ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তুরস্কের সমালোচনা আমলে নিচ্ছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৮ মে ২০১৬

তুরস্কের সমালোচনা আমলে নিচ্ছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি নিয়ে তুরস্কের সমালোচনাকে আমলে নিচ্ছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন। উল্টো ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোর সমালোচনা করায় সংস্থাটির সদস্য পদ পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তুরস্কের এ কে পার্টির গভীর যোগাযোগের কারণেই দেশটি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির বিরোধিতা করে আসছে। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত হওয়ার পর থেকেই তুরস্ক এই সংস্থার পদ পেতে স্বপ্ন দেখে আসছে। বেশ কয়েক বছর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদনও করেছে তুরস্ক। তবে তুরস্কের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকায় এখনও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে পারেনি দেশটি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিকাংশ দেশই মনে করে, সদস্য পদ লাভের জন্য তুরস্ক সরকারের অবস্থানে কোন পরিবর্তন আসেনি। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে হারানো ওসমানিয়া ঐতিহ্য বা সাম্রাজ্য ফিরিয়ে আনারও স্বপ্ন দেখছে বলেও তুরস্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। কেননা বর্তমান ক্ষমতাসীন জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টি) নেতৃবৃন্দ আবারও ওসমানিয়ার সাম্রাজ্যের যুগ ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। তুরস্কের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ থাকায় দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পদটি ঝুলে রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পদে আবেদন প্রার্থী হলেও নিজামীর ফাঁসি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছে তুরস্ক। নিজামীর ফাঁসি নিয়ে ইউরোপের নীরবতায় ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। তিনি ইউরোপের দ্বৈত নীতির অভিযোগ এনে কঠোর সমালোচনা করেছেন। ইস্তাম্বুলে টেলিভিশনে দেয়া এক বক্তৃতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্দেশে এরদোগান বলেছেন, ‘আপনারা যদি রাজনৈতিক মৃত্যুদ- কার্যকরের বিরোধী হন, তাহলে কেন মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- কার্যকর নিয়ে চুপ রয়েছেন, যিনি কয়েকদিন আগে শহীদ হয়েছেন। আপনারা কি ইউরোপ থেকে কী কিছু শুনছেন না? এটিকে কী আপনাদের দ্বৈত নীতি বলা যায় না?’ সূত্র জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোর সমালোচনা করায় সংস্থাটির সদস্য পদ পাওয়াটা আরও কঠিন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেননা প্রেসিডেন্ট তাইয়েপের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একে পার্টি প্রতিক্রিয়াশীল দল হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রথাগত মৃত্যুদ-ের বিরোধিতা করে এলেও নিজামীর ফাঁসি নিয়ে তুরস্কের প্রস্তাব আমলে নিচ্ছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কেননা মৃত্যুদ- নিয়ে বিরোধিতা থাকলেও যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোন বিরোধিতা নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি বিশেষ নয়, সকল ব্যক্তিরই মৃত্যুদ-ের বিরোধিতা করে সংস্থাটি। এদিকে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল একে পার্টির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর গভীর যোগাযোগ রয়েছে। দুইটি রাজনৈতিক দলই দক্ষিণপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে পরিচিত। তাদের মতাদর্শও অভিন্ন। সে কারণেই বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচার ইস্যুতে বারবার জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের পক্ষ নিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। সর্বশেষ মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- কার্যকরের প্রতিবাদে বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয় আঙ্কারা। ১৯২৮ সালে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেন হাসান আল বান্না ও সাইয়্যেদ কতুব। