ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বৈরী পরিস্থিতিতে সুবিধা করা যাবে না জেনেও হাইকমান্ড ভোটযুদ্ধে থাকছে;###;সরকার ও ইসির ভুলত্রুটি তুলে ধরে বোঝাতে চায় এদের অধীনে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয় ;###;দলের তৃণমূলের প্রকৃত অবস্থান যাচাই

বিএনপির কৌশল

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৬ মে ২০১৬

বিএনপির কৌশল

শরীফুল ইসলাম ॥ চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে খুব বেশি গুরুত্বও দিচ্ছে না বিএনপি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এ নির্বাচনে তেমন সুবিধা করা যাবে না এমনটিই ধরে নিয়েছে দলীয় হাইকমান্ড। তবে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলের চাপে ও তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় নেতাকর্মীদের সক্রিয় রাখতে এ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে দলটি। এছাড়া এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন ভুলত্রুটি তুলে ধরে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় সে বিষয়ে জনমত তৈরি করতে চায় বিএনপি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর উদ্দেশ্যও অনুরূপ। এদিকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে চলমান ইউনিয়ন পরিষদে অংশ নিলেও এ নির্বাচন নিয়ে ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সমন্বয় না থাকা, তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের যোগাযোগ না থাকা এবং প্রার্থী নির্বাচন সঠিক না হওয়া, অনেক জায়গায় দলীয় প্রার্থী খুঁজে না পাওয়া, দলের অনেক নেতাকর্মী মামলায় জড়িয়ে পড়া এবং বিভিন্নভাবে সরকারী দলের চাপে এ নির্বাচন থেকে তেমন সুফল পাচ্ছে না দলটি। যে কারণে এ যাবত ৪ দফায় ২ হাজার ৬৯১ ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে মাত্র ২৪৩ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি। তবে এর আগে দেশের বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের যে ধরনের সমন্বয় ছিল তা এখন দেখা যাচ্ছে না। যে কারণে কোন কোন এলাকায় ইউপি নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, এ যাবত অনুষ্ঠিত ৪ দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রতিটিতেই ব্যাপক কারচুপি এবং সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ এনেছে বিএনপি। প্রতি দফা নির্বাচনের আগে-পরে এবং নির্বাচনের দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনের অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা তুলে ধরার পাশাপাশি এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে অভিযোগ করলেও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা বলছে না দলটি। বরং শেষ পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে থাকার আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছে বিএনপি। আর বিএনপির সঙ্গে একই পথ অনুসরণ করছে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও। সূত্র মতে, চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে খুব বেশি গুরুত্বও না দিলেও নির্বাচনের ফলাফল এতটা খারাপ হবে তা ভাবতে পারেনি বিএনপি। এ বিষয়ে বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, মূলত আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এ নির্বাচনে এতটা খারাপ ফল হবে তা আমরা প্রত্যাশা করিনি। তবে এ নির্বাচনে বিএনপির কিছু দুর্বল দিকও রয়েছে। যেমন সব জায়গায় ভাল প্রার্থী দিতে না পারা, তৃণমূল পর্যায়ের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয় না থাকা এবং ২০ দলীয় জোটের নকল শরিক দল নির্বাচনের মাঠে থেকে নির্বাচনী প্রচারে অংশ না নেয়া। অবশ্য তা করার ক্ষেত্রে প্রতিকূলতাও রয়েছে। যেমন দলের অনেক নেতাকর্মী মামলায় জড়িয়ে পড়া এবং সরকারী দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা বিএনপি বা বিএনপি জোটের প্রার্থী ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের নানামুখী চাপে রাখা। এসব কারণে কোন কোন এলাকায় বিএনপির প্রার্থীও পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও যেসব এলাকায় ক্লিন ইমেজের প্রার্থী দেয়া গেছে তাদের অনেকেই চরম বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের হিসেবে ৪ দফায় ২৬৯১টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন ২৪৩। প্রথম ধাপে আওয়ামী লীগের ৪৯৪, বিএনপির ৫০ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ১০৯ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপে আওয়ামী লীগের ৪১৯, বিএনপির ৬৩ জন এবং ১১৭ ইউপিতে জয় পান স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তৃতীয় ধাপের ভোটে আওয়ামী লীগের ৩৬৬, বিএনপির ৬০ ও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন ১৩৯ ইউপিতে। চতুর্থ ধাপে আওয়ামী লীগের ৪৪০, বিএনপির ৭০ ও ১৬১ জন স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী জয় পেয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী পঞ্চম দফায় ২৮ মে ভোট গ্রহণ করা হবে ৭৩৩ ইউপিতে। আর ৬ষ্ঠ দফায় ভোট হবে ৪ জুন। অভিজ্ঞমহলের মতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিয়ে রাজনীতিতে কৌশলগতভাবে হেরে গেছে। আর এ নির্বাচনের দাবি আদায়ের মতো আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আন্দোলনের কৌশলও ছিল ভুল। তাছাড়া হঠাৎ করে টানা আন্দোলনে যাওয়াও ছিল ভুল। এভাবে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের পর দল পুনর্গঠনেও সফল হতে পারেনি বিএনপি। ১৯ মার্চ জাঁকজমকভাবে জাতীয় কাউন্সিল করেও ২ মাসে ৪ দফায় ৪২ জনকে কেন্দ্রীয় কমিটির পদ দেয়া গেলেও দলের অধিকাংশ নেতাই এখন পদহীন। তাই তারা চলমান ইউপি নির্বাচনসহ দলীয় সকল কর্মকা-েই গাছাড়া ভাব দেখাচ্ছে। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে দলকে। ইউপি নির্বাচনে খারাপ ফল করার এটিও একটি কারণ। এদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনটিকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে না নিলেও এ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন নিয়ে কোন কোন নেতা আর্থিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব নেতার নামে যে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়টি সম্প্রতি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দলের সিনিয়র নেতাদের বৈঠককালে আলোচনায় আসে। তবে খালেদা জিয়া এসব অভিযোগ শুনে বিব্রত হলেও বিষয়টি নিয়ে বেশি কথা না বলতে দলীয় নেতাদের সাবধান করে দেন। এর আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে বিএনপির আগের কমিটির সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু নির্বাহী সদস্য বেলাল আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত উত্থাপন করে তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠায় দলের একটি অংশ। এর সঙ্গে দলের সিনিয়র নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, মোঃ শাজাহানসহ আরও ক’জন নেতাও জড়িত বলে কেউ কেউ অভিযোগ উত্থাপন করে। তবে এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেন অভিযুক্তরা। এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হওয়ায় বিএনপি কিছুটা বেকায়দায় পড়ে। কারণ দলীয়ভাবে নির্বাচন হওয়ায় সরকারী দল আওয়ামী লীগ বিভিন্নভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও বিএনপি নানামুখী প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। এছাড়া এ নির্বাচনের ফলাফলকে সরকারের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাপকাঠি হিসেবে নিতে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বৈরী পরিস্থিতির কারণে ইচ্ছে করলেও বিএনপি সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচন করতে পারছে না। এছাড়া এ নির্বাচন শুরুর আগেই তৃণমূল পর্যায় থেকে বিএনপি হাইকমান্ডকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়। আর তৃণমূলের এ নিরুৎসাহ কাটাতে কেন্দ্র থেকেও বাস্তবসম্মত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় না থাকায় কোন কোন এলাকায় নির্বাচনে অংশ নিয়েও পরে বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লার একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে পরে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা এক প্রার্থী জানান, চরম বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও প্রার্থী হয়েছিলাম। কিন্তু কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে দলের পক্ষ থেকে কোন সহযোগিতা না পেয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছি। আমার মতো বিএনপি দলীয় আরও অনেক প্রার্থী ইউপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। সম্প্রতি বিএনপির এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা গণতন্ত্রের স্বার্থে এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চলমান প্রক্রিয়ায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। কিন্তু সরকার ও নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি। এ নির্বাচনে আমরা শেষ পর্যন্ত থাকব। আমরা দেখতে চাই, এই নির্বাচন কমিশন কতটা খারাপ, অযোগ্য হতে পারে। তারা রাষ্ট্র ও জনগণের সঙ্গে কতটা প্রতারণা করতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদের যে ক’টি নির্বাচন হয়েছে তাতে এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় তা প্রমাণিত হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডাঃ মোস্তাফিজুর রহমান ইরান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা নির্বাচনের জন্য নয়, আন্দোলনের অংশ হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। আমরা এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চাই বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে এটাও বোঝাতে চাই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল প্রহসন এবং সে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আমরা ভুল করিনি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, গণতন্ত্রের স্বার্থে আমরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। কিন্তু সরকার ও নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচনকে নিরপেক্ষভাবে করতে পারছে না। এ কারণে এ নির্বাচনে সংঘাত, সংঘর্ষ ও রক্তপাত হচ্ছে। আমরা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য আন্দোলন করছি। এজন্যই এ নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আবহ সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে সরকার দলীয়ভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ব্যবস্থা করেছে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বোঝাতে চায় বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের জনপ্রিয়তা কমে গেছে। কিন্তু এ নির্বাচনে যেভাবে সরকার ও নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতিত্ব করেছে তাতে প্রমাণিত হয়েছে তাদের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
×