ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ হাজার অনুমোদনহীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান;###;৭৩ ভাগ এলাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ;###;৫০ থেকে ৭০ ভাগ প্লটের বাণিজ্যিক ব্যবহার

বাণিজ্যের মহানগরী ॥ নগরজীবনে যন্ত্রণা ১

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৪ মে ২০১৬

বাণিজ্যের মহানগরী ॥ নগরজীবনে যন্ত্রণা ১

রাজন ভট্টাচার্য ॥ একই ভবনে একাধিক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। আছে সুপারশপ ও বিউটি পার্লার। সেলুন। গোডাউন। ডায়াগনস্টিক সেন্টার। স্টেশনারী দোকানসহ বাণিজ্যিক অনেক কিছুই। ভবনের উপরে আবাসিক লোকজনের বসবাস। চোখ বন্ধ করে কল্পনা করলে এরচেয়েও ভয়াবহ বাস্তবতা রয়েছে গোটা রাজধানীজুড়ে। এক কথায় বললে, আবাসিক চরিত্র হারিয়েছে ঐতিহ্যের এই মহানগরী। এখন গোটা শহরেই যেন বাণিজ্য কেন্দ্র। মানুষের বসবাস আর ব্যবসায়িক যথেচ্ছ ব্যবহারের সবকিছুই মিলেমিশে যেন একাকার। পুরো শহর ঘুরেও বোঝার উপায় নেই কোনটি আবাসিক আর কোনটি অনাবাসিক এলাকা। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) বলছে, বিশ্বে বসবাস অযোগ্য নগরীর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে এই মহানগরী। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের ‘বৈশ্বিক বসবাস উপযোগিতা জরিপ-২০১২’-এর ফলাফলে বসবাসের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে অযোগ্য শহর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নাম উঠে এসেছে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারা ঢাকায় প্রাথমিকভাবে চার হাজার ৯শ’ ২০টি হোল্ডিং পাওয়া গেছে। যেগুলোতে অননুমোদিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে নগর বিশ্লেষকরা বলছেন, এর পরিমাণ অন্তত ২০ গুণের বেশি। নগরীর ৭৩ ভাগ এলাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে। সরকার বলছে, প্রথম ধাপের কার্যক্রমে অভিজাত এলাকাগুলোর অবৈধ প্রতিষ্ঠানকেই উচ্ছেদে গুরুত্ব দেয়া হবে। মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অক্টোবর মাসের মধ্যে আবাসিক এলাকার সকল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিতে হবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়া শুরু হয়েছে বলেও জানা গেছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-রেস্টুরেন্টসহ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে আরও যাচাই-বাছাই করে করণীয় ঠিক করা হবে। বিষয়টি কড়া নজরদারিতে রয়েছে উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, আমাদের তালিকায় রাজধানীর পাঁচ হাজার ৪শ’ ৮৮টি হোল্ডিংয়ের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫শ’ ৬৮টি হোল্ডিংয়ে বৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে আর অবৈধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে চার হাজার ৯শ’ ২০টি হোল্ডিংয়ে। এসব হোল্ডিং থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিতে হবে। এর বিকল্প নেই। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পর পর ছয়টি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ইতোপূর্বে ছয় মাসের সময়সীমা শেষে অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পানি, বিদ্যুত ও টেলিফোন সেবা দেয়া বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। বাসযোগ্য নগরী গড়তে কঠোর অবস্থানে সরকার ॥ বাসযোগ্য নগরী গড়তে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় সরকার ও গৃহায়ণ মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ এগিয়ে নিতে চায়। প্রশ্ন হলো কঠিন এই কাজটি কতটুকু সফল হবে। কিংবা আদৌ সফলতার মুখ দেখবে কিনা? প্রশ্ন যাই থাক রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব নগরীর আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক স্থাপনা সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে সব ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের জানান, নগর এলাকার রাস্তার পাশে আবাসিক প্লটে কোন ভবনে রেস্টুরেন্ট, বারসহ নানাবিধ বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনাজনিত সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে মন্ত্রিসভাকে তা অবহিত করা হয়েছে। সচিব বলেন, আমাদের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী আবাসিক এলাকাগুলোতে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকতে পারবে না। মন্ত্রিসভা এসব প্রতিষ্ঠানকে ছয় মাসের সময় বেঁধে দিয়েছে। ছয় মাসের মধ্যে তাদের এগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। এই সময়ের মধ্যে না সরানো হলে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে প্রশাসন এগুলো উচ্ছেদ করবে। কবে থেকে এই সময় শুরু হচ্ছে জানতে চাইলে সচিব বলেন, মন্ত্রিপরিষদে যেদিন বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে সেদিন থেকেই ছয় মাস