ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ ॥ রেমিটেন্স ও রফতানিতে প্রভাব

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ১ জুলাই ২০১৬

ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ ॥ রেমিটেন্স ও রফতানিতে প্রভাব

এই কলাম যখন লিখছি তখন টেলিভিশনের খবরে দেখলাম ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট সংসদে পাস হয়ে গেছে। সব খবর বুঝতে পারলাম না, কী পরিবর্তন হয়েছে, কী হয়নি বাজেটে। তবে বড় খবরটি পোশাক খাতের। এই খাতের রফতানিতে উৎসে কর কাটা হবে দশমিক ৭০ শতাংশ হারে। বোঝা গেল প্রস্তাবিত করের অর্ধেকের চেয়েও কম। পোশাক কারখানার মালিকদের ‘আন্দোলন’ সফল হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপেই এটি সম্ভব হয়েছে, অর্থমন্ত্রীকে এটা ‘হজম’ করতে হয়েছে। আর কী কী প্রস্তাব তাকে ‘হজম’ করতে হয়েছে সেই খবর পাওয়া যাবে এই লেখা প্রকাশের আগেই। লিখছি আমি বুধবার রাতে। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম বলেই খবরের কাগজের খবর। একটা খবর দেখলাম করদাতাদের বিনিয়োগ সম্পর্কে। করদাতারা তাদের আয়ের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারতেন সঞ্চয়পত্রে। এতে তারা কর রেয়াত পেতেন কিছু। প্রস্তাবে এই বিনিয়োগসীমা ২০ শতাংশে নামানো হয়েছিল। কাগজে দেখলাম এটা হয়ত ২৫ শতাংশ হতে পারে। যদি হয়, তাহলে সর্বনাশের কিঞ্চিৎ রক্ষা হবে। না, ঠিক বলছি না হয়ত। কারণ ২৯ তারিখে বাজেট পাস। ৩০ তারিখ মাত্র একদিন থাকবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের। করদাতাদের মধ্যে যারা সঞ্চয়পত্র কিনবেন তারা হাতে পাবেন মাত্র একদিন। এই একদিনে কী হবে? বস্তুত সবাই ৩০ শতাংশ ধরে হিসাব করেছে সারা বছর। সেভাবে নিয়োগকর্তারা উৎসে কর কেটেছে। এখন বছর শেষে কর কাটতে হবে বেশি। অথচ সময় নেই হাতে। এতে করদাতা এবং নিয়োগকর্তা সবারই খুব অসুবিধা হবে। এটি বরাবরের একটা বড় অসুবিধা যার কোন সুরাহা হচ্ছে না। আয়কর ক্ষেত্রে প্রতি বছর যে পরিবর্তন বছরের শেষে হয় তার অনেক সুযোগ করদাতারা ধরতে পারেন না। আবার অনেক সময় করের বোঝা শেষ মাসে অর্থাৎ জুন মাসে বহন করতে হয়। এতে মধ্যবিত্তের অসুবিধে হয়। মাঝখানে একবার করহার এবং কর রেয়াত ইত্যাদি দুই বছরের জন্য বলবৎ করা হয়েছিল যাতে করদাতারা তাদের কর পরিকল্পনা (ট্যাক্স প্ল্যানিং) করতে পারে। না জানি কী কারণে ঐ ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয়। আমি বিশ্বাস করি করদাতাদের কর পরিকল্পনার সুবিধার্থে আয়করের বিষয়গুলোকে এক বছরের বেশি মেয়াদী করা উচিত। শেষ মুহূর্তের পরিবর্তনে যে অসুবিধার সৃষ্টি হয় তা এতে দূরীভূত হবে। এ কথা কী সরকার শুনবে? মনে হয় না। শত হোক মধ্যবিত্ত করদাতারা তো আর পোশাক ব্যবসায়ী নয় যে তাদের কথা সরকারকে শুনতে হবে। যে পোশাক ব্যবসায়ীদের জন্য সবাই উচ্চকণ্ঠ, তারা নিজেরা তো বটেই সেই পোশাক ব্যবসায়ীদের ‘পারফরম্যান্স’ কী? আমার সামনে একটি দৈনিক। তার খবরের শিরোনাম হচ্ছে: ‘অর্ধেকে বোনাস হয়নি বেতন নিয়েও শঙ্কা’ অল্প বোনাস নিতে বাধ্য করছে মালিক, দেওয়া হবে অর্ধেক বেতন’। এটা ঘটছে পবিত্র রমজানের ঈদের পূর্বাহ্নে যখন পোশাক খাতের ৩০-৪০ লাখ শ্রমিক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বেতন ও বোনাসের জন্য। সবার সঙ্গে তাদেরও ঈদ করতে হবে। সবার আনন্দের সঙ্গে তাদেরও আনন্দ আছে। কিন্তু প্রতিবছরের মতো এবারও পোশাক খাতের মালিকরা শ্রমিকদের তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছেন। অথচ এই মালিকরা কী সুবিধা সরকারের কাছ থেকে না পাচ্ছেন? যখন যা চাইছেন তখন তাই পাচ্ছেন। কিন্তু তারা ঠকিয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকদের। শ্রমিকদের কতভাবে ঠকানো হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন রোজার ঈদে কী তারা এই কাজটি না করে পারেন না। অন্তত সরকারের প্রতি চেয়ে। