ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিরন নাজমুল

ছেলেবেলা থেকে বড়বেলার ঈদ

প্রকাশিত: ০৭:০০, ১ জুলাই ২০১৬

ছেলেবেলা থেকে বড়বেলার ঈদ

আসছে আপনাদের ঈদ, তাই না? পেছন ফিরে তাকালাম। দিল্লীতে স্পেন এ্যাম্বাসির লম্বা লাইন। আমার পেছনে দাঁড়ানো অর্জুন। আসামের ছেলে। দিল্লীতে যে হোটেলে আছি, সেখানে কেয়ারটেকারের কাজ করে। আমি হিন্দী ভালো জানি না। অর্জুন দোভাষীর ভূমিকায় অনেক সহযোগিতা করেছে গত দুদিন। আজও এসেছে আমার সঙ্গে। প্রশ্নটা সে-ই করল। নৈর্ব্যক্তিক জবাব দিলাম। হ্যাঁ, আজ ঈদ-উল-ফিতর। ওর বাঁকানো চেহারায় বুঝলাম, সে আমার সমব্যথী। আমি কথা বাড়ালাম না। স্প্যানিস ভিসার জন্যে আবেদনপত্র জমা দিয়ে হোটেলে চলে এলাম। দেশের বাইরে এটাই আমার প্রথম ঈদের দিন। ঈদের ধারাবাহিক আনন্দের ছন্দপতন সেই থেকে শুরু। গত এগারো বছরের প্রবাস জীবনে ঈদ-আনন্দের সেই ছন্দ আর ফিরে পাইনি। এর মধ্যে দেশে গিয়ে দুটো ঈদ করেছি। কিন্তু সেই হারানো ঈদ ফিরে আসেনি। ঈদের দিনটি ঠিকই পাচ্ছি কিন্তু আনন্দের আবহটা মন থেকে পাচ্ছি না। একজন মানুষ তার চেনা আবাস থেকে হারিয়ে গেলে, ফেলে আসা চারপাশটা বোধকরি তার জন্যে অপেক্ষা করে না। জীবনের অমোঘ নিয়মেই সেটা পাল্টে যায়। পুকুর পাড়ের যে হিজল গাছটা ফুলে ফুলে পুকুরে গালিচা সাজাতো সেটা হয়তো কেটে ফেলা হয়েছে। যে ডাকাতিয়া নদীর জলে দিনান্তর দৌড়ঝাঁপ হতো সেটা হয়তো কচুরিপানায় ঢেকে গেছে। ঈদগাহে কেনা বাঁশি, বেলুনগুলোও এখন অপরিচিত লাগে। আজকাল সেগুলো তৈরি হচ্ছে আধুনিকভাবে, ভিন্ন চেহারায়। কঞ্চির বাঁশিতে বেলুন বেঁধে ফুঁ দিলে আগের মতো করে বেঁএএএ... বেঁএএএ.. আওয়াজ দেয় না। ঈদগাহের যে আইসক্রিমঅলা তার কাঠের বাক্স বাজিয়ে আট আনা, এক টাকার আইসক্রিম বিক্রি করতো, তারও দেখা মেলে না। অভাবের সংসারে রোগে-শোকে ভুগতে ভুগতে হারিয়ে গেছে। শুয়ে আছে ঈদগাহেরই পথের পাশে। আমার মতো কেউ যখন নিজের চেনা পথঘাট ছেড়ে প্রবাসে চলে আসে, তখন সময়ের সাথে তার ফেলে আসা চারপাশটা পাল্টিয়ে যায়। কিন্তু তার কল্পনায় রেখে আসা ছবিটা পাল্টায় না। তাই একটা দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে প্রত্যাবর্তনের পর, ফেলে যাওয়া চারপাশটাকে স্মৃতির কল্পনার সাথে মেলাতে গেলে বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। প্রবাস জীবনের ফাঁকে দেশে সর্বশেষ যে ঈদ করলাম, সে দিনের একটা ঘটনা বলি। আমি ঈদগাহে নামাজ পড়তে গেছি। বৃষ্টি ছিল বলে মাঠ ছেড়ে আশ্রয় হলো মসজিদে। জায়গা কমের কারণে কাতারে দাঁড়িয়ে ঠাসাঠাসি। একজনের কনুই আরেকজনের উপরে উঠে যায়। তবুও ঈদের নামাজ হচ্ছে সাম্যের প্রতীক। আমরা কেউ কিছু মনে করি না। আমার পাশের জনের গুঁতো খেয়েও ভালো লাগলো। মনে হলো ছেলেবেলার ঈদ করছি। নামাজ শেষে আমাকে গুঁতো দেয়া ব্যক্তি আমাকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি শুরু করল। আমি কোলাকুলিতে অংশগ্রহণের পূর্ব প্রস্তুতি নেয়ারও