ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রবীণদের কাছে শব্দটি মধুময়

আম দুধের নাইওর ॥ মধুমাসে পাল্টে গেছে

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ১৪ মে ২০১৬

আম দুধের নাইওর ॥ মধুমাসে পাল্টে গেছে

ভর দুপুরে ক্যাঁকর ক্যাঁকর শব্দে শাড়ি কাপড় দিয়ে ছইয়ের সামনে পিছনে ঢাকা গরুর গাড়ি ম-লের বাড়ির সামনে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের আশপাশের বাড়ির বৌঝি ও ময়মুরব্বিরা সমস্বরে বলতে থাকে ‘কোন বাড়ির নাইরি আলো গো।’ গাড়ির জোয়াল থেকে গরু সরিয়ে ৪৫ ডিগ্রী নামিয়ে দিতেই ছইয়ের ভিতর থেকে বৌ আর ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে আসে। শুরু হয় হৈ হুল্লোর, ‘নাইওর আচ্চে গো আমদুধের নাইওর আচ্চে। ম-ল বাড়ির মেয়ে জামাই ছলপল আচ্চে।’ ততক্ষণে জামাই মিষ্টির হাঁড়ি রেখে মুরব্বিদের কদমবুচি করতে থাকে। মুরব্বিরা আশীর্বাদ করে ‘থাক বাবা থাক লাগবি ন্য। তো বাবাজি আমদুধ, আম কাঁঠাল খায়া দিনা কতেক থাকে যাবা কিন্তু।’ গ্রামের মেয়ে যে বধূরূপে শ্বশুরবাড়ি গেছে, তাকে দেখে বলে ‘মাও কোনা (মা যে) কি শুক্যে গেছে’। গ্রামের মেয়ে অনেকদিন পর বাড়িতে নাইওর এলে বাবা মা ও মুরব্বিদের ¯েœহের ও মমত্বের চোখে শুকনোই লাগে। দীর্ঘদিন পর বাড়ি এসে মেয়ের চোখ দিয়ে প্রথমে আনন্দের অশ্রু ঝরে। পরে ফেলে যাওয়া অধিকার ফের প্রতিষ্ঠিত করতে বাড়ির চারপাশটা ও ঘরের ভিতরে এক নজর দেখে বলে ওঠে ‘মা এগুলো কি হয়েছে। ওই জিনিসটি কোথায়। ঘরটি কি করে রেখেছে।’ যে বাড়ি ছেড়ে নবপরিণীতা হয়ে স্বামীর বাড়িকে আপন করতে গেছে, সেই মেয়ে নিজের বাড়ি এলে ছায়াছবির ফ্রেমের মতো একে একে সব কথা মনে পড়ে! জামাই ও ছেলেমেয়ে নিয়ে বাবার বাড়িতে মধুমাসের ক’টা দিন আম কাঁঠালের নেমতন্ন খেতে এসে রবীন্দ্রনাথের কবিতার ছন্দের মতো হয়ে ওঠে- একে একে মনে উদিত হয় মেয়েবেলার কথা। বাঙালী ঐতিহ্যের বড় একটি অধ্যায় মধুমাসের নাইওর। এই নাইওর কথাটির সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের ততটা পরিচয় নেই। আজ যারা প্রবীণ ও মধ্যবয়সী তাদের কাছে ‘নাইওর’ কথাটির সঙ্গে কি যে মধুময়তা জড়িয়ে আছে তা বর্ণনায় নয়, অনুভবে বুঝে নিতে হয়। একটা সময় গ্রামাঞ্চলে মধুমাসের এই নাইওরকে বলা হয়েছে আমদুধের নাইওর। বাঙালীর নাইওর কথাটির ভাবার্থ হলো- স্বামীর বাড়ি থেকে দীর্ঘদিন পর নারী তার ছেলে মেয়ে আর জামাইকে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে অন্তত সাত দিন বা তারও বেশি সময় অবস্থান। এই বিষয়ে বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ত্বাইফ মামুন জানালেন- নদীমাতৃক বঙ্গীয় ব দ্বীপের এই দেশে একটা সময় নৌকায় (নাও) করে মেয়েরা দীর্ঘদিন পর বাপের বাড়ি যেত। নাও থেকে নাইওর কথাটির উৎপত্তি, এমনটি ধারণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে পথঘাট উন্নত হলে গরুর গাড়ি মোষের গাড়ি চেপে মেয়ে বাপের বাড়িতে গেলেও নাইওর কথাটি অপরিবর্তিত থেকে যায়। এই নাইওরের উপযুক্ত সময় বৈশাখ জৈষ্ঠ্যের মধুমাসে। আম কাঁঠালের সময়টা আষাঢ়ে গিয়েও ঠেকে। তখন নদীতে বান ডেকে নৌকাই ছিল যাতায়াতের মাধ্যম। এখনও মধুমাসে মেয়েরা নাইওর যায় বাপের বাড়ি। মধুমাসে জামাই আম কাঁঠালের নিমন্ত্রণ না পেলে বেজার হয়ে থাকে। জামাইয়ের এই অবস্থা দেখে মেয়ে আঁচলে চোখ মোছে। এরই মধ্যে মেয়ের বাড়ির লোক আমকাঁঠালের নিমন্ত্রণ নিয়ে এলে মুহূর্তেই বয়ে যায় খুশির বন্যা। তবে সেদিনের মধুমাসের নাইওরের সেই মধুময়তা এখন অনেকটাই ম্লান। যুগের