ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কূটনৈতিক বিচক্ষণতা জরুরি

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ১৫ মে ২০১৬

কূটনৈতিক বিচক্ষণতা জরুরি

বাংলাদেশে একের পর এক যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকরের পর পাকিস্তান প্রথমে গোস্বা করেছে, তারপর বেসামাল হয়ে পড়েছে। ফলে উপর্যুপরি তাদের কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে। একাত্তরের পরাজয় তারা ভুলতে পারেনি। তার ওপর সেই কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা তাদের সহ্য হয় কী করে! কিন্তু তুরস্কের ব্যাপারটা তো তা নয়। তারা কেন পাকিস্তানের মতো আচরণ করছে! রয়টার্স তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে উদ্ধৃত করে জানায়, নিজামীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার প্রতিক্রিয়ায় তুরস্ক ঢাকা থেকে সে দেশের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অবশ্য তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাডলুর ভাষ্য ভিন্ন। তাদের ভাষায় নিজামীর ফাঁসি পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য সে দেশের রাষ্ট্রদূতকে আঙ্কারায় ডেকে পাঠানো হয়েছে। ডেকে নিয়ে যাওয়া আর প্রত্যাহার করে নেয়ার ভেতর পার্থক্য রয়েছে। তবে বাস্তবতা যাই হোক না কেন, সেটি কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ। নিজামীর ফাঁসির খবরে গভীর দুঃখ প্রকাশ করা তুরস্কের বিবৃতিটি লক্ষণীয়। এতে বলা হয়, তার এ ধরনের শাস্তি প্রাপ্য ছিল বলে তুরস্ক মনে করে না। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দ-িতদের ফাঁসি কার্যকর ঠেকাতে গত তিন বছরে বার বার বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানানোর বিষয়টি তুলে ধরে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তুরস্ক মনে করে, এ ধরনের পদ্ধতিতে অতীতের ক্ষত নিরাময় সম্ভব নয়, বরং তা আমাদের বাংলাদেশী ভাইদের মধ্যে ঘৃণা ও শত্রুতা আরও বাড়িয়ে দেবে। তুরস্ক এতখানি প্রতিক্রিয়া দেখাবে এটা কাক্সিক্ষত ছিল না। কেননা তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত সৌহার্দ্যমূলক ও বন্ধুসুলভ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই তুর্কি এবং বাঙালী জাতির সম্পর্কের অত্যন্ত শক্তিশালী ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি রয়েছে। বাঙালীসহ দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমরা তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিল। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালে তার রচিত ‘কামাল পাশা’ নামক কবিতায় কামাল আতাতুর্কের প্রতি সম্মান ও প্রশংসা জ্ঞাপন করেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুটি স্থানকে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ নামে নামকরণও করা হয়। অপরদিকে, তুর্কিরাও তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালীদের সমর্থনকে এখনও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসির সম্মেলনে তুরস্ক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ১৭৭৬ সালে ঢাকায় তুরস্ক দূতাবাস এবং ১৯৮১ সালে আঙ্কারায় বাংলাদেশের দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ এবং তুরস্ক হলো অন্যতম পারস্পরিক বাণিজ্যিক অংশীদার। এই দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক লেনদেন ১ বিলিয়ন ডলারেরও অধিক। ২০১২ সালে বাংলাদেশ এবং তুরস্ক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ওপর একটি যৌথ খসড়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ-তুরস্ক যৌথ অর্থনৈতিক কমিশন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পন্থা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনার জন্য নিয়মিতভাবে দ্বিবার্ষিক সভার আয়োজন করে চলেছে। এই তো সেদিন তুরস্কের ২৩ সদস্যবিশিষ্ট বাণিজ্যিক প্রতিনিধি দল এফবিসিসিআইয়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশের নির্মাণ ও আসবাবপত্র শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী তুরস্ক। এমন একটি বন্ধুরাষ্ট্রকে সতর্কতার সঙ্গেই মোকাবেলা করতে হবে। কূটনীতিতে আবেগের চেয়ে বুদ্ধি ও বিবেচনার প্রাধান্য থাকাই সমীচীন। তুরস্কের আচরণে সুবিবেচনার পরিচয় পাওয়া যায়নি, এটা ঠিক। কিন্তু বাংলাদেশের উচিত হবে এ ইস্যুতে বিচক্ষণতার সঙ্গে অগ্রসর হওয়া।
×