ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আলোর দিশারী

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ২৯ মার্চ ২০১৬

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আলোর দিশারী

হাসান ইমাম সাগর ভোর হলো দোর খোল, খুকুমণি ওঠরে। ঐ ডাকে জুঁই শাখে, ফুলখুকি ছোটরে। এভাবেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ বহু কবির কবিতা ও ছড়া ছন্দ মিলিয়ে পড়ে চলেছেন এক দল শিশু। ছড়ার ছন্দে মুখরিত পুরো এলাকা। কিন্তু শিশুদের মাথার ওপর খোলা আকাশ। সেখানে সূর্যের প্রখর রোদের তিব্রতা রক্ষায় একটি বরই গাছ। মায়ের আঁচলের মতো আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে গাছটি। এ শিশুগুলো সমাজের সুবিধাবঞ্চিত। সেই বরই গাছটির মতোই শিশুদের আধুনিক শিক্ষার আলো জ্বালাতে বাবার ভূমিকায় এগিয়ে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। তার নাম মোঃ জুয়েল আহমেদ। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। জানা যায়, ছোট বেলা থেকেই জুয়েল আহমেদ স্বপ্ন দেখতেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলোতে আলোকিত করার। ধীরে ধীরে তিনি স্কুল জীবনে স্বপ্নের আলো জ্বালাতে থাকেন। ঝরে পড়া শিশুদের বাসা বাড়ি কিংবা বস্তিতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতেন। ২০১০ সালের দিকে তিনি অনুধাবন করেন এভাবে একার পক্ষে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। তাই আট জন সদস্য নিয়ে গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবী ও শিক্ষামূলক একটি সংগঠন। তার নাম হিউম্যানিটি ফর পিপলস্। তখন সংঠনটির সদস্য ছিলেন মাত্র আট জন। সদস্যদের সম্মতিতে জুয়েলকে করা হয় সংগঠনটির সভাপতি। সংগঠনটির পক্ষ থেকে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অভিভাবকদের সঙ্গে কয়েকটি মতবিনিময় সভা করা হয়। প্রথমে কিছু অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ তাদের সন্তানেরা বিভিন্ন হোটেল ও দোকানে কাজ করে নিজেদের তিন বেলা খাবার যোগায়। পড়াশোনা করাটাতো উল্টো খরচ। সে জন্যই অভিভাবকদের পিছুটান। কিন্তু থেমে থাকেনি জুয়েল ও তার সংগঠনের সদস্যরা। দিনের পর দিন তারা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা দেয়ার কাজ চালিয়ে যান। শিশুদের প্রতি জুয়েলের আগ্রহ দেখে অভিভাবকরা পরবর্তীতে জুয়েলের সংগঠনের সদস্যদের বিশ্বাস করতে থাকেন। এভাবেই চলতে থাকে সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে জুয়েলের শিক্ষা বিস্তার। একদিন সংগঠনটির সদস্যরা সিদ্ধান্ত নিলেন একটি স্কুল খুলতে পারলে একত্রে অনেক শিশুকে পড়ানো যেত এবং পরিকল্পনা মাফিক অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া যাবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো কোথায় স্কুলটি খোলা যাবে। জায়গা দেবে কে? জুয়েল বলে উঠলেন কেউ জায়গা না দিলে আমাদের বাড়িতেই স্কুলটি খুলতে চাই। প্রথমে ২৯ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশু নিয়ে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে আদি টাঙ্গাইলে ‘ফ্রেন্ডশিপ স্কুল’ নামে একটি বিদ্যালয় (বৈকালিক শাখা) খোলা হয়। এই স্কুলটিতে সম্পূর্ণ বিনাবেতনে পড়াশোনার পাশাপাশি বই-কলম ও খাতা ফ্রি দেয়া হয়। বর্তমানে ওই শাখার শিক্ষার্থী রয়েছেন ৭০ জন। এই শাখায় শিক্ষক রয়েছেন চার জন। তাদের নামে মাত্র দুই হাজার টাকা বেতন দেয়া হয়। যা জুয়েল নিজে ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীদের টিউশনি করে আয়কৃত টাকা দিয়ে শিক্ষকদের বেতন দেন। পরর্তীতে ২০১৪ সালের শুরুর দিকে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিন ইউনিয়নের জেলেপাড়া ও পালপাড়া এলাকার সুবিধাবঞ্চিত ১৪ শিশুদের নিয়ে দ্বিতীয় স্কুলটি খোলা হয়। স্কুলটি সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবা মনির বাড়িতে স্থাপিত। বর্তমানে ওই শাখায় ৩০ সুবিধাবঞ্চিত শিশু নিয়মিত পড়াশোনা করে। চলতি বছরে জুয়েলের সংগঠনের সাহসী সিদ্ধান্তের একই সঙ্গে তৃতীয় শাখাটি জুয়েলের বাড়িতে এবং চতুর্থ শাখাটি জেলা সদরের বস্তি এলাকায় উন্মুক্ত করা হয়। তৃতীয় শাখাটিতে ২৪ জন ও চতুর্থ শাখাটিতে ৩১ জন শিশু শিক্ষার্থী রয়েছে। চারটি শাখায় শিক্ষক রয়েছেন মোট ৯ জন। মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ও ফ্রেন্ডশিপ স্কুলের শিক্ষিকা উম্মে আতিকা সোহানী বলেন, এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে কাজ করতে অনেক ভাল লাগে। ওদের পাশে থাকতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। তবে জুয়েল ভাই আমাদের খুশি হয়ে যখন যা দেন আমরা খুশি হয়ে তাই নিয়ে থাকি।’ সুবিধাবঞ্চিত শিশু রাহুলের মা ময়না বেগম বলেন, জুয়েল ভাই প্রথম যখন স্কুল খোলে আমার ছেলে রাহুলকে ভর্তি করিয়ে দেই। এখন সে বাংলা ইংরেজী ছাড়া ও নামতা পড়তে পারে।’
×