পরিবর্তনের হাওয়ায় গ্রামীণ পথঘাট এখন অনেক উন্নত। বিদ্যুতায়িত হয়েছে বেশিরভাগ গ্রাম। বিজলী বাতির রোশনাইয়ে গ্রামে এখন ভরা চাঁদের আলোর জ্যোৎ¯œার ¯িœগ্ধ রূপটি আর চোখে পড়ে না। সেদিনের নাইওর সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনে উঠানের কোণে ঝোপঝাড়ে জোনাকির জ্বলে ওঠা আলো দেখে মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে সুখদুখের কত কথাই না কইত। নাতি নাতনিরা নানির কাছে কতই না বায়না জুড়েছে। জামাই বেচারা কাছের খেয়াঘাট বা হাট বাজার থেকে ঘুরে এসে পিঁড়িতে বসে শাশুড়ির সঙ্গে বৈষয়িক কথা শুরু করেছে। জামাই তার মেয়েকে কতটা সুখে রেখেছে তার বয়ানও হয়েছে। নাইওরের সময়টায় আম কাঁঠাল কতভাবেই না খাওয়া হতো। কখনও রাতের আহার শেষে দুধ ভাতের মধ্যে আম ও কাঁঠালের কোয়া চিপে রসে ভরে দিয়ে সুস্বাদে। আম ছিলে খেয়ে আঁটি চুষতে কি যে মজা পেয়েছে ছেলেমেয়েরা। মধুমাসের নাইওরের দিনগুলো ছিল মধুময়তায় ভরা। কয়েকদিন অবস্থানের পর ফিরে যাওয়ার পালা শুরু হতেই মেয়ের মুখে আনন্দের হাসিতে ভাটা পড়েছে। ফিরে যাওয়ার দিনে রবীন্দ্রনাথের যেতে নাহি দিব কবিতার প্রথম চরণের কথাগুলো ফুটে উঠেছে ‘দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি বেলা দ্বিপ্রহর...’। আবার সেই গরুর গাড়ি। এবার আর ছই শাড়ি কাপড় দিয়ে ঢাকা নয়, দু’ দিকই খোলা। যতটা পারা যায় দেরিতে মেয়ে উঠেছে গাড়িতে। ততক্ষণে মেয়ের চোখের দু’কোণ বেয়ে অশ্রু স্রোত ঠোঁটের প্রান্তে এসে বৈশাখী নদী হয়ে যায়। মা মুখ ঢেকে চাপা স্বরে ফুপিয়ে কেঁদে মেয়েকে আধোভাঙ্গা স্বরে বলে ‘ভালো থাকিস মা।’ জামাইকে বলে ‘মেয়েটাকে ভালো রেখ বাবা’। মায়ের মমত্বভরা অনন্ত ¯েœহ পেয়ে মেয়ে গরুর গাড়ির ছইয়ের পিছন দিক দিয়ে দেখতে থাকে যতদূর চোখ যায় সেই বাড়ি সেই গ্রাম সেই ঘর...। সেদিনের নাইওরের এই দৃশ্যপটের সঙ্গে বর্তমানের নাইওর অনেকটা উন্নত। গ্রামে পাকা সড়ক। বিদ্যুতের ঝলকানিতে শহরের মতোই হয়েছে। সেই গরুর গাড়ি আজ আর নেই। তার জায়গা দখল করেছে যন্ত্রচালিত যান। বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক। উচ্চবিত্ত যাদের গাড়ি আছে তাদের কাছে দূর এখন খুব কাছের। মধ্যবিত্ত যাদের মাইক্রোবাস ভাড়া করার সামর্থ্য আছে তারাও যে কোন সময়ই মধুমাসের নিমন্ত্রণে যেতে পারে। বাকিরা সময়ক্ষণ ঠিক করে বাসে অথবা অন্য কোন যানবাহনে বাপের বাড়ি যায়। বর্তমানে নাইওরের সময়ও অনেকটা কমে গেছে। কখনও দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা। খুব বেশি হলে দু’ তিনদিন। একবিংশ শতকে সকলেই এখন যান্ত্রিক। হাতের মুঠোয় এখন বিশ্ব। যন্ত্র যুগ এনেছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। প্রবীণ ও মধ্যবয়সীরা যন্ত্রযুগের যন্ত্রণা সইছে যন্ত্রকে সঙ্গে নিয়েই। সেখানে মধুমাসের নাইওর আছে যন্ত্রের আদলে। নাইওরের সময় কমে গেছে। এখন হাতের কবজি ডুবিয়ে আম কাঁঠালের রসে দুধ ভাত নেই। আম দুধ কথাটিও উধাও হয়ে গেছে। আম উঠে এসেছে প্লেটে। টুকরো করা আম খাওয়া হয় কাঁটা চামচে। মুখে আঠা লেগে যাওয়া কাঁঠালের জৌলুস হারিয়ে গেছে। পাকা কাঁঠাল ভেঙ্গে কোয়া বের করার আনন্দেও ভাটা। ‘পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ...’ কবিতায় ছন্দ হয়ে আছে। জাম খেলে যে জিহ্বা রঙিন হয়, তা এ প্রজন্মের অনেকেই জানে। সেদিনের নাইওরের মা ও মেয়ে আজও একই আছে। পরিবর্তিত অগ্রযাত্রায় পাল্টে গেছে মধুমাসের মধুময়তার সেই পালা... Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×