ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আল বিদা মাহে রমজান

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২৮ জুন ২০১৬

আল বিদা মাহে রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ পবিত্র কুরআন, হাদীস ও মুসলিম মহামনীষীগণের জীবনচরিত্রে রমজান মাসকে অত্যন্ত মর্যাদা দানের কথা বিবৃত হয়েছে। হাদীসের মর্ম অনুযায়ী, এ মাসের প্রতিটি নফল ইবাদতের সাওয়াব অন্য মাসের ফরজ ইবাদতের সমতুল্য। প্রতিটি ফরজ ইবাদতের সাওয়াব বৃদ্ধি করা হয় সত্তর গুণে। এসব কারণে রমজানুল মুবারকে মু’মিন মুসলমানদের ইবাদত বন্দেগীর একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখনও রমজান এলে অন্যান্য যে কোন মাসের তুলনায় মসজিদে মসজিদে মুসল্লিদের ভিড় জমে যায়। শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ পর্যন্ত মসজিদে আসা-যাওয়া করে। নিঃসন্দেহে এ এক সুখকর দৃশ্য। রমজান এলে মসজিদ আবাদ হয়, মোমবাতি আর বিজলি বাতির আলোয় উদ্ভাসিত হয় এ পবিত্র অঙ্গন। এত দিন ঈশা’র জামায়াতে যেখানে মাত্র কাতার খানেক মুসল্লি হতো, রমজানে সে ঈশা ও তারাবিহতে ভরপুর হয়ে যায় মসজিদ, এতদিন ফজরের জামায়াতে যেখানে মাত্র ইমাম, মুয়াজ্জিনসহ কিছু নামাজী শামিল হতেন, এ মাসে ফজরের জামায়াত ভরে ওঠে কাতার কাতার মুসল্লিতে। দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল তার ‘জওয়াবে শিকওয়ায়’ আজকের মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছিলেন (অনুবাদ), আজান দেয়ার প্রথা আছে, নাই বেলালী প্রাণের সারা/ফলসফা আর থাকলে কি হয়, গাজ্জালীর শিক্ষা ছাড়া/মসজিদ আজি কাঁদছে বসে, হায়! নামাজী কেউ তো নাই। হেজাজী সেই গুণে আজি গুণান্বিত কেউ তো নাহি।’ রমজানে আজকের মুসলমানরা ব্যাপকভাবে মসজিদমুখী হয়ে কবির সেই অভিযোগকে আংশিক হলেও অসত্য প্রমাণিত করে। কিন্তু এরপরও আজকের আগত মুসল্লিদের কারও কারও মধ্যে মসজিদে অবস্থানের আদবগুলো রক্ষা হয় না বলে বিভিন্ন মসজিদে ইমাম ও কমিটিকে অভিযোগ করতে দেখা যায়। মসজিদে কতিপয় মুসল্লির আদব ভঙ্গের কারণ অজ্ঞতা, অসংযম। গত ১২ রমজান নগরীর একটি মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করি। ইমাম সাহেব যথারীতি খোৎবার আগে ওয়াজ নসিহত করলেন। তারপর কমিটির একজন উঠে অত্যন্ত বিনীতভাবে কতিপয় মুসল্লির কিছু আচরণের কথা তুলে ধরলেন এবং ভবিষ্যতে সংশোধনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আমার কাছে তার এ বিনীত ভাষণ, সমস্যা চিহ্নিতকরণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী মনে হলো। যেমন তিনি তারাবীহ নামাজের পর বিতর নামাজ না পড়ে বের হতে বারণ করলেন, স্বভাবজাত চঞ্চল শিশুদের প্রতি রহম দিল হতে বললেন ইত্যাদি। আসলে আমরা মসজিদে যাই, কিন্তু এর আদব রক্ষার বিষয়টি অনেকে জানি না। আবার জানলেও কোন কোন ক্ষেত্রে মানা হয় না। অবশ্য আজকের মানুষের এ আইন ও মূল্যবোধ না মানার প্রবণতা সবখানে বেশি। পবিত্র ইসলাম ধর্মে শুধু মসজিদের, নামাজের আদব-কায়দা নয়, খানাপিনার আদব-কায়দা, মজলিসের আদব প্রভৃতি অপরূপ দর্শন ও শিক্ষা রয়েছে। আমরা যদি এ যুগে সেগুলো মেনে চলতে পারতাম, তাহলে সমাজের সৌন্দর্য ও রুচির অভাবিতপূর্ণ প্রকাশ পেত। ইসলামে মসজিদকে বলা হয় ‘আল্লাহর ঘর’, হাদীস মতে দুনিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট স্থান, জুমাকে বলা হয় গরিবের হজ। আমাদের ইতিহাসে আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের বিশ্বাস ও অনুভূতিতে এ’ইয়াকীন আজও চির জাগ্রত। এমনকি আমাদের পাশাপাশি সমাজের অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও মসজিদ সীমানা অতিক্রম করার সময় এর পবিত্রতার দিকে ভক্তিভরে খেয়াল করে অতি সতর্কতা ও নাজুকতার সঙ্গে পথ চলে। বলা হয়েছে : আল্ মু’মিনু ফিল মাসজিদে, কাস্সামাক ফিল মা’- একজন মু’মিন মুসলমান মসজিদে প্রবেশ করা মানে পানিতে মাছ থাকার মতো।’ অর্থাৎ পানি যেমন মাছের কাক্সিক্ষত ঠিকানা, তদ্রƒপ মসজিদও একজন মুসলমানের শান্তিময় ঠিকানা। এখানে মহামহিম প্রভু আল্লাহর আবদিয়াত ও আত্মতুষ্টি অর্জনই একজন মুসলমানের চূড়ান্ত লক্ষ্য। অনেকের এ চেতনার স্বল্পতা ও দৈন্য দেখা দিলে এখানে তার ‘বেচাইনী’ প্রকাশ পায়। সামাজিকতা ও নিয়ম-লজ্জা না মেনেই মসজিদ থেকে দৌড়ে এসে যেতে চায়। জুমার নামাজে শুধু ফরজ পড়ে টুপিটা পকেটে নিয়ে সুযোগ বুঝে কেটে পড়ে। তারাবীহ নামাজে শামিল হয় কিন্তু বিতর নামাজ না পড়ে চলে আসে। ইসলাম ফিকাহ মতে, বিতর নামাজ ওয়াজিব, ফরজের পরপর এর মর্যাদা, তারাবীহ নামাজের চাইতেও বেশি। যারা মসজিদে ও সমাজে আদব শিষ্টাচার সম্বন্ধে গাফিল তারাই জামায়াত অনুষ্ঠানের পেছন দিকে আলাদাভাবে গোল হয়ে বসে আড্ডা জমায়। মসজিদে আসে শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সকলে। শিশুরা স্বভাবগতভাবে একটু চঞ্চল, বাঁধনহারা। তাদের বুঝতে হবে নিয়ম ও আদব সম্পর্কে। তাদের ব্যাপারে ধৈর্য্যরেও পরিচয় দিতে হবে। তারা নেহায়েত না বুঝে কমসন হওয়ার কারণে কিছু করে বসলে তা তাৎক্ষণিকভাবে এ্যাকশনে যাওয়া আমার মতে, সমীচীন নয়। একত মসজিদ শাস্তি দানের জায়গা নয়। তদুপরি এমন কঠিন আচরণে কোমলমতি ছেলেদের মসজিদ বিমুখ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
×