ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

গোয়ের্নিকা ॥ বিশ্ব ট্র্যাজেডি

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১৩ মে ২০১৬

গোয়ের্নিকা ॥ বিশ্ব ট্র্যাজেডি

শিল্প ঘর সাজানোর উপকরণ নয় বরং শক্রর বিরুদ্ধে রক্ষণাত্মক বা আক্রমণাত্মক হাতিয়ার- বলেছিলেন বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম চিত্রকর পাবলো পিকাসো। পিকাসো তাঁর জীবনকালীন সমগ্র শিল্পকর্মে মানবিক মূল্যবোধের অঙ্গীকারকে প্রকাশ করেছেন। কিউবিস্ট মুভমেন্টের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। রেখা প্রধান বিভিন্ন জ্যামিতিক ফর্মের বিন্যাসে বস্তুকে একক দৃশ্যমানতায় একটি স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে উপস্থাপন তাঁর কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর্টের বিভিন্ন ধরনের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। একজন ভাস্কর, একজন ছাপচিত্রকর, সিরামিক শিল্পী এবং ম্যুরালিস্ট হিসেবেও আমরা তাঁকে চিনেছি। অদ্ভুত ছিল তাঁর অঙ্কনের জোর, সঙ্গে নিখুঁত পরীক্ষা। তিনি ছবিকে সুখকর না করে বরং অসুখকর করে তুলতেন। তাঁর আগেকার সময়ের চিত্রকলার যে কুসুমাস্তীর্ণ, রঙিন, ঝলমলে চিত্রপট ছিল তিনি তা থেকে মুক্তি নিতে চেয়েছিলেন এবং পেরেও ছিলেন। কিউবিক আঙ্গিকটিই এক ধরনের মোচড়ানো বিকৃতকরণের জন্ম দেয় যা মসৃণ তলকে প্রায়ই অস্বীকার করে এবং যা মসৃণ দৃষ্টিভঙ্গিরও বিপরীতে অবস্থান নেয়। তাঁর অন্যতম প্রধান শিল্পকর্ম গোয়ের্নিকাও যুদ্ধক্ষেত্রের মসৃণতাকে অস্বীকার করেই তৈরি হয়েছে। পিকাসো তাঁর সমকালের বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, বিরুদ্ধতা এবং অবাঞ্ছিত ঘটনাক্রমকে বিস্ময়কর শিল্পকীর্তি গোয়ের্নিকার মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। সাময়িক একটি ঘটনার প্রতি এর লক্ষ্য থাকলেও, চিত্রটির একটি আন্তর্জাতিক ও সর্বকালীন ব্যাখ্যা আছে। যেকালে আধুনিক চিত্রকলা শিল্পীদের একান্ত বিমূর্ত অভিধান বলে চিহ্নিত, সেকালে পিকাসো তাঁর গোয়ের্নিকার সাহায্যে সমকালীন এবং চিরকালীন অন্যায়ের প্রতি বিরুদ্ধতাকে প্রমুক্ত করলেন। গোয়ের্নিকার বিশিষ্টতা এখানেই যে এখানে পরাজয়কে প্রত্যাখ্যান করা হয়নি। চিরকালীন ক্ষোভ এবং প্রতিবাদের স্বাক্ষরতায় এটি চিত্রিত হয়েছে। চিত্রটিতে অনেকগুলো প্রতীকী ব্যঞ্জনা আছে। সাধারণত : যুদ্ধের ছবি একজন বা কয়েকজন বীরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। বিভীষিকাময় যুদ্ধের ছবি হয় রক্তরঞ্জিত। সেখানে পতাকা ওড়ে, শিরস্ত্রাণ লুটায় ইত্যাদি। পিকাসো গোয়ের্নিকাতে সেসবের ধার ধারেননি। তিনি প্রায় বর্ণহীন ছবি এঁকেছেন। এ ছবিতে আছে ঘোড়া, ষাঁড়, যোদ্ধা, হার্লেকুইন, লসিফার, বর্শা, ছোরা ইত্যাদি। এরা সবাই মিলে একটা বিপর্যয় তৈরি করেছে যা মানবতার লঙ্ঘনকে পরিস্ফুট করে। কোন ধারাবাহিক ইতিহাস, চরিত্র বা গল্প বর্ণনা করেননি পিকাসো এ ছবিতে এমনকি কোন আকারকেও প্রাধান্য দেননি। কোন অতিরঞ্জন না করে এবং কোন আকার না মেনে এই যে দারুণ বিপর্যয় তৈরিতে সার্থকতা অর্জন করেছেন পিকাসো তার জন্যই গোয়ের্নিকা চিত্রকলার ইতিহাসে মহত্তম হয়েছে। ১৯৩৭ সালের ২৬শে এপ্রিল একটি নতুন উদ্ভাবিত বোমার পরীক্ষা চালানো হয় উত্তর স্পেনের গোয়ের্নিকা নামক একটি গ্রামে। তিন দিন জ্বলেছিল গ্রামটি। ১৬০০ মানুষ আহত বা নিহত হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে মাসখানেক পরে