সুযোগ পেলাম না। ভাবলাম, আমাকে গুঁতো দেয়ার অনুশোচনায় বোধকরি এতো তাড়াহুড়ো তার। আমি বললাম, ব্যাপার না। জায়গা কম চাপাচাপি হলে এমন হতেই পারে। আমি কিছু মনে করিনি। সে আমার কথা কানে নিলো না। বললো, এই ব্যাটা তোর কি স্মৃতি শক্তি গেছে? আমি বিব্রত হলাম। দুর্বলতায় আঘাত করলে মানুষ বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হয়। আমিও হলাম। আমার যে স্মৃতিশক্তি সত্যিই দুর্বল! গুঁতো দিয়েছেন ভালো কথা। তুই-তোকারি করে আমার স্মৃতি নিয়ে বাজে কথা বলছেন কেন? লোকটি বললো, আমি মোক্তার। তোর ক্লাসমেট। আমি চক্ষু গোলাকার করে তার মুখাবয়ব দেখতে লাগলাম। হ্যাঁ, আমাদের মোক্তার! চিৎকারের মতো বললাম, তোর এই হাল কেন? তোকে তো চিনতে পারছি না! বললো, দোস্ত আমার অনেক অসুখ গেছে। আমার ফুসফুসের অর্ধেকটা কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে। আমার চক্ষু স্থির হয়ে রইলো। মানে! মোক্তার জবাব দিল, অপারেশন করে কেটে ফেলা হয়েছে। ক্যান্সার হয়েছিল। এবার আমি মোক্তারকে জড়িয়ে ধরলাম। ও নির্বিকার রইলো, জড়িয়ে ধরলো না আমাকে। এবার যে বাল্যবন্ধুর এতদিন বাকি পড়ে থাকা ভালোবাসা বুঝে নেবার পালা! প্রবাসে ঈদ মানে ফেলে আসা ঈদের স্মৃতি রোমন্থন। যার কারণে আমাদের ঈদ হয় দুটো। একটা হচ্ছে, সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে মূল ঈদ। আরেকটি হচ্ছে ঈদের পরের দিন। যেদিন বাংলাদেশে ঈদ। পুরো দেশ যখন উৎসবের আনন্দে ভাসে, তখন আমরাও সে আনন্দে সামিল হই কল্পনায় ভেসে ভেসে। সেই কল্পনায় চোখে পানি জমে যায়। মায়ের মুখ মনে আসে। বাবার মুখ ছড়ানো হাসি কতো দিন দেখি না! আপনজনদের কথা মনে আসে এক এক করে। খেলার সাথীদের সহজ-সরল মুখগুলো যেন ডাকতে থাকে আমাকে। মনের ভেতরটা হু হু করে। সত্যি বলতে, বছরের প্রায় সবগুলো দিন যেমন ব্যস্ততায় কাটে, ঈদের দিনেও সেই একই রুটিন। ঈদের দিনকে অন্যান্য দিনের মতো লাগে। আলাদা কিছু মনে হয় না। বাংলাদেশে যেমন ঈদ আসার আগেই দেশজুড়ে একটা উৎসবের রব উঠে, এখানে সেটা হয় না। সরকারী ছুটি থাকে না। ঈদের নামাজ হয় মসজিদের ভেতর। কেউ হয়তো ঈদের আগের রাতে ২/৩টা পর্যন্ত কাজ করে আসে। পরে আবার সকালে ঘুমচোখে নামাজে সামিল হয়। কারও সকাল ৭টা থেকে ৯টার মধ্যে কাজে যোগ দেয়ার তাড়া থাকলে তার নামাজই পড়া হয়ে উঠে না। এক মাস সিয়াম সাধনার পর রোজার ঈদ হয়। রোজার ঈদের দিনটি সাদামাটা হলেও এক মাস সিয়াম সাধনার পর প্রথম দিনের বেলায় সেমাই বিরিয়ানি খাওয়ার একটা আনন্দ থাকে। কিন্তু কোরবানি ঈদ আসে যেন হঠাৎ করে। কোরবানির গরু ছাড়া কোরবানি ঈদ যেমন হয়। বার্সেলোনা সিটি কর্পোরেশন মূল শহরে পশু জবাইয়ের অনুমতি দেয় না। যেতে হয় শহর ছেড়ে শত কিলোমিটার দূরে। অনেকে গ্রুপ করে কোরবানি দেয়। তবে গরুর চেহারা দেখার ভাগ্য হয় না। শুধু কোরবানির মাংসটাই বাসায় চলে আসে। আমি এভাবে কোরবানি দেই না। আমার নামে বাবা দেশেই গরু কোরবানি দেন। ঈদের আগের দিন থেকে