ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভুল ভোট ও গণতন্ত্র -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ১৯ মে ২০১৬

ভুল ভোট ও গণতন্ত্র -স্বদেশ রায়

তুরস্কের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু এখনও বিশ্বাস করা যায়, তুরস্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বা সিভিল সোসাইটি এর পক্ষ নেবে না। কারণ, তারা কামাল আতাতুর্কের ধারাবাহিকতা, সেই আধুনিকতা এখনও রক্ষা করে। হয়ত ভোটে তারা পরাজিত হয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে বার বার এমন ভুল ভোট ও ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। যার জন্য মানুষকে অনেক বেশি দাম দিতে হয়েছে। যদিও আমরা এক ধরনের গালভরা কথা বলি, জনগণ কখনও ভোট দিতে ভুল করে না। এ কথা সব সময়ের জন্য সত্য নয়। পরিস্থিতি ও নানা কৌশল জনগণকে বিভ্রান্ত করে। যেমন সিনিয়র বুশ ও জুনিয়র বুশকে যদি আমেরিকার জনগণ নির্বাচিত না করত তাহলে হয়ত এ মুহূর্তের বিশ্ব ইতিহাস ভিন্ন হতো। অথচ এই দুই বুশের নির্বাচিত হওয়ার ফলে পৃথিবীর বাস্তবতা কী দাঁড়িয়েছে- মধ্যপ্রাচ্যে যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে এ রক্তক্ষরণ কবে শেষ হবে তা কেউ জানে না। তেলসমৃদ্ধ হওয়ার পরে যে মধ্যপ্রাচ্যের তৃতীয় জেনারেশন একটি মোটামুটি আধুনিক রাষ্ট্রের পথে পা বাড়াবে এমনই আশা ছিল ইতিহাসের। তার বদলে এখন মিডল ইস্টের রক্তক্ষরণ ইউরোপ অবধি পৌঁছে গেছে। শুধু যে ইউরোপে রক্তক্ষরণ পৌঁছেছে তা নয়, এমনকি রক্তপাত শুধু ৯/১১ এর মাধ্যমে মানুষের শরীরে নয়, আমেরিকার মনোজগতে পৌঁছে গিয়েও শেষ হয়নি। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে এই রক্তপাতের ঝা-া যারা বা যিনি হাতে নিতে পারছেন তার গতি কি এখন আমেরিকায় অপ্রতিরোধ্য নয়? এমনকি আমেরিকার মানুষ তাকে আরও বেশি গতিশীল করছে। আজ যে রিপাবলিকান প্রার্থী রক্তপাতের ঝা-া নিয়ে, ধর্মীয় অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলে, বর্ণবাদকে জাগিয়ে তুলে অপ্রতিরোধ্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছেন আমেরিকায়, তিনি তো তাঁর দলের মানুষের ভোটেই হচ্ছেন। অর্থাৎ মানুষই তাকে ভোট দিয়ে নেতা তৈরি করছে। ব্রিটেনে লেবার পার্টিকে নিউ লেবারে রূপান্তরিত করার নায়ক নীল কিনক। সে সময়ে ব্রিটেনে থেচারের এক ধরনের স্বৈরশাসনই চলছিল। কিন্তু মানুষ তার বিপরীতে কিনককে কিন্তু ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনেনি। বরং ওই কট্টর কনজারভেটিভের হাত থেকে ব্রিটেনকে রক্ষা করে গার্ডিয়ান পত্রিকাটি। জন মেজরের পতনের মূল ভূমিকা পালন করে এই পত্রিকাটি। যাক সে ইতিহাস এখানে নয়। আমাদের দেশে ১৯৯১ সালে কমিউনিস্ট নেতা সাইফুদ্দিন মানিক একটি অনেক হাল্কা শুধু নয়, অর্থহীন সেøাগান তুলেছিলেন, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব।’ খুশি হলো আর যাকে তাকে ভোট দিয়ে দিলাম, এ কখনও প্রকৃত ভোটের রাজনীতি নয়। প্রকৃত ভোটের রাজনীতিতে মানুষকে বুঝে শুনে, প্রকৃত বিচার বিশ্লেষণ করে তবেই ভোট দিতে হয়। কারণ, গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়, গণতন্ত্র একটি সংস্কৃতি, তাই যে নির্বাচন বা ভোটের ভেতর দিয়ে ওই ভূমির সংস্কৃতি জাগ্রত হবে না তা কিন্তু গণতন্ত্র নয়। আর এ বিবেচনা ছাড়া যে ভোট হয় সে ভোটও প্রকৃত অর্থে ভোট নয়। যাক এ প্রসঙ্গে গেলে লেখার আকার বেড়ে যাবে। তবে ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় সব সময় সঠিক ভোট দেয়া হয় না, মানুষ ভুল করে। এমনকি বর্তমানে আমেরিকার প্রার্থী মনোনয়ন নির্বাচনেও তা ঘটছে না। আমেরিকার বর্তমান যে সমস্যা এই সমস্যা উপলব্ধি করে যদি ভোট দিতে হয়, তাহলে এ মুহূর্তে তাদের সব থেকে ভাল প্রার্থী ডেমোক্র্যাট দলের স্যান্ডার্স। যিনি আমেরিকার জনগণের প্রকৃত সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। কিন্তু শুধুমাত্র শিক্ষিত তরুণ ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী তার পক্ষে। বাদবাকি ডেমোক্র্যাট সদস্য ও ডেলিগেটরা শুধু ব্যর্থতার বোঝা মাথায় বহনকারী নয়, দুর্নীতি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরেও হিলারির পক্ষে। এখন এ কথা স্পষ্ট না হলেও বলা যায়, যদি হিলারি প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে যে স্রোতধারার বেগে রক্তপাত ঘটাচ্ছেন ওবামা- তিনিও সে কাজই করে যাবেন। অন্যদিকে যদি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে ট্রাম্প হবেন আমেরিকার শুধু নয়, বিশ্ব ইতিহাসের অন্য আরেকজন রিগ্যান। রিগ্যান যেমন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের নাম-নিশানা দুমড়ে মুচড়ে পরিবর্তন করে দিয়ে গেছেন। দুই মেরুতে ব্যালান্সড বিশ্বকে করে দিয়ে গেছেন মেরুহীন, ভারসাম্যহীন। ট্রাম্পও তেমনি সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে দুমড়ে মুচড়ে তার রাজনৈতিক ভূগোলকেই বদলে দেবেন। এমনকি এশিয়াতে তখন মেরিটাইম নিয়ে কামানের গোলার আওয়াজও উঠতে পারে। ভারতে আজ হিন্দুত্ববাদীরা সব থেকে বড় রাজনৈতিক দল। জওয়াহেরলাল নেহরুর ভারতে এমনটি হবে তা কিন্তু কেউ আশা করেনি। মানুষই ভোট দিয়ে তাদের আজ এখানে নিয়ে এসেছে। মানুষকে এ পথে পরিচালিত করার জন্য সে দেশের বামপন্থীরা ও আরও একজন সবার শ্রদ্ধেয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। ভারতের চরিত্র ছিল একটি ডাইভারসি ফরেস্টের বা একটি নানা প্রজাতির গাছের বাগানের। নানা ফুলেই শোভিত হতো। এখন ক্রমেই একাত্মবাদী হতে চলেছে ভারত। এর ফল ভবিষ্যতে ভাল কিছু নয়। সোজা কথায় একটি বাগানে অনেক গাছ থাকলে অনেক ফুলের রং দেখা যায়, অনেক ফুলের সুবাস নেয়া যায়, অনেক ফলের স্বাদ নেয়া যায়। তাছাড়া সেটা প্রকৃতির বাগান মনে হয়। আর শুধু এক ধরনের গাছ থাকলে তাকে কিন্তু কখনই বাগান মনে হয় না। ইকো ব্যালান্সও নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের এই ভূখ-েও যে ভোট দিতে ভুল হয়নি তা কিন্তু নয়। পাকিস্তানের পক্ষে কিন্তু শুধু এই পূর্ব বাংলার মানুষেরাই ভোট দিয়েছিল। এ ছাড়া ভারতের কোন প্রদেশে কিন্তু সেদিন পাকিস্তানের দাবিদার মুসলিম লীগ জেতেনি। সেদিন পূর্ববাংলার মানুষ যদি ভোট দিতে ভুল না করত, তাহলে কিন্তু ভারতের ইতিহাস ভিন্ন হতো। হয় আমেরিকার মতো ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামো হতো- না হয় ভাষাভিত্তিক জাতিগতভাবে অনেকগুলো স্বাধীন রাষ্ট্র হতো। আর তা সম্ভব হতো বিনা রক্তপাতে। কিন্তু তার বদলে সেদিনের সেই ভুল ভোটের কারণে ’৪৬ ও ’৪৭-এ লাখ লাখ মানুষের প্রাণ দিতে হয়েছে, কোটি কোটি মানুষকে হতে হয়েছে গৃহহীন। কলকাতার রেল লাইনের ধার, পাঞ্জাবের বস্তি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, সৈয়দপুরে আটকে পড়া পাকিস্তানীদের অবস্থা যেন ওই ভুল ভোটের সাক্ষী হয়ে এখনও মানুষকে, নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে দেয় যে, ইতিহাসে কতবড় ভুল হয়। এরপরে বাংলাদেশে সব থেকে বড় ভুল হয়েছে ১৯৯১ সালে ভোটের রাজনীতিতে বিএনপিকে জেতানো। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট সেদিন বিএনপি পায়নি। কিন্তু আসনভিত্তিক এক ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সেদিন বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ায় বাংলাদেশের যে কী ক্ষতি হয়েছে তা ভবিষ্যতের গবেষকরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারবেন। তবে সেদিন যদি প্রগতিশীল ৮ দলীয় জোট ক্ষমতায় আসত, মানুষ যদি ভোট দিতে ভুল না করত, তাহলে আজ এ দেশের চরিত্র ভিন্ন থাকত। ১৯৯১ সালে মানুষ বিএনপিকে ভোট দেয়ার ফলে, এরশাদকে ভোট দেয়ার ফলে- শুধু যে দেশের চরিত্র বদলে গেছে তা নয়, দেশকে বদলাবে দেশকে প্রগতির পথে নিয়ে যাবে যে রাজনৈতিক শক্তি বা দলগুলো তাদের চরিত্রও বদলে গেছে। ১৯৭৫-এর পনেরো আগস্টের কালো অধ্যায়ের পরেও যে একটি সৎ ও শতভাগ বাঙালী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারা বাংলাদেশে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিল, তা কিন্তু সত্তরভাগ শেষ হয়ে যায় ১৯৯১-এর নির্বাচনে জামায়াত ও বিএনপি জেতার ভেতর দিয়ে। আজ দেশ যে মৌলবাদে আক্রান্ত, মুক্তচিন্তা যে চাপাতির নিচে, অদ্ভুত আঁধারে যে দেশ ছেয়ে আছে, অন্ধরাই যে আজ সব থেকে বেশি দেখতে পায় এর সূত্রপাত ওই ’৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের জেতার ফল। এর পরে ১৯৯৬-তে যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে ওই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ’৯১ পূর্ববতী আওয়ামী লীগের অনেক পার্থক্য। যেমন ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে নিয়ে জয় প্রকাশ নারায়ণ ও বামপন্থীরা ইন্দিরাকে হটানোর পরেও ইন্দিরা ফিরেছিলেন ঠিকই কিন্তু তার নির্মম মৃত্যুর