ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বেগম জিয়ার ইফতারের ওয়াজ-নসিহত

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ২৯ জুন ২০১৬

বেগম জিয়ার ইফতারের ওয়াজ-নসিহত

আমাদের ছোটবেলায় বাংলাদেশে ইফতার পার্টির কোন চল্ ছিল না। না শহরে, না গ্রামে। ইফতারের সময় প্রতি বাড়িতেই অতিথি সমাগম হতো। তাদের দাওয়াত দিয়ে আনতে হতো না। তারা নিজেরাই আসতেন। এটা ছিল ইসলাম ধর্মের ভ্রাতৃত্বমূলক রীতি রেওয়াজ। রোজার ইফতারি এবং দুই ঈদে কোন মুসলমান অন্য মুসলমানকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর আনুষ্ঠানিকতা দেখাবেন না। তারা পরস্পরের বাড়িতে বিনা আমন্ত্রণে যাবেন, খাওয়া-দাওয়া করবেন, সমাজের কোন কোন সমস্যার প্রেক্ষিতে ধর্মের নির্দেশ নিয়ে আলোচনা করবেন, এটাই ছিল তখনকার রেওয়াজ। আমার বাবা ছিলেন অবিভক্ত বাংলায় কংগ্রেসের সমর্থক। রোজার ইফতারের সময় মুসলিম লীগপন্থী আত্মীয়স্বজনেরাও মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসতেন, আমরাও তাদের বাড়িতে যেতাম। পারিবারিক সমস্যা, গ্রামের সমস্যা, এমনকি দেশের সমস্যা নিয়েও সেখানে আলোচনা হতো। কিন্তু দলীয় রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হতো না। তারা বলতেন, আজ অভিন্ন মুসলমান হিসেবে তারা সমবেত হয়েছেন। এখানে দলীয় রাজনীতির বিভেদ টেনে এনে ধর্মীয় ঐক্যবন্ধন ছিন্ন করা চলবে না। প্রত্যেক মুসলমান পরস্পরের ভাই; এই নির্দেশটি আমাদের ছেলেবেলায় সকলকে মেনে চলতে দেখতাম। রাজনৈতিক বিভেদ দ্বারা ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করা হতো না। অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতায় গড়ের মাঠে যখন ঈদের নামাজ হতো, তখন একসময় প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক এবং বিরোধী দলের নেতা খাজা নাজিমউদ্দীন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তেন। নামাজ শেষে কোলাকুলি করতেন। একে অন্যকে খেজুর খাইয়ে দিতেন, ঈদের জামাত শেষ হতো। তারা রাজনৈতিক সভায় গিয়ে পরস্পরকে তুলাধুনা করতেন। এটা শুধু ধর্মের নয়, মল্লযুদ্ধেরও নীতি। দুই কুস্তিগীর মল্লযুদ্ধে নামার আগে দু’জনে পরম প্রীতির সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হন। ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে অথবা রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে যুক্ত করার পর থেকে গোটা উপমহাদেশেই ধর্মেরÑ বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের চরিত্রকে নষ্ট করে তাকে দলীয় রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করা শুরু হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকেও রাজনৈতিক ইফতার পার্টির রেওয়াজ ছিল না। মুসলিম লীগ সরকার যখন বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে) জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করে, তখন রমজান মাসে ইফতার পার্টি ডেকে তাতে প্রতিপক্ষ দল ও তার বা তাদের নেতাকে অশোভন ভাষায় সমালোচনা করতে শুরু করে। প্রকৃত ইফতার পার্টির বদলে রাজনৈতিক ইফতার পার্টির এভাবেই সূচনা। একবার ঢাকার বর্ধমান হাউসে (এখন বাংলা একাডেমি, তখন ছিল প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন) মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের ডাকা ইফতার পার্টিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে মুখ্যমন্ত্রী একজন ‘রাজনৈতিক এতিম’ (ধ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ড়ৎঢ়যধহ) এবং ‘ভারতের দালাল’ বলে গালি দেয়ায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতারা ওই ইফতার পার্টি ছেড়ে চলে আসেন। তখন থেকে ধীরে ধীরে ইফতার পার্টিগুলো দলীয় এবং রাজনৈতিক ইফতার পার্টি হয়ে ওঠে। সরকারী