ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মারুফ রসূল

তিনি আমাদেরই বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৭ মার্চ ২০১৬

তিনি  আমাদেরই বঙ্গবন্ধু

কিছুদিন আগে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন স্যারের সম্পাদিত ও সংকলিত একটি বই পড়ছিলাম। ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের দুই খণ্ডের এই বইটির বিষয়বস্তু যেমন গুরুত্বপূর্ণ ও নতুন গবেষণার জন্য অনুপ্রেরণামূলক, তেমনি নানাবিধ চিন্তা ও বিশ্লেষণে ঋদ্ধ তার ভূমিকা অংশটুকু। ভূমিকার শুরুর দিকে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তৃতার কথা উল্লেখ করে মামুন স্যার লিখেছেন- “... একবার একটি বক্তৃতায় শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছিলেন যে, ১৯৭৫ সালের পর আওয়ামী কর্মীরাই মার খেয়েছে, মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছে এবং বারবার ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি উচ্চারণ করেছে। আওয়ামী লীগ থেকে তো বঙ্গবন্ধুকে আলাদা করা যায় না। কিন্তু এটি ভাবা ভুল হবে যে, আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে দলীয়করণ করেছে। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নন, তিনি সবার”। যদিও তথ্যসূত্র না থাকায় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যটির দিন তারিখ বা স্থান খুঁজে পাইনি এবং আপাতদৃষ্টিতে সেটি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণও নয়। তবে বক্তব্যের যে অংশটি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে তা হলো, প্রধানমন্ত্রীর এই অনিবার্য ঘোষণাÑ ‘বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নন, তিনি সবার’। এই অমোঘ সত্যটিই বাঙালীর মানস-দর্শন। বঙ্গবন্ধু সকলেরÑ সকল দল, মত আর পথের উর্ধে সমস্ত মানুষের এক অনন্য অভিধানের নাম ‘বঙ্গবন্ধু’। কিন্তু এ কথা আমাদের জাতীয় রাজনীতি বা সমাজনীতির ক্ষেত্রে কতটুকু বাস্তব? এই প্রশ্নটি যখনই উত্থাপিত হয় তখনই আমাদের সামনে ভেসে উঠে জাতীয় জীবনের প্রতিটি স্তরের ক্লান্ত ক্ষয়িষ্ণু একটি অবয়ব। স্বীকার্য, স্বাধীনতার পর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা খানিকটা স্থিতিশীল হয়েছি অনেক ক্ষেত্রেই; কালের পরিক্রমায় আমাদের রাজনীতি অর্থনীতিতে আধুনিক বিশ্বের উন্নত দর্শনের ছোঁয়া লাগছে; কিন্তু এতকিছুর পর এটাও স্বীকার্য যে, আমাদের জাতিগত দর্শন তার মৌলিকত্ব হারিয়েছে এবং ক্রমাগত আমাদের ঠেলে দিচ্ছে বাজার অর্থনীতির ভোগবাদী বিলাসের পথে। কয়েকটি নিয়মতান্ত্রিক আনুষ্ঠানিকতায় আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি, ক্যালেন্ডারের পাতা ধরে পোশাকের সঙ্গেই আমরা বদলে নিচ্ছি আমাদের আচার ও ব্যবহার। প্রযুক্তি আমাদের সারা পৃথিবীর জ্ঞানের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে; কিন্তু জাতীয় দিবসগুলোর সঠিক ইতিহাস আমাদের মস্তিষ্ক ছেড়ে পালিয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মুজিবনগর সরকার দিবস, জাতীয় শোক দিবস, বিজয় দিবসÑ এই ইতিহাসগুলো তো আমাদের পাঠ্যপুস্তকেই আছে। আর সমাজে তথাকথিত সার্টিফিকেটনির্ভর শিক্ষিত সফলতার টিকিধারী হবার জন্য আমাদের অভিভাবকগণ তো এই পাঠ্যপুস্তকগুলো গুলিয়ে খাওয়াতে থাকেন। তারপরও কেন আমরা হোঁচট খাচ্ছি? এর একটি কারণ আমি নিজের জীবন থেকে বুঝেছি। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই আমাদের কাছে বিষয়ের একটি শ্রেণীবিভাগ করা হয়। সেই তালিকায় সমাজ, ইতিহাস বা বাংলা সাহিত্য হলো ব্রাত্যÑ এগুলো পড়া নিয়ে তেমন কোন মাথাব্যথা অভিভাবক বা শিক্ষার্থীদের থাকে না। গ্রেডিং পদ্ধতির কারণে যদিও এ বিষয়গুলোর কদর খানিক বেড়েছে; কিন্তু সেটাও জিপিএ-৫ বা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কোচিং বাণিজ্য পর্যন্তই। কারণ, সমাজের প্রচলিত ধারণা হলো এ বিষয়গুলো পড়ে আর যাই হোক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায় না। আবার বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার আগ্রহও দিন দিন কমছে। কারণ, সময়টা এখন কর্পোরেট বাণিজ্যের। অথচ গোটা বিষয়টাকেই আমরা যদি জ্ঞানের বিবেচনায় দেখতাম তাহলে যে যে বিষয়েই পড়ুক না কেন, বিষয়ভিত্তিক পেশা যাই হোক না কেনÑ আমরা বছর শেষে স্বপ্ন নিয়ে কিছু ভাল নবীন পেশাজীবীর দিকে তাকাতে শিখতাম। এই গোটা প্রক্রিয়াটি তলিয়ে দেখলে আমরা যে সাদাসিধে মধ্যবিত্ত মনস্তত্ত্বের ছবিটি পাই তা আসলে লকলকে লোভের জিভ বের করা একটি বিকৃত মধ্যবিত্তেরই প্রতিকৃতি। এই মধ্যবিত্তকে কেউ যদি উনিশ শতকের বাঙালী মধ্যবিত্তের সঙ্গে তুলনা করেন, তাহলে ভুল করবেন। এই মধ্যবিত্ত জ্ঞানে, শিক্ষায়, মননে উন্নত হওয়ার চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হওয়ার স্বপ্ন দেখে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন দোষের কিছু নয়, বরং অত্যন্ত প্রয়োজনীয়; কিন্তু বোধের বিকাশ না ঘটায় তার নৈতিকতা নেমে আসে শূন্যের কোটায়। তখন তার লোভের ঘোড়া নীতি-নৈতিকতা, দেশপ্রেম, মানবিক সম্পর্কÑ কোন কিছুরই তোয়াক্কা করে না। অতএব এই মধ্যবিত্ত থেকেই জš§ নেয় কালো টাকার মালিক, পেশাদার সন্ত্রাসী, ব্যাংক-বীমা-শেয়ারবাজার লুটতরাজকারী। গা বাঁচানোর জন্য তখন এরা আশ্রয় নেয় রাজনীতির ছত্রছায়ায়। প্রশ্ন উঠতেই পারে, রাজনীতি তাদের আশ্রয় দেয় কেন? সহজ উত্তর হলোÑ এই রাজনীতিও এখন দর্শনবিবর্জিত হয়ে কেবল ক্ষমতা আর কালো টাকার ওপর টিকে আছে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে সকলেই যে এই সরলীকরণের মধ্যে পড়েন তা বলছি না; তবে গোটা প্রক্রিয়াতে এই কয়েকজন ভাল মানুষ আসলে তীব্র ঝড়ের মুখে জ্বলতে থাকা প্রদীপÑ ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে তাঁরা আলো দিতে পারছেন না, আবার সত্য-দর্শনের দীপ্রতায় আমৃত্যু লড়াইয়ের প্রত্যয় তাঁদের বুকে। এই অস্থির সময়ে আমরা যদি পুনর্বার মুখোমুখি হই আমাদের ইতিহাসের এবং পাঠ করি বঙ্গবন্ধুর সেই অমিত রাজনৈতিক আখ্যানের পাণ্ডুলিপি; আমরা বুঝতে পারি বাঙালীর হাজার বছরের ঐতিহ্য লালিত ইতিহাস অনুসৃত মুক্তিযুদ্ধের দর্শন থেকে আমাদের পদস্খলনই আজকের পরিস্থিতির কারণ। এই পদস্খলনের একটি যেমন মুক্তিযুদ্ধের পথ ধরে হাঁটা বাংলাদেশের পঁচাত্তর-উত্তর সময়ে নষ্ট পাকিস্তানী রাজনীতির কানাগলিতে পথ হারানো, অন্যটি হলো বাংলার কাদা-জলে মাখা গণমানুষের ঘামে-আদরে-ভালবাসায় গড়ে ওঠা শ্যামলসুন্দর বঙ্গবন্ধুকে দর্শনের আকাশ থেকে রাজনৈতিক জানালায় বন্দী করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রতিটি রাজনৈতিক দল যেমন এর দায় এড়াতে পারবে না, তেমনি সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরাও পারব না নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকতে। ॥ দুই ॥ এই বাংলার মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পাঠশালা। তিনিও ছিলেন বাংলার আপামর জনসাধারণের চোখে তাঁদের প্রত্যাশার প্রপাত। চল্লিশের দশক থেকেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অভিযাত্রার যে ইতিহাস আমরা দেখি, তার পুরোটাই ছিল গণমানুষ সংশ্লিষ্ট। মানুষের অধিকারের সঙ্গে থেকে, বলা ভাল, একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের জন্য মানুষের যে আকাক্সক্ষা তাকে তিনি রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপ দিয়েছিলেন। সেই সংগ্রামে তিনি যে কেবল বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন তা-ই নয়, তাঁদের মানসকাঠামোও তিনিই নির্মাণ করেছেন। তাই স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য মানুষের বিস্মৃত জাতিসত্তাবোধকে তিনি জাগিয়ে তোলেন। যে জাতীয়তাবাদের ধারণায় তিনি আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বর্ণমন্দিরে, তা ছিল বিশ শতকের আধুনিক, উদারনৈতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবোধ। দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের মূর্ত চিত্র হিসেবে আমরা পাই বাহাত্তরের সংবিধান। কিন্তু যে প্রজš§ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা কি দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধুকে সহযোগিতা করেছিল? ১৯৭২-৭৫-এর শাসনামলের খতিয়ান দেখলে তা মনে হয় না; বরং খুব বেশি করে মনে হয় তৎকালীন প্রজš§ রাতারাতি সব হয়ে যাবার দিবাস্বপ্ন দেখেছিল। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকে পুনর্গঠিত করার জন্য যে সময় প্রয়োজন সে সময় তারা বঙ্গবন্ধুকে দেয়নি। আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয়ও কম ছিল না। পাকিস্তানফেরত বা পাকিস্তানী ভাবাদর্শের অনেককেই প্রশাসনসহ নানা রাষ্ট্রীয় কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সুতরাং নবগঠিত বাংলাদেশেই বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। এরই মধ্যে ছাত্রলীগে ভাঙ্গন ধরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র আর মুজিববাদের দ্বন্দ্বে। সবখানেই দেখা যায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী; কিন্তু এই নেতাকর্মীরা যে সকলেই দলের আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করেছিলেন এমন নয়। বরং এদের মধ্যে ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগীদের সংখ্যাই ছিল বেশি। পঁচাত্তরে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর আমরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কোন প্রতিবাদের ইতিহাস পাই না। তৎকালীন অবৈধ সামরিক সরকারের বর্বরতা এর একটি কারণ। কিন্তু তবুও যে প্রতিবাদগুলো তখন হয়েছে তার প্রায় অধিকাংশই হয়েছে সাধারণ মানুষের উদ্যোগে। তলা কুড়ানিরা তখন দলবেঁধে ঘাতক জিয়ার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই নিচ্ছে। পঁচাত্তর পরবর্তী এই বাংলাদেশবিরোধী রাজনীতিই কি তবে বঙ্গবন্ধুকে আমাদের কাছ থেকে দূরে নিয়ে গেল? কথাটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কারণ, তখনও আওয়ামী লীগের বাইরে একটি বৃহৎ প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারা বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল ছিল। অবশ্য এদের অনেকেই রং বদলাতে শুরু করে এবং ক্রমশই আমরা দেখতে পাই ১৯৭২-৭৫ সময়ের রাজনীতি কী নির্মমভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতার কাছে। তাই আজ যখন আমাদের দেশে কার্যকর গণতন্ত্রহীনতার আলোচনা ওঠে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা ওঠে তখন এ প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকÑ কেন বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধারাকে টিকিয়ে রাখতে পারলেন না পরবর্তী রাজনৈতিক নেতারা? এই প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজতে গেলেই আমরা আবিষ্কার করি এক নিষ্ঠুর সত্যকে। আমরা বুঝতে পারি, একজন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর মাত্র কয়েকজন সহযোদ্ধা ছাড়া আর কেউই আসলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর দর্শনটি বুঝতেই পারেননি অথবা চাননি। সুতরাং ক্ষমতার উত্তাপ পাবার জন্য পঁচাত্তরের পর তারা সামরিক ও মোল্লাতন্ত্রের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে রাজনীতি করেছে। সময়ের বিবর্তনে জিয়ার ভাগাড় থেকে এরশাদের ভাগাড়ে স্থানান্তরিত হয়েছে। নিজেদের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য দেশের ইতিহাসকে বিকৃত করেছে এবং খুব সচেতনভাবেই সমগ্র ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার হীন ষড়যন্ত্র করেছে। এই নিদারুণ ইতিহাস বিকৃতি আর মিথ্যাচারের মধ্যে বেড়ে উঠেছে একটি প্রজš§। খুব সচেতনভাবেই তৎকালীন অবৈধ শাসকগোষ্ঠী তাদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল রাজনীতির নামে অস্ত্রবাজি আর সন্ত্রাসের বিষ। অতএব, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কথা মনে রেখেও অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে বলছিÑ নীতিবোধ, মননধর্ম ও মানবিকতার সামগ্রিক স্তরে প্রায় নিঃশেষিত একটি প্রজšে§র হাত ধরে বাংলাদেশ কাগজে-কলমে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। এ কথার পক্ষে আমার যুক্তিÑ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনের মৌলবাদাক্রান্ত, দুর্নীতিপরায়ণ ও আপোসকামিতার ইতিহাস। আমাদের প্রজš§ বড় হয়েছে তথাকথিত গণতন্ত্রের কালে। কিন্তু সেখানেও ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কোন সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হতো না, যদি কালের ঝর্ণার মতোন একজন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম রাজপথে না নামতেন। অতএব, জাতির প্রায় বিস্মৃত মৌলিক ও সত্য ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন শহীদ জননী ও গণআদালতের আন্দোলন। আমাদের প্রজš§ আবিষ্কার করল বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে। আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলামÑ ব্যক্তির বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ অদ্বিতীয় হলেও বাংলাদেশকে খুঁজতে হবে আসলে বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর মানচিত্রে। ॥ তিন ॥ আমাদের জাতিচরিত্র ভরে গেছে ভোগবাদী খানাখন্দে। ব্যক্তি থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত এখন কেবলই নিজস্ব আখের গোছানোর চিন্তা। রাজনীতির মহৎ অর্থই কেবল নয়, বদলে গেছে আমাদের নানা পেশার সংজ্ঞা। শ্রমজীবী, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, এমনকি শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত এখন ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের চোখে রাষ্ট্রের অবস্থান বিচার করে। ফলে দলীয় চিন্তা বা ধ্যান-ধারণার বাইরে গিয়ে ইতিহাসকে আর কেউ দেখতে চায় না। রাজনীতি হয়ে গেছে পুতুল কুচকাওয়াজসর্বস্ব, বুদ্ধিজীবীরা প্রায় সকলেই দলীয় সঙ্কীর্ণতার দাস, রাজপথজুড়ে বিভেদের কার্নিভ্যাল, প্রতিষ্ঠানজুড়ে চাটুকারবৃত্তি। মৌলবাদের হিংস্র আস্ফালন, মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যা আর দিকে দিকে সকরুণ মানবিক বিপর্যয়। এমতাবস্থায় আমরা কোথায় গিয়ে খুঁজব আমাদের বঙ্গবন্ধুকে? দস্তয়েভস্কি বলেছিলেন যে, পুশকিন তাঁর সমাধিতে কিছু গোপনীয়তাও নিয়ে গেছেন। সুতরাং আমাদের ফিরে যেতেই হবে বঙ্গবন্ধুর কাছে। ইতিহাসের যে অমোঘ গোপনীয়তা তিনি নিয়ে গেছেন তার কাছে হাত পাততে হবে এবং ছড়িয়ে দিতে হবে দিকে দিকে। কারণ বঙ্গবন্ধু আমাদেরই একান্ত একজন। তাঁকে ভালবেসে তাঁর আদর্শকে ধারণ করতে হলে আমাদের কোন রাজনৈতিক দলের চৌহদ্দি মাড়াতে হয় না। বঙ্গবন্ধু মায়ের শাড়ির আঁচলে লেগে থাকা হলুদের গন্ধের মতো আপন। যে সাহস নিয়ে কোন তরুণ প্রতিষ্ঠানের সমস্ত নষ্টামিকে জোর গলায় ‘না’ বলতে পারে, সেই সাহসের নাম বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু আমাদের আকাশ, কোন রাজনৈতিক দলের ভুল বানানের পোস্টারের গুরুত্ব বাড়ানোর ফটোগ্রাফ নয়। যে রাজনৈতিক দল মাল্টিক্লাসের দোহাই দিয়ে জামায়াত-বিএনপি’র সন্ত্রাসীদের দলে ভিড়ায়, যে দলের মন্ত্রীর কাছে পহেলা বৈশাখের বীভৎস নারী নিগ্রহের ঘটনাকে কোন বিষয়ই মনে হয় না, এমনকি অর্থের বিনিময়ে যে আওয়ামী লীগ তৃণমূলের নির্বাচনে কোন কোন স্থানে জামায়াত-বিএনপি’র কুখ্যাতদের হাতে নির্বাচনের টিকেট দেয়Ñ সে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করে না, বঙ্গবন্ধু দর্শনের অমিত উচ্ছ্বাসকে ধারণ করার নৈতিক শক্তি তার নেই। আমরা বরং আমাদেরকেই প্রশ্ন করব বারবার। স্মরণ করব বঙ্গবন্ধুর সেই অবিনাশী উচ্চারণÑ ‘প্রতিটি মহৎ অর্জনের জন্য প্রয়োজন মহৎ আত্মত্যাগ’ এবং প্রস্তুত করব নিজেদের। আত্মত্যাগের এই অনন্যতাই হোক আমাদের জীবনের ইতিহাস, এখানেই নিহিত থাকুক আমাদের এপিটাফের বর্ণমালা। লেখক : গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী [email protected]
×