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী না চাইতেই শিল্প মালিকদের এতকিছু দেন সেই ক্ষেত্রে মালিকরা কী শ্রমিকদের এই ন্যায্য দাবিটুকুও পূরণ করতে পারেন না? বোঝাই যাচ্ছে ৩০-৪০ লাখ শ্রমিককে এবারও পবিত্র ঈদে বহুলাংশে আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে। আনন্দ এবার আরও অনেকেরই সঙ্কুচিত হবে। এর কারণ অবশ্য ভিন্ন। আমরা জানি বিগত ২৩ জুনের গণভোটে গ্রেট ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে গেছে। এটি ইউরোপ কেন সারা বিশ্বের জন্যই খুবই বড় ঘটনা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের মধ্য দিয়ে বলা হচ্ছিল বিশ্বের দেশগুলো নানা ‘গ্রুপে’ দলভুক্ত হচ্ছে। ছোট ছোট দেশ ‘ইউনিয়নে’ সংযুক্ত হচ্ছে। এটা বাণিজ্য উদারীকরণ, বিশ্বায়ন, বাজার অর্থনীতির সঙ্গে ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। সারা বিশ্ব এক হয়ে যাবে। বাণিজ্যে কোন বাধা থাকবে না। সীমান্তগুলো থাকবে নামে। কিন্তু রাষ্ট্রগুলো ‘বড় রাষ্ট্রে’ পরিণত হবে। এই ধারণার বিরুদ্ধে ব্রিটেনের (ব্রেক্সিট) গণভোট একটা বড় প্রতিবাদ। ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক বলে দিয়েছে তিনটি কথা : তারা হরেদরে অভিবাসন চায় না। এতে তাদের বেকারত্ব বাড়ছে। তাদের সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে। তারা চাকরির আউট সোর্সিংও চায় না। দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশরা ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে মহাক্ষ্যাপা। কারণ তারা বৈষম্য তৈরি করছে। ব্রিটিশরা চায় তাদের বার্ধক্যকালীন সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকুক এবং ধনীদের ওপর অধিকতর করারোপ করা হোক। মোটামুটি এর ওপর ভিত্তি করেই গণভোট যে ভোটে ব্রিটেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে না। এর প্রথম ফল অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক হয়েছে ব্রিটেনের জন্য। তাদের মুদ্রা-পাউন্ডের দাম ডলারের বিপরীতে বেশ হ্রাস পেতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামে পতন ঘটছে। সম্পত্তি ও সম্পদের মূল্যেও অবমূল্যায়ন ঘটছে। ঘটনা হচ্ছে এসব তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু আমরাও এতে জড়িয়ে যাচ্ছি। কারণ ব্রিটেনের অর্থনীতি ও ব্যবসার সঙ্গে আমরাও এখন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রথমত, ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশে প্রচুর রেমিটেন্স আসে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সেখান থেকে রেমিটেন্স এসেছে ৮১২ মিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার। এই রেমিটেন্সে এখন টান পড়বে। কারণ বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রাপকরা আগে এক পাউন্ডের বিপরীতে পেত ১১৭ টাকার মতো। এখন তারা পাবে ১০৩ টাকার মতো। এর অর্থ টাকার অঙ্কে রেমিটেন্স হ্রাস পাবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রেমিটেন্স প্রাপক পরিবারগুলো। আগের মতো সমপরিমাণ টাকা পেতে হলে ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশীদের বেশি করে পাউন্ড পাঠাতে হবে যা এত সহজ এখন হবে না। ব্রিটেনের অর্থনীতির যে ক্ষমতা নেই এখন। অন্যদিকে রফতানির বাজারও হবে ক্ষতিগ্রস্ত। পাউন্ডের দাম কমার ফলে বাংলাদেশ যে পণ্য ব্রিটেন থেকে আমদানি করে তার দাম কমবে। এখানে কিছু সাশ্রয় হবে। কিন্তু ব্রিটেন আমাদের পোশাকের অন্যতম বড় আমদানিকারক। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গ্রেট ব্রিটেনে ৩২০ কোটি ডলার মূল্যের পোশাকের রফতানি হয়। ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের মূল্য পতনের ফলে আমাদের রফতানি আয় কমার সমূহ আশঙ্কা। দ্বিতীয়ত, ব্রিটেনের ক্রেতারা এখন বাংলাদেশী রফতানিকারকদের কাছে মূল্য রেয়াত চাইতে পারে। এই দুই কারণে পোশাক ‘শিল্প’ একটা নতুন চাপের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এটা ভেবেই সম্ভবত পোশাক রফতানিতে উৎসে কর কাটার যে হার প্রস্তাব করা হয়েছিল তা থেকে সরকার সরে এসেছে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী ‘ব্রেক্সিটের’ সম্ভাব্য আরও ফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। এটা একটা নতুন ‘আপদ’। এ ধরনের ‘আপদ’ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×