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদীর মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে মওদুদী জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৪০ সালে। ১৯৭৯ সালে মওদুদীর মৃত্যুর পর ব্রাদারহুডই হয়ে ওঠে তার দর্শনে বিশ্বাসী ও মতাদর্শে পরিচালিত দলগুলোর ঐক্যের প্রতীক। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে মওদুদীর মতাদর্শে বিশ্বাসী দল। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে এরা জামায়াতে ইসলামী নামে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন নামে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে। কয়েকটি দেশে ক্ষমতার শরিক হলেও সুদানে ও তুরস্কে এককভাবে ক্ষমতায় আছে তারা। এসব দলের ওপর ব্রাদারহুডের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। আধুনিক তুরস্কের জনক হিসেবে পরিচিত মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ১৯২৩ সালে ওসমানীয় খিলাফত বিলুপ্ত করেন। তিনি তুরস্ককে কঠোর ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করেন। নিষিদ্ধ হয় ধর্মভিত্তিক দল। ১৯৭০ সালে ইসলামপন্থী দল ন্যাশনাল অর্ডার পার্টি গঠিত হলে তা নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭২ সালে গঠিত ইসলামপন্থী দল ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টি ১৯৮৮ সালে নিষিদ্ধ হলে ওয়েলফেয়ার পার্টি গঠিত হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দলটি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলেও তুর্কি সেনাবাহিনী প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন আরবাকানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে দলটি নিষিদ্ধ হয়। ২০০১ সালে এরদোগান ওয়েলফেয়ার পার্টির ধর্মীয় পরিচয় ঝেড়ে ফেলে উদার ও গণতান্ত্রিক পরিচয়ের একে পার্টিতে রূপান্তর করেন। ২০০২ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে প্রধানমন্ত্রী হন এরদোগান। টানা তিন দফা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে ২০১৪ সালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হন তিনি। একে পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জামায়াতের সমর্থকে পরিণত হয় তুরস্ক। নিজামী বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী থাকাকালে দু’দফায় তুরস্ক সফর করেন। দলটির প্রায় কেন্দ্রীয় নেতাই গত এক দশকে তুরস্ক সফর করেছেন। এরদোগানও ২০১৩ সালে বাংলাদেশে এসে জামায়াত নেতাদের দীর্ঘ সাক্ষাত দেন। জামায়াত পরিচালিত বিভিন্ন দাতব্য কার্যক্রমের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আঙ্কারা। যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতেও পাকিস্তানের পরেই জামায়াতের প্রধান সমর্থক তুরস্ক। যুদ্ধাপরাধের বিচার পর্যবেক্ষণে দুই দফায় প্রতিনিধি দল পাঠায় দেশটি। জামায়াতের সুরে তুরস্ক একাধিকবার বলেছে, বিচার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়নি। নিজামীর ফাঁসি না দিতেও বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছিল তুরস্ক। জামায়াতের সংস্কার নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। দলটি এক্ষেত্রেও একে পার্টিকে অনুসরণ করছে। এরদোগান যেভাবে ধর্মীয় পরিচয় ঝেড়ে ফেলে উদারপন্থী দল গঠনের চেষ্টা করেছেন একইভাবে নতুন নামে দল গঠনের পক্ষপাতি জামায়াতের উদারপন্থীরা। তুরস্কের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ হলেও ক্ষমতাসীন একে পার্টি তা লঙ্ঘন করেছে। এই পার্টিকে নিষিদ্ধ করার জন্য আদালতে ইতোমধ্যে মামলাও হয়েছে। একে পার্টি তুরস্কে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত। আর এই রাজনৈতিক দলটির সঙ্গে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এর আগে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিচার শুরু হলে তুরস্ক থেকে একটি আইনজীবী প্রতিনিধি দলও ঢাকায় এসেছিল। তবে অন এ্যারাইভাল ভিসা নীতি লঙ্ঘন করায় তাদের ঢাকা থেকে তুরস্কে ফেরত পাঠানো হয়। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছিল। এছাড়া ২০১১ সালে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনির সঙ্গে তুরস্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক বৈঠকেও যুদ্ধাপরাধ বিচার বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল দেশটি। তবে বাংলাদেশ তার অবস্থান থেকে সরে আসবে না বলেও তুরস্ককে জানানো হয়েছিল।
×