মাংসের দোকানগুলোতে গরুর মাংস কেনার ধুম পড়ে যায়। কিন্তু সেই মাংস নিত্যদিনের মাংসের মতোই। কোরবানি ঈদের আবহ থাকে না সেখানে। প্রতি ঈদেই একা একা বাসা থেকে বের হই নামাজের উদ্দেশ্যে। সাথে কেউ থাকে না। বন্ধুবান্ধব বা প্রতিবেশী কাউকে ফোন করলে পাওয়া যায় না সাধারণত। সবাই সবার অবস্থানে সুবিধামতো প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় জামাতে নামাজ পড়ে। সর্বশেষ রোজার ঈদে আমার একমাত্র ছেলে তানিমকে নিয়ে নামাজ পড়তে গেলাম। সকাল সকাল উঠে আমার গোসল, পাঞ্জাবি-পাজামা পরার ব্যস্ততা দেখে ছেলের চোখ ছানাবড়া। ছেলের বয়স সাড়ে তিন বছর। বার্সেলোনাতেই জন্ম। সুন্দর বাংলা বলতে শিখেছে। বিদেশে আমাদের সন্তানরা বাংলা বলে অনেক দেরিতে। বলেও ভাঙ্গা ভাঙ্গা। আমার ছেলের কথা শুনলেই বোঝা যায়, ওর রক্তে বাবার রক্তে মেশা কাদা মাটির ঘ্রাণ আছে। ছেলে জানতে চাইলো, বাবা কোথায় যাবে? বললাম, আব্বু, আজ আমাদের ঈদ। নামাজ পড়তে যাবো। সে আমার কথা সুন্দরভাবে বুঝেছে এমন ভাব করে বললো- ও, আচ্ছা। আমিও যাবো। আমাকে নিয়ে যাও। আমি পাঞ্জাবি পরার কাজটা বন্ধ রেখে, ছেলেকে ঝটপট তৈরি করলাম। পাজামা পাঞ্জাবি পরে দুজন রেডি। যেতে যেতে ঈদ সম্বন্ধে তার বোধগম্য হবে এমন কিছু কথা শিশুসুলভ ভঙ্গিতে বললাম। বোঝাতে চেষ্টা করলাম ঈদের মানে। ছেলে আমার হাত ধরে ঈদগাহে যাচ্ছে। মনে হলো, ছোটবেলার ঈদের সব বন্ধুকে হারিয়ে বড়বেলায় একজন ঈদের বন্ধু পেয়েছি। প্রবাসের ঈদে এই প্রথম মনে হলো আনন্দ নিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যাচ্ছি। তবে আনন্দ স্থায়ী হলো না। ছেলেকে কোলে নিয়ে ভিড় ঠেলে নামাজ পড়তে গেলাম ঠিকই কিন্তু ছেলে কিছুতেই কোল থেকে নামবে না। শক্ত করে ধরে রাখলো আমাকে। এতো মানুষ এক সাথে দেখে সে ভড়কে গেছে। কোল থেকে নামিয়ে কাতারে দাঁড় করাতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। ওর জীবনের প্রথম ঈদের নামাজ আমার ধমক খেয়ে শুরু হোক সেটা আমি চাইনি। আমি শুধু বোঝানোর চেষ্টা করলাম। সেটাও পারলাম না। নিয়ত বাঁধা হয়ে গেছে। এখন কথা বলা যাবে না। আমি এভাবেই নামাজের নিয়ত বাঁধলাম। ছেলে আমার গলায় বাঁদুর ঝোলা হয়ে আছে। পরে বাবার কষ্ট হচ্ছে দেখে আমাকে ছেড়ে দিল। আমার পাঞ্জাবি ধরে পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। জীবনের প্রথম ঈদগাহে যাবার কথা কিছুই মনে নেই আমার। হয়তো বাবার হাত ধরে এভাবেই গিয়েছিলাম ঈদের ময়দানে। আজ আবার আমার ছেলের প্রথম ঈদগাহে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কাহিনী শুরু হলো। ভবিষ্যতে একদিন হয়তো আমার ছেলের হাত ধরে অন্য কোন শিশুর পরিচয় ঘটবে ঈদের এই মহান মিলনমেলার সাথে। হাতে হাত ধরে এভাবেই সঞ্চালিত হবে ঈদের আনন্দ, এক জীবন থেকে অন্য জীবনে। হয়তো ঘটনা ও পরিস্থিতিতে সেই আনন্দের রং বা ধরণই পাল্টায় শুধু। সর্বোপরি ঈদ আমাদের আনন্দ উৎসবের প্রতীক হয়েই থাকবে, সেটা হোক দেশে কিংবা প্রবাসে।
×