প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশ্বমেলায় স্প্যানিশ প্যাভিলিয়নে রাখার জন্য গোয়ের্নিকা গ্রামটির বিয়োগান্তক মর্মান্তিক পরিণতিকে চিত্রিত করে একটি ছবি আঁকার আহ্বান জানানো হয় পিকাসোকে। কাজটির শুরুতে দুদিন প্রায় পাগলের মতো হয়ে যান পিকাসো এবং এক নাগাড়ে একটার পর একটা, এভাবে প্রায় ২০০’র মতো প্রাথমিক স্কেচ এঁকে যান। স্পেনের গৃহযুদ্ধকে উপজীব্য করে তার ভয়াবহতা এবং নারকীয় বিভৎস রূপ, মানব সন্তান বিশেষত মাতা ও নারী জাতির কান্না ও হাহাকার, যুদ্ধের ঘোড়া, ষাঁড় ও ভুলুন্ঠিত সৈনিক কোন কিছুই বাদ যায়নি। তুলে ধরেছেন পিকাসোর মন প্রাণ, বলা যায় গোটা পিকাসো অস্তিত্বই এই পঁচিশ ফুট দৈর্ঘ্য ও সাড়ে এগারো ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট দীর্ঘাকৃতির ছবিটিতে জড়িয়ে আছে। বিমূর্ত আঙ্গিকের হলেও ড্রইং ও প্রয়োগ শৈলীর সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্মতা এই ছবিতে বিশেষ ক্লাসিক গভীরতা এনেছে। চিত্রটিতে তিনটি রঙ পরিলক্ষিত হয়। সাদা, কালো ও ধূসর। মূলত এক ধরনের বিবর্ণতা ও বিষাদ ফুটিয়ে তোলার জন্যই এই তিনটি রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে ক্যানভাস জুড়ে সাদা-কালো রঙের আধিক্যই চোখে পড়ে। তেল রঙে আঁকা গোয়ের্নিকা চিত্রে বাম দিকে উন্মুক্ত অংশে একটি ষাঁড়ের মাথা। তার নিচে একটি বিস্ফোরিত মুখ, অনেক বিস্রচ্চ আঙ্গুল, তার নিচে একটি ছিটকে বেরিয়ে আসা হাত। একটি মু-ু, আরেকটি হাত যেটি ধরে ভাঙ্গা তরবারী, ওপর দিকে বিস্ফোরিত একটি ঘোড়ার মুখ, একটি চোখের আকৃতির বাতি, ছবির কেন্দ্রে একটি বল্লম, তারপর দুটি নারী মুখ, নিচের নারী অবয়বটি হাত দিয়ে নিজের পা টেনে আনছে। আরেকটি প্রায় ডুবন্ত নারীমুখ ওপর দিকে দুহাত তুলে বাঁচাও রব করছে বলে মনে হয়। আঘাতরত ষাঁড়টির লেজ অনেকটা অগ্নিরশ্মির মতো। ঘোড়ার নিচে একজন মৃত সৈনিক। সৈনিকের হাতে একটি তলোয়ার সেটা স্প্যানিশ সংস্কৃতিতে শাহাদাতের চিহ্ন। ঘোড়ার মাথার ওপর অশুভ চোখের আকৃতির একটি বাল্ব জ্বলছে। বাল্ব বোমাবর্ষণের দিকে স্পস্ট ইঙ্গিত করে। ঘোড়াটির ওপর একজন ভাসমান যুবতীকে দেখা যায়, যে খোলা জানালা দিয়ে ভেসে এসেছে বলেই বোঝা যায়। ষাঁড়ের পিছনেই শেলফের মধ্যে একটি পাখি আতঙ্কগ্রস্ত তাকিয়ে রয়েছে ষাঁড়টির দিকে। একেবারে ডানে দুটি হাত উঁচু করা, যে ধ্বংসের নিচে চাপা পড়েছে, তার ডানে কালো দেয়ালে চিত্রটি শেষ হয়েছে। গোয়ের্নিকার দুটি স্তর। গ্রাউন্ড স্তরটি অস্পষ্ট। এখানে জানালা আছে, টেবিল আছে আর সেসবের ওপরই যুদ্ধ রচিত হয়েছে। গোয়ের্নিকার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য তার গুপ্তময়তা। এতে অনেকগুলো চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য গুপ্ত আছে যা সাধারণ দর্শকের নজর এড়িয়ে যায়। গোয়ের্নিকাতে পিকাসো তাঁর জীবনের প্রায় সকল অভিজ্ঞতাকে সংযোজন করেছেন। যেমন ষাঁড়ের লড়াই যা তাঁর ছোট বেলার বিশেষ ঘটনা। আছে পাপেট চরিত্র জুড়ির মায়া। ফর্মের দিক থেকে ছবিটি কিউবিজম ও নিও- ক্লাসিসিজমের সংমিশ্রণ। এ চিত্রের মাধ্যমেই পিকাসো অসাধারণ খ্যাতি লাভ করেন। এখানে শুধু স্পেন নয় পৃথিবীর সমগ্র স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতিরোধী সত্তাকে তুলে ধরা হয়েছে আর মানুষের ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির নিন্দা করা হয়েছে। যতদিন মানুষ, স্বাধীনতার স্পৃহা, অগ্রগামী চিন্তা-চেতনা বেঁচে থাকবে ততদিন গোয়ের্নিকা বেঁচে থাকবে।
×