গণনা শুরু। সচিব বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সমন্বয়ে এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গত বছরের ৮ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। দীর্ঘদিন অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা করে সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় চারটি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। এগুলো হলো আবাসিক এলাকার বাড়িগুলোতে বেসমেন্ট শুধু কার পার্কিংয়ের কাজে ব্যবহার করা হবে। অন্য কোন কাজে বেসমেন্ট ব্যবহার করা যাবে না। আবাসিক এলাকায় বারের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। এসব এলাকার রেস্টুরেন্ট, গেস্ট হাউসসহ যেসব স্থাপনা আছে, সেগুলো ছয় মাসের মধ্যে সরিয়ে নিতে হবে। আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশন যেসব ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে, সেগুলো সিটি কর্পোরেশন বাতিল করবে এবং এদের কাছ থেকে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যেসব ভ্যাট নেয়, তা আর আদায় করা হবে না। অনেক বাণিজ্যিক এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল অনুমোদন নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে, সেগুলোর কী হবে জানতে চাইলে সচিব বলেন, এগুলোর বিষয়েও এ সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য হবে। তবে এদের অন্যত্র সরানোর জন্য সময় দেয়া হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও রাজধানীর বাইরে নিজস্ব ক্যাম্পাসে চলে যাবে, এ শর্তেই অনুমোদন পেয়েছে বলে জানা গেছে। মন্ত্রণালয় মূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগই সমন্বিতভাবে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। নোটিস পাঠানো শুরু ॥ এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ধানম-ি, গুলশান, বনানী ও বারিধারার এই বাড়িগুলো আবাসিক শ্রেণীর। কিন্তু এগুলো বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই প্রথমেই এসব বাড়ির গ্যাস, বিদ্যুত ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করার বার্তা দিয়ে নোটিস পাঠানো হয়েছে। কারণ, এসব বাড়ি আবাসিক শ্রেণীর হওয়া সত্ত্বেও গ্যাস-বিদ্যুত-পানির সংযোগ নেয়া হয়েছে বাণিজ্যিক শ্রেণীর। নোটিস পাওয়া বাড়ির মালিকদের অনেকে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে জানার চেষ্টা করছেন সরকার তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কতটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সূত্র বলছে, রাজধানীর আবাসিক এলাকাগুলোর ওই সমস্যা বিবেচনা করেই সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে কিছু বাণিজ্যিক এলাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেমন, ধানম-ির ক্ষেত্রে ২ নম্বর ও ২৭ নম্বর সড়ক বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে স্বীকৃত। আবার ধানম-িকে ঘিরে মিরপুর রোড ও সাতমসজিদ রোডও বাণিজ্যিক এলাকা। সেখানে প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করতে কোন বাধা নেই। এছাড়া ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ এর ৬১-বিধিতে বলা হয়েছে, এসব অঞ্চলের আওতাভুক্ত কোন ইমারত, বসতবাড়ি, রাস্তা, গলিÑ এমনকি কোন স্থাপনা নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমতি ব্যতীত কেউ অপসারণ, সংযোজন, সংস্কার করতে পারবে না। এক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানার বসতবাড়ির ক্ষেত্রেও এই বিধি কার্যকর রয়েছে। এদিকে স্বাধীনতার পর পর ক্রমাগত ঢাকা শহরের এলাকা বাড়তে থাকায় গুলশান-বারিধারা রাজধানীর অভিজাত আবাসিক এলাকায় রূপ নেয়। রাজউকের তালিকায় এখন গুলশান, বারিধারা, বনানী, উত্তরা ও ধানম-ি আবাসিক এলাকা হিসেবে রয়েছে। কিন্তু ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের তথ্য মতে, গুলশান ও বারিধারার ৯০ শতাংশ প্লট ব্যবহার হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে, যার কোন বৈধতা নেই। আর অন্যান্য আবাসিক এলাকায়ও ৫০ থেকে ৭০ ভাগ প্লট বা ভবনই ব্যবহার হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। ছয় হাজারের বেশি অনুমোদনহীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ॥ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেন, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের আবাসিক এলাকায় অনুমোদনহীনভাবে ছয় হাজার ৫৯টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কারণে আবাসিক এলাকায় যানজটসহ বসবাসের উপযোগিতা চরমভাবে বিনষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে ডিএনসিসি এলাকায় রয়েছে পাঁচ হাজার ৩৪১টি ও ডিএসসিসি এলাকায় রয়েছে ৭১৫টি। রাজউকের তদারকি থাকলে কোনভাবেই এসব ভবন গড়ে তোলা সম্ভব হতো না। রাজউকের ব্যর্থতা বা রাজউকের কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে আবাসিক এলাকার এমন বিপর্যয় ঘটেছে। তবে আবাসিক এলাকার চরিত্র ফিরিয়ে আনতে সব প্রতিষ্ঠান মিলে আমরা শীঘ্রই কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারব বলে আশা করছি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজউক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় আজ গোটা নগরী বাণিজ্যিক কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে। এই শহরের আবাসিক, বাণিজ্যিক চরিত্র বোঝা এখন কঠিন। আবার কেউ কেউ বলছেন, নগর উন্নয়নের সঙ্গে ২০টির বেশি প্রতিষ্ঠান জড়িত। এজন্য দায় এড়াতে পারে না কেউ। তবে ভবন নির্মাণ ও আইন মানার পুরো বিষয়টি দেখভালের দায় রাজউকের। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নগর বিশেষজ্ঞ শামসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই আজকের এই পরিস্থিতি। শহরের আবাসিক বাণিজ্যিক চরিত্র এখন বোঝা যায় না। সবই একই রকম মনে হয়। তিনি বলেন, নগরীর চরিত্র বদলানোর প্রতিযোগিতা এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। ইচ্ছেমতো ভবন নির্মাণ হচ্ছে। যেখানে সেখানে হচ্ছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। কিছু আবাসিক জোন সম্প্রতি একেবারেই চরিত্র হারিয়ে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে। এমন তো কথা ছিল না। তিনি বলেন, কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ এ কাজটি করেছেন। যাদের দেখে দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হয়েছেন। হাত গুটিয়ে বসেছিল রাজউক। তারা কোন কাজ করেনি বরং অপরাধকে লালন করেছে বছরের পর বছর। এই সুযোগে সঙ্কট এখন মহামারি আকারে ছড়িয়েছে। যে কারণে মন্ত্রিপরিষদে এ নিয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। যদি রাজউক কাজের কাজটি করত তাহলে এ রকম সমস্যা এখন হতো না। গবেষকরা বলছেন, রাজউক আর সিটি কর্পোরেশনকে সমন্বয় করে নগর গড়ে তুলতে হবে। স্বাধীনতার পর এক বছরের মধ্যে সংবিধান, দুই বছরের মধ্যে পাঁচসালা পরিকল্পনা হয়। কিন্তু রাজধানী শহরের জন্য পরিকল্পনা হয়নি। ১৯৭৪ সালের মধ্যেই রাজধানীর পরিকল্পনা হওয়া জরুরী ছিল। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের সময় ১৯৫৮-৫৯ সালে তৎকালীন ডিআইটি যে নগর মহাপরিকল্পনা নেয় সেটাই ভিত্তি। এই মহাপরিকল্পনার মাধ্যমেই ঢাকা নগরী একটি কাঠামো পেয়েছিল। এর আওতায় গড়ে উঠেছিল মিরপুর রোড, ভিআইপি রোড, তেজগাঁও, ধানম-ি, মোহাম্মদপুর, বনানী, লালমাটিয়া, গুলশান, উত্তরা ও শেরেবাংলানগর। এটা না হলে এই নগরে একেবারেই বসবাস করা যেত না। এখন সমস্যা বাড়ছে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ না হওয়ার কারণেই। ১৯৯৫ সালে নেয়া পরিকল্পনা এক বছর পর ১৯৯৬ সালে অনুমোদন করা হয়। ২০১০ সালে ঢাকার ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) নামে যে পরিকল্পনাটি নেয়া হয়েছে সেটা ঢাকার স্বার্থে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। বিশিষ্ট নগরবিশেষজ্ঞ ও ঢাকা নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছেন, ঢাকা আজ শুধু রাজধানী শহরই নয়, এটি এখন শিল্প, বাণিজ্য, প্রশাসনিক ও শিক্ষার শহর। ১৯৯২ সালের পর এই শহরে গড়ে উঠেছে ৫৪টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়। হাজারো বছরের পুরনো ঢাকা এখন পৃথিবীর বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর একটি। এই নগরীকে স্বাস্থ্যসম্মত ও আধুনিক শহর করতে হলে প্রয়োজন তিন থেকে চারভাগে ভাগ করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। বাস্তবতা হলো কাজের কাজ কিছু হয়নি। দিন দিন সঙ্কট বাড়ছে। হচ্ছে ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতম। অপরিকল্পিত অবকাঠামো ৭৩ ভাগ ॥ শহর ও নগর উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা কমিশন থেকে চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী নূরুল হুদা। বুয়েটের গবেষকরা বলছেন, রাজধানী ঢাকায় গড়ে ওঠা অবকাঠামোর ৭৩ শতাংশ পুরোপুরি অপরিকল্পিত। একটি বড় সিটির জন্য মোট ভূমির প্রায় ২৫ ভাগ রাস্তা প্রয়োজন অথচ রাজধানী ঢাকা শহরে আছে ৮ ভাগের কম। প্রস্থের দিক থেকে ২০ ভাগের বেশি রাস্তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য সড়ক বাড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু রাজধানীজুড়েই স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নগর উন্নয়নের বিষয়ে সচেতনভাবে দায়িত্ব পালন না করায় অপরিকল্পিত নগরায়ন হয়েছে। জায়গা না রেখে নির্মিত হয়েছে বেশিরভাগ ভবন। বেশিরভাগ স্থাপনা হয়েছে রাস্তা ঘেঁষে। সড়ক দখল করেও ভবন নির্মাণ হয়েছে। মূল সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করতে হলে কতটুকু জায়গা রাখা প্রয়োজন, পার্কিং সুবিধা আছে কিনা, ঢাকার শহরতলি অঞ্চলগুলোতে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ সড়ক থাকা জরুরী এর কোন কিছুই দেখভাল হয়নি। আমরা উন্নত শহরের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবধান হবে অনেক বেশি। ভুলে আর অবহেলায় তৈরি এই নগরী এখন ঢেলে সাজানো কষ্টসাধ্য।
×