেস্তরাঁ বা পার্কে যথাসম্ভব কম খান। পানি, সরবত, ফলের রস ও অন্যান্য তরল খাবার বেশি করে গ্রহণ করুন। এতে গুরুপাক খাবারের জন্য পেটে স্থান কমে যাবে। খাবারের মেন্যুতে স্বাভাবিকভাবেই মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি থাকে। এছাড়া পোলাও, মুরগি, গরু বা খাসির মাংস, কাবাব ইত্যাদি ঝাল খাবারও থাকে। আরও আছে চটপটি, দইবড়া কিংবা বোরহানির মতো টক খাবারও। যাদের বয়স কম এবং শারীরিক কোন সমস্যা নেই, তারা নিজের পছন্দমতো সবই খেতে পারেন এবং তাদের হজমেরও কোন সমস্যা হয় না। শুধু অতিরিক্ত না হলেই হলো। তবে অনেকে এক মাসের অনাভ্যাসের কারণে হঠাৎ খুব বেশি ঝাল, তৈলাক্ত বা ভাজাপোড়া খেলে অসুস্থ বোধ করতে পারেন। তাই সবার জন্যই খাবার হওয়া উচিত কম মসলাযুক্ত, কম তৈলাক্ত, স্বাস্থ্যসম্মত এবং ভালভাবে রান্না করা। যারা মাঝবয়সী বা বয়োবৃদ্ধ কিংবা যাদের অন্যান্য শারীরিক সমস্যা যেমনÑ ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেসার বা হৃদরোগ ইত্যাদি আছে তাদের খাবারের ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরী। ডায়াবেটিক রোগীকে অবশ্যই মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। তারা বরং টক খাবারের মাধ্যমে রসনা পূরণ করতে পারেন। সবজি বা টক ফল দিয়ে মজাদার খাবার আগেই বানিয়ে রাখুন। এগুলো আপনাকে অন্য খাবার থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবে। নেহায়েত মিষ্টি খেতে চাইলে চিনির বিকল্প দিয়ে তৈরি করে নেবেন। পোলাও বিরিয়ানি কম খাবেন, ভাত খাওয়াই ভাল। তাই বলে অতিরিক্ত খাবেন না। অতিরিক্ত খাবার অবশ্যই পরিহার করবেন। মুরগি বা গরুর মাংস খাওয়া যাবে যদি অতিরিক্ত তেল বা চর্বি না থাকে। খাবারের পরিমাণটা ডায়াবেটিক রোগীর জন্য সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বড় কথা এসব খাবার একবেলাই খাওয়া উচিত, অন্য বেলা স্বাভাবিক খেতে হবে। রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এদিন একটু বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারেন, প্রয়োজনে ডায়াবেটিসের ওষুধ বা ইনসুলিনের মাত্রা একটু বাড়াতে হতে পারে। এ ব্যাপারে ঈদের আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যাদের রক্তে কোলেস্টরেল বেশি বা উচ্চ রক্তচাপ আছে অথবা হার্টের সমস্যা আছে অথবা যারা মুটিয়ে যাচ্ছেন, তাদের অবশ্যই তেল ও চর্বি এড়িয়ে যেতে হবে। তবে চর্বি ছাড়া গরুর মাংস খাওয়া যাবে পরিমাণমতো। খাসি, কলিজা, মগজ, চিংড়ি ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। ভাজাপোড়া খাবেন না, বিশেষ করে ঘরের বাইরে। আগের দিনের বাসি মাংস জ্বাল দিয়ে খাবেন না। মিষ্টিও পরিমাণের বেশি খাওয়া যাবে না। পোলাও কম খাবেন, ভাত হলেই ভাল। ফল, ফলের রস, সালাদ ইত্যাদি বেশি করে খাবেন। বিশেষ করে খাবারের শুরুতে সালাদ খেলে অন্য খাবারের জন্য জায়গা কমে যাবে। এছাড়া টক দই খেলে উপকার পাবেন। কিডনির সমস্যা থাকলে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য যেমনÑ মাছ মাংস অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দিনে দুই টুকরোর বেশি নয়। ফল খাবার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত ঈদের আগেই। যারা আইবিএস রোগে ভোগেন তারা দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য যেমনÑ দই, মাখন, মিষ্টি, ছানা জাতীয় খাদ্য খেয়ে সহ্য করতে পারেন না, তাদের দুধ ও দুধের তৈরি খাবার এড়িয়ে চলাই উত্তম। অনেকে সালাদ খেলে সমস্যায় পড়েন, তাদেরও তা এড়াতে হবে। প্রচুর পানি পান করতে হবে, যাতে কোষ্ঠকাঠিন্য না হয়। ঈদে অতিরিক্ত খেয়ে পেট জ্বালা করা, ফাঁপা আর পেপটিক আলসার খুব সাধারণ সমস্যা। যাদের পেটের এই সমস্যা আছে তারা অতিরিক্ত ঝাল, মসলাযুক্ত খাবার পরিহার করবেন। দুইবেলা খাবার আধঘণ্টা আগে আলসারের ওষুধ যেমন ওমিপ্রাজল, ইসমিপ্রাজল, রেনিটিডিন ইত্যাদি খেয়ে নেবেন। প্রয়োজনে খাবার পর এন্টাসিড খেতে পারেন। পেট ভরে খাবেন না, গোগ্রাসে না খেয়ে সময় নিয়ে চিবিয়ে খাবেন। খাবারের সময় পানি না খেয়ে একটু পরে খাবেন। রাতে খাবার পরপরই ঘুমাতে যাবেন না, কিছুক্ষণ হাঁটা চলাফেরা করলে ভাল হয়। দুই-তিন ঘণ্টা পর ঘুমাবেন। ঈদের মধ্যে একটি সাধারণ সমস্যা হলো কোষ্ঠকাঠিন্য। রোজায় পানি, সবজি কম খাওয়া হয়, ভাজাপোড়া খাওয়া হয় বেশি। ঈদের সেই ধারা বজায় থাকে। উপরন্তু মাংস, তেল চর্বি বেশি খাওয়ায় পানির অভাব আরও বেশি দেখা দেয়। ফলে অনেকেই সমস্যায় পড়েন। তাই ঈদের আগের রাতে বা ঈদের দিন সকালে ইসবগুলের ভুসি পানিতে মিশিয়ে খেয়ে নিতে পারেন। সকালে ঈদের নামাজে যাবার আগে সেমাই পায়েসের সঙ্গে ফলের রস খেতে পারেন। এর সঙ্গে প্রচুর পানি পান করে নেবেন। ঈদের দিন দুপুর ও রাত্রে অবশ্যই সবজির একটি পদ রাখবেন। আর সকল খাবারের ফাঁকে পানি বা অন্যান্য পানীয় পান করতে ভুলবেন না। ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে হাসি, ঈদ মানে অনাবিল আনন্দ। আর খাবারে তৃপ্তি না থাকলে এ আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। ঈদে তাই সকলের জন্যই থাকে একটু অন্যরকম মজাদার খাবার। স্বাস্থ্যসম্মত, উপাদেয়, টাটকা খাবার খাওয়ায় মানা নেই। তা হতে হবে পরিমিত ও পরিকল্পিত। লেখক : ডিন, মেডিসিন ফ্যাকাল্টি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×