ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হিংসা থামিয়ে মরূদ্যান কুমারিয়া

প্রকাশিত: ১৯:০১, ১৭ মে ২০১৬

হিংসা থামিয়ে মরূদ্যান কুমারিয়া

অনলাইন ডেস্ক ॥ টানটান লড়াইয়ের শেষে পরিণতি জানা যাবে দু’দিন পরেই। ফলপ্রকাশের পরে হিংসার প্রকোপ কেমন ভাবে চেপে বসবে, সেই আশঙ্কায় তটস্থ হয়ে আছে গোটা বাংলা। অথচ এর মধ্যেই শান্তির মরূদ্যান গড়ে তুলে দৃষ্টান্ত তৈরি করে ফেলেছে হাওড়ার কুমারিয়া গ্রাম! রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যা প্রায় অভাবনীয়, তা-ই করে দেখাচ্ছে আমতার রসপুর পঞ্চায়েতের এই গ্রাম। অশান্তি হলে সিপিএম নেতারা অভিযোগ জানাচ্ছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে। শাসক দলের নেতারা তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের তৎক্ষণাৎ সংযত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনছেন। কখনও আবার ঘটছে উল্টোটাও। ভোটের পরে ‘চ়়ড়াম চ়়ড়াম ঢাক’ বাজানোর হুমকি আসে যে রাজ্যে, সেখানেও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে হিংসার দৈত্যকে যে বোতলবন্দি করা সম্ভব— ভোট-পরবর্তী বাংলাকে সেই পথই দেখাচ্ছে কুমারিয়া। কুমারিয়ার গ্রামবাসীরা কেউই ভিন্ গ্রহের বাসিন্দা নন! সেখানেও তৃণমূল-সিপিএম আছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। কিন্তু রাজনীতির ভিন্ন মত যাতে ঘরে আগুন না লাগায়, সেই সারসত্য বুঝে নিয়েছেন গ্রামবাসীরা। তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন যুযুধান দুই শিবিরেরই স্থানীয় ও জেলা নেতৃত্ব। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল এক সুরে হিংসা দমনে উদ্যোগী হওয়ায় পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষেও চাপমুক্ত হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুবিধা হচ্ছে। বস্তুত, বিপদের ফুলকি দেখেই সতর্ক হয়ে গিয়েছেন এই গ্রামের মানুষ। হাওড়া জেলার ১৬টি বিধানসভা আসনে নির্বাচন হয় ২৫ এপ্রিল। তার দু’দিন আগে কুমারিয়ার দু’টি বাড়িতে আগুন লেগেছিল গভীর রাতে। র‌্যাফ নামিয়ে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছিল। ভোটের দু’দিন পরে আবার একটি খড়ের গাদায় আগুন লাগে। তখনও সিপিএম এবং তৃণমূল পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। এর পরেই দু’দলের স্থানীয় নেতৃত্ব আলোচনায় বসেন সমস্যা মেটাতে। রসপুর গ্রাম পঞ্চায়েতটি তৃণমূল-শাসিত। সিপিএম আগে এই গ্রাম পঞ্চায়েতে দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় ছিল। পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান তথা তৃণমূলের স্থানীয় নেতা জয়ন্ত পোল্যের কথায়, ‘‘সিপিএমের প্রাক্তন প্রধান আনন্দ মাজি আমাকে ফোন করে জানান, গ্রামে অশান্তি এখনই দমন করা না গেলে ভবিষ্যতে বড় বিপদ হবে। আমি তাঁদের আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিই।’’ সিপিএম নেতা আনন্দবাবুরও বক্তব্য, ‘‘বুঝতে পারছিলাম, অবিলম্বে শান্তি ফেরাতে না পারলে কোনও দলই এখানে রাজনীতি করতে পারব না। তাই জয়ন্তবাবুকে ফোন করেছিলাম। তিনি শান্তি বৈঠকের কথা বলেন, আমরা তা মেনে নিই।’’ হাওড়া গ্রামীণ জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, এই উদ্যোগের কথা জানতে পেরে তাঁরা দু’দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। পুলিশের মধ্যস্থতায় ৭ মে আমতা থানায় বৈঠকে ঠিক হয়, কোনও অশান্তির খবর পেলে তৃণমূল এবং সিপিএমের স্থানীয় নেতারা প্রথমে দলীয় পর্যায়ে তা নিয়ন্ত্রণ করবেন। তাতে কাজ না হলে পুলিশকে জানানো হবে। এই ব্যবস্থায় যে কাজ হয়েছে, গ্রামে ঘুরে জানা যাচ্ছে সেটাই। এই উদ্যোগের পাশে দাঁড়িয়েই জেলা তৃণমূল নেতা তথা বিদায়ী কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, ‘‘রাজনীতি তার নিজের জায়গায় থাকুক। তা নিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীরা কেন মারপিট করবেন? দু’দলের নেতারা মিলেমিশে শান্তি বজায় রাখতে কুমারিয়া গ্রামে যা করেছেন, তা অনেককে পথ দেখাবে।’’ সিপিএমের হাওড়া জেলা সম্পাদক বিপ্লব মজুমদারের যুক্তি, ‘‘ওই গ্রামের মানুষ বিয়ে-শাদির মাধ্যমে নানা সামাজিক বন্ধনে নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ। তাঁদের সেই শক্তিই রাজনৈতিক দলগুলিকে বাধ্য করেছে শান্তি প্রয়াসে উদ্যোগী হতে। গ্রামবাসীদের মনোভাবকে সম্মান দিয়ে স্থানীয় নেতারাও শান্তি রক্ষায় সামিল হয়েছেন।’’ প্রশ্ন হল, এমন উদ্যোগ অন্যত্র হতে অসুবিধা কী? হাওড়া জেলারই জয়পুর গ্রাম পঞ্চায়েত, আমতার খোসালপুর বা বাগনানের পানিত্রাসে ভোট-পরবর্তী হিংসার অভিযোগ এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে দোষারোপও অব্যাহত। শান্তি কি তা হলে কুমারিয়াতেই আটকে? সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের মতে, ‘‘এটাই আদর্শ পদ্ধতি হওয়া উচিত। মানুষ যখন দেখবেন এই ভাবে তাঁদের ক্ষয়ক্ষতি কম হচ্ছে, তাঁরাই রাজনৈতিক দলকে বাধ্য করবেন। রাজনৈতিক দলগুলোরও উচিত সচেতন হওয়া। তবে কেউ দেখে শেখে, কেউ ঠেকে শেখে!’’ প্রায় একই কথা তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বেরও। যত দিন না তেমন ঘটছে, তত দিন কুমারিয়া মরূদ্যানই! সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×