পরে তার ছেলে রাজীব গান্ধীকে কপালে সিঁদুর পরে নির্বাচনী প্রচারে নামতে হয়েছিল এক পর্যায় গিয়ে। অন্যদিকে ২০০১-এ আওয়ামী লীগকে আবার তথাকথিত নির্বাচনের ভেতর দিয়ে হটানো হয়। এই নির্বাচনকে বুশ ও আলগোরের নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করা যায়, একদিকে মিডিয়া ক্যু, অন্যদিকে বিচারালয়ে বসে বিচারপতিরা আলগোরকে পরাজিত করে আর বাংলাদেশে সাবেক বিচারপতিরা ক্ষমতায় বসে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে, সঙ্গে থাকে মিডিয়া ক্যু। ২০০১-এর ওই নির্বাচন পরবর্তী এথনিক ক্লিনজিং কিন্তু বাংলাদেশকে একটি ডাইভারসি ফরেস্টের বদলে একক গাছের বাগান তৈরির পথ করে দেয়। হিন্দু নির্যাতন এমন মাত্রায় শুরু হয় যা গোটা বিশ্বের নজর কাড়ে। তবে তার থেকেও বড় ক্ষতি হয় ওই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় এসে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের সোস্যাল ও মেন্টাল ডেমোগ্রাফি বদলে দেয়ার কাজ শুরু হয় প্রবল বেগে। যে ধারা গত সাত বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেও কমাতে পারেনি। বরং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের শুধু নয়, সমর্থকদের একটি বড় অংশের মেন্টাল ডেমোগ্রাফি বদলে গেছে। তাদের অনেকের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতের মেন্টাল ডেমোগ্রাফির কোন পার্থক্য নেই। তাছাড়া আওয়ামী লীগকে এখন এই বদলে যাওয়া সোস্যাল ও মেন্টাল ডেমোগ্রাফির সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে আপোস করানোর চেষ্টা করতে হচ্ছে বাঙালীর মেন্টাল ডেমোগ্রাফিকে বা বাঙালী সংস্কৃতির নির্যাস থেকে উৎপত্তি চেতনাকে। বাঙালী সংস্কৃতি ক্রমেই ক্ষীণ ধারা হয়ে যাচ্ছে। যেমন ক্ষীণ ধারা হয়ে যাচ্ছে সর্বনাশা ফারাক্কা বাঁধের কারণে প্রবহমান পদ্মা। জানি না ক্ষীণকায় পদ্মা আর ক্ষীণকায় বাঙালী সংস্কৃতির একই ভবিষ্যত কিনা? এ কারণে ভীত হতে হয় এই ভেবে- বাঙালীর সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটলে বাঙালীর রাষ্ট্রের ভবিষ্যত কি হবে? তা ভাবলে শরীর শিউরে ওঠে। সুস্থ কিছু মনে হয় না। অথচ এই ভূখ-ে ভুল ভোটের ধারাকে বদলে দিতে ১৯৭০-এ সঠিক ভোট দিয়েছিল এ দেশের মানুষ। ’৪৬-’৪৭ এর রক্তপাতের থেকে আরো মূল্য দিতে হয়েছিল রক্ত দিয়ে ওই ভোটের পরে। তার পরেও স্বাধীনতা এসে এ উপমহাদেশে অগ্রসেনা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল বাংলাদেশ। ’৭৫ এ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ভেতর দিয়ে প্রথম সূর্য অস্ত গেল। তার পরেও যে অস্তরাগটুকু ছিল তাও চলে গেল ’৯১ সালের ভুল ভোটের কারণে। তবু শেষ আশা, সংস্কৃতির নিজস্ব বা সয়ম্ভু শক্তি। আর বাঙালীর প্রাণ দেয়ার মতো প্রাণশক্তি। এই দুই মিলে আবার কোন একদিন ফিনিক্স পাখির মতো ভস্ম থেকে জেগে উঠবে। বাঙালীর সংস্কৃতির দেশ, আমাদের দেশ, ‘আমার সোনার বাংলা।’ [email protected]
×