ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শংকর লাল দাশ

লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বাংলাদেশ ॥ মৎস্য খাত

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১৫ মে ২০১৬

লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বাংলাদেশ ॥ মৎস্য খাত

মাছে-ভাতে বাঙালী। এটি বাঙালীর আবহমানকালের পরিচিতি। মাছ-ভাত ছাড়া বাঙালীর জীবন আজও অসম্পূর্ণ। কিন্তু একটা সময়ে বিশেষ করে তিন-চার দশক আগে দেশ ক্রমে মৎস্য শূন্য হয়ে পড়ার উপক্রম হয়ে পড়েছিল। মাছের চরম আক্রা দেখা দেয়। এ সুযোগে দেশের মৎস্য বাজার বিদেশী মাছের দখলে চলে যাচ্ছিল। মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত একটা বিশাল জনগোষ্ঠী বেকারত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় সরকারের সময়োপযোগী নানামুখী উদ্যোগ-আয়োজন এবং উদ্যোক্তাসহ এর সঙ্গে জড়িতদের বিভিন্ন কার্যক্রমে দেশের মৎস্য খাত আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অনেকটা নীরব-নিভৃতে মৎস্য খাত এগিয়ে যাচ্ছে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন ২০২১ সালের মধ্যে দেশ মৎস্য উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের মধ্য দিয়ে সফলতার মাইলফলক স্পর্শ করবে। পূরণ করবে বর্ধিত জনগোষ্ঠীর চাহিদা। এছাড়া, এ খাতটি রফতানিতেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্যখাতের অবদান নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মৎস্য অধিদফতরের হিসাব মতে- দেশের বর্তমান মোট জনসংখ্যার এগারো শতাংশেরও বেশি অর্থাৎ পৌনে দু’ কোটিরও বেশি মানুষ মৎস্য খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এর মধ্যে নারী রয়েছে প্রায় ১৫ লাখ। পরোক্ষভাবে জড়িত মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। দেশে নদ-নদী, খাল-বিল, প্লাবনভূমি, কাপ্তাই লেক ও সুন্দরবনের অভ্যন্তরীণ খালসহ মুক্ত জলাশয় রয়েছে ৩৯ লাখ ১০ হাজার হেক্টর। পুকুর, বাঁওড় ও চিংড়িঘেরসহ বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ হচ্ছে ৭ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর। সামুদ্রিক জলসীমা রয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এবং এর সঙ্গে রয়েছে ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল। মৎস্য খাতের জন্য এত বিশাল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ সময় তা অবহেলিত ছিল। মৎস্য অধিদফতরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে দেশে মৎস্য উৎপাদন ছিল মাত্র ৭ দশমিক ৫৪ লাখ মেট্রিক টন। অথচ ওই সময়ে দেশে মাছের চাহিদা ছিল দ্বিগুণের কাছাকাছি। এ ঘাটতি পূরণ হতো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে আসা মাছের মাধ্যমে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে মাছের উৎপাদন বাড়াতে সরকার নানা ধরনের সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করে। শুরু হয় নানামুখী গবেষণা। যা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করে মৎস্য অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কর্মীরা। এ খাতের সঙ্গে জড়িতসহ সাধারণ মানুষকেও মৎস্য উৎপাদন বাড়ানোর কর্মকা-ে উদ্বুদ্ধ করতে সরকার ব্যাপক সাফল্য লাভ করে। মৎস্য উৎপাদনকে শুধুমাত্র পরিমাণ বাড়ানোই নয়, এটি যে গ্রামীণ কর্মসংস্থানেরও অন্যতম মাধ্যম হতে পারে, তা আজ সরকারের গৃহীত নানান কর্মসূচীর কল্যাণে বহুল প্রচারিত একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে গত ১০ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবছর মৎস্য খাতে গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ হারে। পরিসংখ্যানে আরও দেখা গেছে, ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন হয়েছিল মোট ১৬ লাখ ৬১ হাজার ৩৮৪ মেট্রিক টন। পরের বছর এর উৎপাদন ৭ দশমিক ২০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৮১ হাজার ৫৭ মেট্রিক টনে। ২০০১-০২ অর্থবছরে উৎপাদন আরও বেড়ে ১৮ লাখ ৯০ হাজার ৪৫৯ মেট্রিক টনে পৌঁছে। এভাবে প্রতিবছর মাছের উৎপাদন ক্রমে বেড়ে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ২৮ লাখ ৯৯ হাজার ১৯৮ মেট্রিক টন, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৩০ লাখ ৬১ হাজার ৬৮৭ মেট্রিক টন, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮২ মেট্রিক টন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩৪ লাখ ১০ হাজার ২৫৪ মেট্রিক টন এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩৫ লাখ ৪৮ হাজার ১১৫ মেট্রিক টনে পৌঁছেছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, প্রবৃদ্ধির এ ক্রমধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০২০-২১ সালের মধ্যে মৎস্য উৎপাদন ৪৫ দশমিক ৫২ লাখ মেট্রিক টনের লক্ষ্যমাত্রা সহজেই অর্জিত হবে। ওই সময়ে বর্ধিত জনগোষ্ঠীর মৎস্য চাহিদা হবে ৪৫ দশমিক ২৮ লাখ মেট্রিক টন। বাড়তি মাছ হবে রফতানি খাতের অন্যতম সম্পদ। সাফল্যের সঙ্গে উৎপাদন বেড়ে চলার কারণে এরই মধ্যে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণ ক্ষেত্রে বিশ্বে চতুর্থ এবং বদ্ধ জলাশয়ে বিশ্বে পঞ্চম স্থান অর্জন করেছে। জাতীয় অর্থনীতিতেও মৎস্য খাতের অবদান ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলছে। ২০১৪ এর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার মতে- দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২২ দশমিক ৬০ শতাংশ হচ্ছে মৎস্য খাতের অবদান। দেশের রফতানি আয়ের দু’ শতাংশের বেশি আসে মৎস্য খাত থেকে। মানুষের খাদ্যের প্রাণিজ আমিষের ৬০ ভাগ যোগান আসে মাছ থেকে। নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রেও মৎস্য খাতের রয়েছে ব্যাপক অবদান।
×