ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘পাঁচ বছরে গার্মেন্টস রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেয়া সম্ভব’

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৮ মার্চ ২০১৬

‘পাঁচ বছরে গার্মেন্টস রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেয়া সম্ভব’

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ॥ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের তৈরি পোশাক রফতানির পরিমাণ ৫০ বিলিয়নে ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেছেন, তৈরি পোশাক রফতানিতে বিশ্বের প্রথম অবস্থানে থাকা চীনের রফতানি প্রায় ২০০ বা ৩০০ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল সংখ্যার সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা চলে না। আমাদের বর্তমান রফতানির পরিমাণ ২৭ বিলিয়ন ডলার। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের তৈরি পোশাক রফতানির এই পরিমাণ ৫০ বিলিয়নে ডলারে উন্নীত হবে। যেভাবে এই খাতে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে এই সংখ্যা আমরা অর্জন করতে পারব। রবিবার দুপুরে বাংলা একাডেমির শামসুর রাহমান মিলনায়তনে বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মিলনের প্রথম অধিবেশনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য প্রদানকালে তিনি এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী ও সেন্টার ফর ইস্ট এ্যান্ড নর্থ ইস্ট রিজিওন স্টাডিজ-কলকাতার যৌথ উদ্যোগে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে দুই দেশের প্রথিতযশা বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। উদ্বোধনী পর্বে বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর সভাপতি প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মেসবাহ কামাল। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভারতের ন্যাশনাল রিসার্চ প্রফেসর জয়ন্ত কুমার রায়। ‘শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আন্তঃসংযোগ’ শীর্ষক অধিবেশনে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আব্দুল মতলুব আহমেদের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন সিডিপির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএম আকাশ, প্রাক্তন ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী প্রমুখ। এরপর সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও সহযোগিতা এবং পানির বণ্টন ও পরিবেশ শীর্ষক আরও দুটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম অধিবেশনে বক্তব্য প্রদানকালে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ আরও বলেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত যদি ছোটখাটো দেশের ক্ষেত্রে নমনীয় আচরণ করে, তাহলে সকলের উপকার হয়। এখন ভারত তামাক ও মদ ছাড়া প্রায় সকল দ্রব্যেই শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু এ সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশী পণ্য ভারতে প্রবেশের ক্ষেত্রে এক ধরনের ফি আরোপ করা হয়। যা বাংলাদেশী পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। তিনি আরও বলেন, অনেকেই বলে থাকেন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অনেক বড় বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। সবার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আমি বলতে চাই, বাণিজ্যের এই বড় ব্যবধানে আমাদের ক্ষতি কি? পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে রফতানির সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সেই সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। ভারতে বাংলাদেশের পাটের ভাল বাজার রয়েছে। বাজার ও পণ্যের গুণগতমান উন্নত করে ভারতে আরও রফতানি বৃদ্ধি করা যেতে পারে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করে কানেক্টিভিটির ওপর। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে। সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, আমাদের বাণিজ্যিক ধারার উন্নতির প্রধান নিয়ামক রাজনৈতিক ইস্যু। এক্ষেত্রে সার্কের ভূমিকা বাস্তবসম্মত নয়। পাকিস্তান কমবেশি সার্কের মধ্যে নেই। বাণিজ্যিকভাবে এই অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করতে হলে ব্যবসায়িক অবকাঠামো এবং বিনিয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। সভাপতির বক্তব্যে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, পররাষ্ট্র নীতিকে আমরা বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি, নানা তাত্ত্বিক কাঠামোতে আবদ্ধ করা যেতে পারে, কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে কোন নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক কাঠামোতে আবদ্ধ করা যাবে না। কারণ এই দুই দেশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দীর্ঘদিনের ইতিহাস-ঐতিহ্য, আবেগীয় সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক লেনদেনের বিষয়গুলো। রাজনৈতিক দলের দ্বারা একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রভাবিত হয়। ভারতের ক্ষেত্রে দলের পরিবর্তন হলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন হয় না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই আমাদের রাজনীতিটা একটি সময়ে পাকিস্তানীদের দ্বারা এমনভাবে পরিচালিত হয়েছে যে এটা অতিক্রম করতে আমাদের অনেকটা সময় লেগেছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে যে রকম অনেক