দল ইফতার পার্টি ডাকলে তাদের দলীয় নেতা ও সমর্থক দলগুলো তাতে যোগ দেন। বিরোধী দল অনুরূপভাবে ইফতার পার্টি দিলে তাদের দলীয় নেতা ও সমর্থক দলগুলো তাতে আসেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ইফতার পার্টি ও ঈদ রিইউনিয়ন নিয়ে এই ধরনের রাজনৈতিক খেলা অব্যাহত রয়েছে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী তখন একবার দেখা গেছে তার একপাশে ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী (সম্প্রতি প্রাণদ-ে দ-িত) এবং অন্যপাশে গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন বসে আছেন। এটাও ছিল ইফতার পার্টি। তাতে আওয়ামী লীগসহ দেশের অধিকাংশ বিরোধী দলের নেতানেত্রী যোগ দেননি। ফলে কানাঘুষা শুরু হয়ে গিয়েছিল, ড. কামাল হোসেন কি তার গণফোরামের ভগ্নাংশ নিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটে যোগ দেবেন? রাজনৈতিক ইফতার পার্টির কালচারটি এখন বাংলাদেশে জাঁকিয়ে বসেছে। আওয়ামী লীগও এখন এই কালচার অনুসরণ করছে। একদলের সঙ্গে আরেক দলের মুখ দেখাদেখি নেই। পারলে তারা চুলোচুলি করেন। কিন্তু নামে ইফতার পার্টি। ধর্মের নামে ধর্মের এই অবমাননা এখন বাংলাদেশে নিত্য চলছে। বিএনপি ঘরানার ইফতার পার্টির রাজনৈতিক চরিত্র অত্যন্ত প্রকট। পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের ইফতার পার্টিগুলোর ট্রাডিশন তারা এখনো বহন করে চলেছেন। বিএনপি ঘরানার ইফতার পার্টিতে দেশের সমস্যা, মানুষের সমস্যা, ধর্মীয় সন্ত্রাসের সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে কোন আলোচনা নেই। বেগম খালেদা জিয়া প্রতিটি ইফতার পার্টিতে হয় শেখ হাসিনা অথবা তার পুত্র সজীব জয়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালান। এগুলো যুক্তি ও তথ্যভিত্তিক সমালোচনা হলে কথা ছিল না। কিন্তু তার অধিকাংশ কথাই মিথ্যা, কুৎসা এবং মনের ঝাল মেটানো ছাড়া আর কিছু নয়। বেগম খালেদা জিয়ার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি বারবার মিথ্যা কথা বলে ধরা পড়লেও লজ্জা পান না। বলা হয় লজ্জা নারীর ভূষণ। কিন্তু তার ভূষণ নয়। “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে”, কিংবা “আওয়ামী লীগ ভারতের কাছে দেশের এক-দশমাংশ বিক্রি করে দিয়েছে”, এসব কথা নির্জলা মিথ্যা বলে ধরা পড়ার পরও তিনি লজ্জা পাননি। শিল্পী কামরুল হাসান বেঁচে থাকতে জেনারেল এরশাদের একটা কার্টুন এঁকেছিলেন। জেনারেল তখন রাষ্ট্রপতি। তাতে এরশাদকে ‘বিশ্ব বেহায়া’ আখ্যা দিয়েছিলেন। আজ তিনি বেঁচে থাকলে বেগম খালেদা জিয়ার কার্টুন এঁকে তাকে কি আখ্যা দিতেন তা জানি না। জনান্তিকে শিল্পী রনবীকে অনুরোধ জানাই, তিনি যেন বেগম জিয়ার আসল চরিত্রটি তুলে ধরে জাতিকে তার একটি পোর্ট্রটে উপহার দেন। আসল কথায় আসি। সম্প্রতি ঢাকায় এক ইফতার পার্টিতে বেগম খালেদা জিয়া কিছু ওয়াজ নসিহত করেছেন। ধর্মীয় ওয়াজ নসিহত নয়। রাজনৈতিক ওয়াজ নসিহত। সবটাই শেখ হাসিনার প্রতি গালমন্দ। রোজা রেখে এক মুসলমান অন্য মুসলমানের গীবত (নিন্দা) করতে পারে না। এটা ধর্মের বিধান। বেগম খালেদা জিয়া ধর্মের বিধান মানবেন কেন? তিনি পবিত্র রমজান মাসে রোজাই রাখেন কিনা সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। বেগম জিয়া তার প্রতিটি বক্তৃতায় শেখ হাসিনা ও তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের চরিত্র হনন করেন। হয়ত ভাবেন এভাবে গোয়েবলসের মতো রোজ ডাহা মিথ্যা বলে তিনি তার পুত্র তারেক রহমানের “পূত চরিত্র” ঢেকে রাখতে পারবেন। তিনি তা করতে থাকুন এবং লোক হাসাতে থাকুন তাতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি সাম্প্রতিক এক ইফতার পার্টিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে যে ওয়াজ নসিহত করেছেন তাতে তার মধ্যে মানসিক ভারসাম্যের অভাব ঘটেছে বলে সন্দেহ হয়। ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকায় প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন গণভোটে হেরে যাওয়ায় এবং নিজ দলের (অনেক এমপি ও মন্ত্রীরও) সমর্থন হারানোর ফলে পদত্যাগ করেছেন। তিনি গণতন্ত্রের স্বাভাবিক নিয়মই মেনেছেন। ফ্রান্সে এক সময় গণভোটে জেনারেল দ্যগলে ক্ষমতায় এসেছিলেন। আবার গণভোটে যখন দেখা গেল, ফরাসী জনগণ তাকে প্রেসিডেন্ট পদে চায় না তিনি তখন পদত্যাগ করেছেন। ব্রিটেনের সদ্য সমাপ্ত গণভোটে ক্যামেরনের ইচ্ছা জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশে বসে খালেদা জিয়ার আর তর সয়নি। তিনি শেখ হাসিনাকে ইফতার পার্টিতে বসে নসিহত করেছেন, “প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার ক্যামেরনের পদাঙ্ক অনুসরণ করা উচিত। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী পদে তার ইস্তফা দেওয়া উচিত।” কিন্তু শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে তার কোন যৌক্তিক কারণ তিনি দেখাননি। শেখ হাসিনা কোন গণভোটে হারেননি। তার কোন ইচ্ছা জনগণ প্রত্যাখ্যান করেনি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ভাল করেছে। তাহলে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে যাবেন কেন? এটা কি মামার বাড়ির আবদার নয়? বেগম জিয়া ক্ষমতায় থাকতে সংসদের একটি নয়, একাধিক উপনির্বাচনে (মাগুরাসহ) জালিয়াতি করেছেন। ১৯৯৬ সালে একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে নিজেকে জয়ী ঘোষণা করেছেন। তার বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ হয়েছে। প্রশাসনের বড় অংশ তার বিরুদ্ধে জনতার মঞ্চ করেছে। তিনি জনতার দাবি মেনে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা তার মতো জালিয়াতির নির্বাচন করেননি। তিনি তার ক্ষমতার মেয়াদ শেষে সাধারণ নির্বাচন দিয়েছেন। বিএনপি পেছনের দরোজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার লোভে সেই নির্বাচনে আসেনি। সে দোষটি শেখ হাসিনার? গত সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি স্বেচ্ছায় আসেনি, তাতে এই নির্বাচনে একটি টেকনিক্যাল ত্রুটি রয়ে গেছে। কিন্তু নির্বাচনটি অবৈধ নয়। স্বাধীনতা লাভের আগে জিম্বাবুয়েতে (তখন নাম ছিল দক্ষিণ রোডেশিয়া) অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ব্রিটিশ সরকার বৃহত্তর দল রবার্ট মুগাবের দলকে যোগ দিতে দেয়নি। সেই একতরফা নির্বাচনকে বৈধ ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার বিশপ মুজাবেওয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। সেই দৃষ্টান্তের কথা বর্তমান ব্রিটিশ নেতারা ভুলে গেছেন কি? বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনে না এসে বিএনপি জামায়াতের সাথে হাত মিলিয়ে সন্ত্রাসের পথে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল। ক্ষমতার লোভে বেগম জিয়া অসংখ্য নিরীহ মানুষকে পেট্রোল বোমা হামলায় জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছেন। অন্য কোন দেশ হলে তাকে আর্জেন্টিনার ইসাবেলা পেরনের মতো গণহত্যার দায়ে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো। তার এই বিচার না হওয়াতেই তার সাহস বেড়েছে। তিনি দাবি জানাচ্ছেন, কোন কারণ না থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। তিনি হয়ত খোয়াব দেখছেন, হাসিনা পদত্যাগ করলে তিনি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের অনুসারীদের নিয়ে বাংলাদেশে আবার ক্ষমতায় বসবেন। আবার হাওয়া ভবন হবে। আধা তালেবানতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে বাংলাদেশে। তার এই খোয়াব কোনদিন পূর্ণ হবে তা মনে হয় না। [লন্ডন, ২৮ জুন মঙ্গলবার, ২০১৬]
×