ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মদাত্রী বোঝাতে হলে তাদেরকে বলতে হয় ‘বায়োলজিক্যাল’ মাদার

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ২৬ মার্চ ২০১৬

জন্মদাত্রী বোঝাতে হলে তাদেরকে  বলতে হয় ‘বায়োলজিক্যাল’ মাদার

আপনি বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের নিয়ে প্রথম গবেষণাগ্রন্থ লিখেছেন। যুদ্ধশিশু সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাবস্থার সুযোগে পাকিস্তানী হানাদার ও রাজাকারদের দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার পর বাঙালী মহিলারা যে সকল শিশুর জন্ম দেন, তাদেরকেই পরবর্তীতে যুদ্ধশিশু বলা হয়েছে। সেই সময়ের পরিবেশ ছিল ভিন্ন। দেশের স্বাধীনতা আনতে দুই লাখ মা-বোন যে সম্ভ্রম হারাল, অনেকেই সেই আত্মত্যাগের কথা ভুলে গেল। হয়ত সে সময়ের দৃষ্টিভঙ্গি আরও সঙ্কীর্ণ ছিল। তখন এই যুদ্ধশিশুদের ‘অবাঞ্ছিত শিশু’, ‘শত্রু সন্তান’, ‘অবৈধ সন্তান’, এমনকি আরও অবজ্ঞাভরে ‘জারজ সন্তান’ বলা হতো। এদের জন্মদাত্রী নারীরা ‘ধর্ষিতা রমণী’, ‘অপমানিতা রমণী’, ‘দুস্থ মহিলা’, ‘ধর্ষণের শিকার’সহ নানা অভিধায় অভিহিত হতেন। বেশিরভাগ মা-ই লোকলজ্জার ভয়ে মিশনারিতে সন্তান জন্ম দিয়েই নিশ্চুপে চলে গেছেন। তারা জানতেন সমাজ এ শিশুকে ভালভাবে দেখবে না। বঙ্গবন্ধুও এ বিষয়টি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি যুদ্ধশিশুদের বিদেশীদের দত্তক দিতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধশিশুদের নিয়ে কাজ করবেন এ ভাবনা কিভাবে মাথায় এলো? আমি ১৯৭২ সালে উচ্চতর পড়াশোনার তাগিদে কানাডা আসি। কানাডার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শেষে আমি কানাডার ফেডারেল সরকারের অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজ করি। একটা বিষয় তোমাকে বলা দরকার, আমি কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘কানাডীয়দের আত্মপরিচয়’ বিষয়ে মাস্টার্স করেছিলাম। এ বিষয়েই আমি পরবর্তীতে সরকারের অধীনে গবেষণা করতাম। তখন সময়টা আশির দশকের শেষদিকে। গবেষণা করতে গিয়ে হঠাৎই একদিন তথ্য পেলাম বাংলাদেশ থেকে প্রথম ১৫ জন যুদ্ধশিশুকে কানাডায় পাঠানো হয়েছে। আর এই শিশুদের ‘হোয়াইট কানাডীয়ানরা’ দত্তক নিয়েছিল। তথ্য যেদিন পেলাম সেদিনই ঠিক করলাম ‘যুদ্ধশিশু’দের নিয়ে কাজ করব। তারপর সেই ১৫ শিশুর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন? আসলে এখন যেভাবে যোগাযোগ করা সহজ, খুব সহজেই একজনকে হাতের নাগালে পাওয়া যায়, আশির দশকে কিন্তু এমনটা ছিল না। আর কানাডার মতো দেশে হুট করে কাউকে কিছু বলাও যেত না। কিন্তু আমি সৌভাগ্যবান। কেননা, আমি সরকারের পক্ষ হয়েই বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেছি। তাই যোগাযোগটা আমার জন্য কিছুটা সহজ হয়েছে। যখনই জানতে পারলাম, কানাডায় বাংলাদেশের ১৫ জন যুদ্ধশিশু আছে, সেদিন থেকেই তারা কে কোথায় আছে জানতে চেষ্টা করলাম। ১৫ জন শিশুর নামের তালিকা, তাদের দত্তক নেয়া কানাডীয়ানদের নামের তালিকা আমি সংগ্রহ করলাম। পরে ফোন ডাইরেক্টরি ঘেঁটে তাদের ফোন করলাম। ফোনে প্রাথমিক কথা বলে সবাইকে আমি চিঠি লিখলাম। তারপরেই আমি একে একে তাদের সবার সঙ্গে দেখা করতে যাই। আমি একজন বাংলাদেশী, আমি তাদের নিয়ে বই লিখব, এটা তাদেরকে বলি। আপনার কথা শুনে তারা কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল? আসলে তাদের সঙ্গে আমার ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক হতে অনেকদিন লেগেছিল। তারা আমাকে প্রচুর তথ্য দিল। বলল তাদের অনুভূতির কথা। তারা আমাকে শর্ত দিল, বইটা যেন প্রকাশের আগে তাদেরকে দেখতে দেই। বই প্রকাশের আগে অনেকবার আমি তাদের পা-ুলিপি দেখিয়েছি। তারা সংযোজন বিয়োজন করেছে। সেজন্যে বইটি লিখতে আমার অনেক বছর সময় লেগেছে। বিশ বছর ধরে গবেষণার পর লিখলেন বইটি... হ্যাঁ। অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। অনেকেই যুদ্ধশিশুদের প্রাকটিক্যালি না দেখে গল্প, উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু আমার বইটা থিওরিক্যাল না, বরং অনেক বেশি প্রাকটিক্যাল। তাদের নিকটবর্তী হতে গিয়ে, প্রকৃত অনুভূতি জানতে সঙ্গত কারণেই আমাকে সময় নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। বইটি ১৯৯৫ সালে লেখা শুরু করলাম, লেখা শেষ হতে কয়েক বছর লেগে গিয়েছিল। অবশ্য ভালো কাজ করতে হলে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়-ই। যুদ্ধশিশুরা তাদের জন্মদাত্রী মা’কে কিভাবে দেখে? তারা আসলে দত্তক নেয়া মা-কেই মা মনে করে। জন্মদাত্রী বোঝাতে হলে তাদেরকে বলতে হয় ‘বায়োলজিক্যাল মাদার’। আমার দেখা প্রতিটি যুদ্ধশিশুই জন্মদাত্রীকে নিয়ে কোন বিরূপ মন্তব্য করতে দেখিনি। তাদের কোনো ক্ষোভ নেই। তারা বুঝেছে যুদ্ধাবস্থার শিকার হয়েছে। মায়ের সম্পর্কে তাদের একটা সফ্ট কর্নার আছে। যুদ্ধশিশু অনিলের কথা মনে পড়ছে। ওর পুরো নাম অনিল মৌলিং। তাকে তার মা সম্পর্কে জিগ্যেস করেছিলাম। সে জবাবে বলেছিল, ‘ধন্যবাদ মাকে। তিনি আমাকে হত্যা করে ফেলেননি।’ বর্তমানে যুদ্ধশিশুরা কেমন আছে? কিভাবে আছে? তোমাকে এর আগে কানাডীয় দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে হবে। আমাদের দেশে যখন যুদ্ধশিশুকে অবাঞ্ছিত, জারজ বলা হয়েছে তখন কানাডীয়রা যুদ্ধশিশুদের সাদরে গ্রহণ করেছে। তাদের দত্তক নিয়েছে নিঃসঙ্কোচে। তুমি ভাববে, তাদের হয়তো সন্তান ছিল না, তাই দত্তক নিয়েছে। ব্যাপারটা তেমনও নয়। আমি অবাক হয়েছি, যুদ্ধশিশুদের যারা দত্তক নিয়েছে, তাদের সবারই সন্তান আছে। তবুও মানবিকতা ও উদারতার গুণে তারা বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিয়েছে। আজ সে যুদ্ধশিশুদের বয়স কমপক্ষে ৪৩। তারা শিক্ষা জীবন শেষ করে কর্মজীবনের মধ্যাহ্নে চলে এসেছে। সবাই অনেক ভাল আছে। স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত তারা। একজন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনাও করছে। তুমি তাদের দেখলে বুঝতে তারা আসলে অসাধারণ মানুষ ও সুন্দরতম। তবে ১৫ জনের ভেতর দুজন বেঁচে নেই। একজন হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছে। আর একজন নিজেকেই নিজে মেরে ফেলেছে। তার নাম ছিল রানী। মানে কুইন। কেন সে আত্মহত্যা করেছিল জানেন কি? সেটাও এক বিশেষ ঘটনা। ১৬ বছর বয়সে রানী বাংলাদেশে এসেছিল। তার মায়ের দেশ দেখতে। দেশে এসে সে যেখানে জন্মেছে, যেখান থেকে তাকে দত্তক দেয়ার জন্য কানাডা পাঠানো হয়েছিল সেখানে যায়। রেজিস্ট্রারে নিজের নাম দেখে, জন্মস্থানের নাম দেখে সে বিস্মিত হয়। তার ভেতরের সত্তার আমূল পরিবর্তন হয়। এরপর থেকে সে আর সহজ হতে পারেনি। তাকে বিষণœতা পেয়ে বসেছিল। সে মনে করত সে তার জন্মদাত্রী মাকে চোখে দেখেছিল। রানী আর কখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। আবেগী রানী ২৭ বছর বয়সে বিষণœতায় ভুগে আত্মহত্যা করে। খবরটা শুনে আমি খুবই শকড হলাম। রানী অনেক মেধাবী ছিল। কবিতাও লিখত। বাংলাদেশে এসে সে কবিতা লিখেছিল সেই ষোলো বছর বয়সেই। কবিতার নাম ‘নদীর সন্তান’। সেই কবিতার চার লাইন মনে আছে এখনও : ত্যাগ করেছিলে তুমি আমাকে যখন আমি শিশু কেন তা জানি না আমি, কখনো জানবো না, কিন্তু তুমি সারাক্ষণ থাকবে মা আমার ভাবনায় ভালোবাসবোই জেনো, যেমন এখনো ভালোবাসি। কবিতাটা পড়লে আমার খারাপ লাগে। যেন রানীর যাবতীয় বিষণœতা, মা-প্রীতি কবিতার লাইনে গেঁথে আছে। অনেকদিন পর বাংলাদেশে এলেন। এ দেশ সম্পর্কে কী বলবেন? অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গিরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তবে আরও পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। আদালত রায় দিয়েছে : সরকার যেন যুদ্ধশিশুদের সম্মানিত করে। কিন্তু এ পর্যন্ত আমার জানা মতে কেউ এসে নিজেকে যুদ্ধশিশু দাবি করেনি। কারণ হয়তো তারা এখনও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি বা এমন পরিবেশ হয়ে ওঠেনি। আমাদের মনকে আরও বদলাতে হবে। সঙ্কীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আগামীতে কী নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে? আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই। যুদ্ধশিশুদের নিয়ে আরও ব্যাপৃত পরিসরে কাজ করার ইচ্ছে আছে। মানুষজন আমাকে নানাভাবে উৎসাহ যোগাচ্ছে। যারা উৎসাহ দিচ্ছেন তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।আমাদের অনেকক্ষণ সময় দিলেন। আপনার সান্নিধ্যে অনেক ভালো সময় কাটল। আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। তোমাদেরকেও অনেক ধন্যবাদ।
×