পাকিস্তানের ছিটমহল আছে, যেসব অঞ্চলে বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে জয়লাভ করে সেটিকে আমি পাকিস্তানের ছিটমহল বলছি। এই ছিটমহলগুলোকে যেমন নিয়ে আসতে হবে নিজেদের অধিকারে, যেভাবে আমরা ভারতের কাছ থেকে নিজেদের ছিটমহলগুলো অধিকারে নিয়েছি। ভারতেও কিছু পাকিস্তানী ছিটমহল আছে সেগুলোর উপরেও তাদের অধিকার নিতে হবে। পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে। আমাদের সহযোগিতা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ এই সহযোগিতার বন্ধন অব্যাহত রাখবে। ভারতকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেই সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে তারা এগিয়ে যাবে নাকি বড়ভাই সুলভ ব্যবহার করবে। আমরা হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যাব। সার্কভুক্তদেশগুলো ভবিষ্যতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অবাধ বাণিজ্য এবং অবাধ চলাচলের অবস্থা বজায় রাখতে সচেষ্ট হবে। এ জন্য বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা যেমন ভারতের ভিসা জটিলার বিষয়টি সমাধানের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ভিসা জটিলতা একটি দেশের জন্য শত্রু ভাবাপন্নমূলক মনোভাব। তিনি বলেন, পাকিস্তানকে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। এখন সময় এসেছে পাকিস্তান ব্যতীত সার্কের অন্য দেশগুলোকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। শেখ হাসিনা যে টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলেছেন, যেটি পাকিস্তানের কারণে হবে না। সুতরাং পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা বাঞ্ছনীয়। আমি মনে করি শুধু ভারতই নয়, বাংলাদেশের জন্য এখনও পাকিস্তান একটি বড় হুমকি। এদেশে বিএনপি-জামায়াত যে পাকিস্তানবাদ রাজনীতির সৃষ্টি করেছে, সেটিকে মোকাবেলার পাশাপাশি আইএসআই অন্যান্য জঙ্গী গোষ্ঠীকেও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ভারতকে তাই এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাকিস্তানকে গুরুত্ব দিয়ে সার্কের অন্যান্য দেশকে একত্র করা যাবে না। এটা ঠিক যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এবং শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতিতে যদি মিল না থাকত তাহলে যে বিষয়গুলো আমরা ৭০ বছরে সমাধান করতে পারিনি, সেটি কিন্তু সমাধান করা যেত না। তিনি আরও বলেন, মাছ উৎপাদনে আমরা পঞ্চম, আলু উৎপাদনে সপ্তম, এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি ছোট রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে গেছে, এই মুহূর্তে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যদি ভারত কর্তৃপক্ষ একটু ছাড় দেয় তাহলে ভারত-বাংলাদেশ উভয়েই উপকৃত হবে এবং চোরাচালানের মতো বিষয়গুলো কমে আসবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে সীমান্ত সমস্যা। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বার বার বলা সত্ত্বেও আমাদের সীমান্তে গুলি চলছে। যেখানে ইউরোপে মাইগ্রেন্টদের নিয়ে নেয়া হচ্ছে, আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, সেই সময়ে কেউ সীমান্ত অতিক্রম করলে গুলি চালানো হবে, আমরা এ বিষয়টি পছন্দ করতে পারি না এবং এসব ঘটনার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব বলে থাকেন যে সীমান্তে গুলি চলবে না, তাহলে গুলি চলে কেন? এ থেকে দুটি বিষয় বোঝা যায়, হয়ত তাদের নিয়ন্ত্রণে সীমান্ত বাহিনী নেই অথবা তারা আমাদের এক কথা বলছেন ও সীমান্ত বাহিনীকে আরেক কথা বলছেন। জিরো টলারেন্স নীতি যদি আমাদের ক্ষেত্রে হয়, তবে তা ভারতের ক্ষেত্রেও হবে না কেন? এক্ষেত্রে অনেক তথ্য ও যুক্তি আসতে পারে তবে তা অগ্রহণযোগ্য। পানির সমস্যা নিয়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, উপমহাদেশে হবেই কারণ এখানকার মূল নদীগুলোর উৎপত্তিস্থল প্রায় একই জায়গায়, সেটি হিমালয় পর্বতমালা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে উপমহাদেশজুড়েই পানি নিয়ে সমস্যা চলছে। ভারতকে চীনের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ভারতের পাশে আমরা না থাকলে চীনের আন্তর্জাতিক কৌশল মোকাবেলা করা ভারতের পক্ষে সহজ নয়। ব্রহ্মপুত্রতে যদি বাঁধ দেয় এবং আমরা যদি প্রতিবাদ না করি তাহলে ভারতের অবস্থাটা কী হবে সেটিও ভারতকে বুঝতে হবে। সুতরাং পানির বিষয়টি আমাদের এইভাবে দেখতে হবে। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানটাই এ রকম যে একটি অঞ্চলের ঘটনা অন্য আরেকটি অঞ্চলকে প্রভাবিত করে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এখন আমাদের পিছিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক জয়ন্ত কুমার রায় বলেন, দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে কিছু সমস্যা থাকা স্বাভাবিক। সমস্যাসমূহ নিয়ে যে সাধারণ সমালোচনা তা সহজেই পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সমাধান করা সম্ভব। আর এই বিষয়গুলো নির্ভর করছে দুই দেশের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষতা ও দূরদর্শিতার ওপর। সভাপতির বক্তব্যে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আব্দুল মতলুব আহমেদ বলেন, ভারতকে ছোট দেশগুলোর ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে তা কমাতে ভারতে বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে হবে। ভারতে রফতানি করার মতো আমাদের দেশে তেমন কোন ব্র্যান্ডেড প্রোডাক্ট নেই। এ কারণেই বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয়।
×