ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমাদের ভারি অস্ত্র, প্রশিক্ষিত জনবল ছিল না কিন্তু মনোবল ছিল দুর্দমনীয়

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ২৬ মার্চ ২০১৬

আমাদের ভারি অস্ত্র, প্রশিক্ষিত জনবল ছিল না  কিন্তু মনোবল ছিল দুর্দমনীয়

পদ্মা-মেঘনার পশ্চিম ভূখ- মুক্ত করার দায়িত্ব পড়েছিল আপনার ওপর। যুদ্ধ শুরুর সময়ের কথা বলুন আসল কথাটা বলতে গেলে একটু পেছনে যেতে হবে। একটু সময় লাগবে। সত্তরে যখন নির্বাচন হলো তখন আমি লাহোর ক্যান্টনমেন্টে আছি। নির্বাচনী রেজাল্ট পেয়ে তো আমরা খুশি। তারা বিমর্ষ। অনেক কথা আমরা আড়ালে-আবডালে শুনেছি। তাদের কথা শুনে আমরা বুঝতে পেরেছি তারা আমাদের নির্বাচত লোকের (বঙ্গবন্ধু) হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। আমার সিনিয়র, মেজর আনোয়ার ভাইকে বললাম, তাহলে তো পূর্ব পাকিস্তানে রক্তবন্যা বয়ে যাবে। যা হোক আমি চেষ্টা করে আমার বদলিটা নিয়ে নিলাম। আমাকে কোথাও পোস্টিং দিতে পারল না। পরে চুয়াডাঙ্গার চার নম্বর উইং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলে (ইপিআই) আমাকে পদায়ন করল। আমি একজন অবাঙালীর (পাকিস্তানী) কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিলাম। পরে সেখান থেকে কাজের প্রয়োজনে চলে গেলাম কুষ্টিয়ায়। ২৬ মার্চ সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম পাকিস্তানী আর্মিতে রাস্তা ভরে গেছে। তারা কার্ফু ডিক্লেয়ার করছে। আমি দ্রুত রুমে ঢুকলাম। টেলিফোন করতে চেষ্টা করলাম। ততক্ষণে লাইন কাটা হয়ে গেছে। যখন তারা কার্ফু ডিক্লেয়ার করতে করতে চলে গেল, আমি রওনা হলাম ঝিনাইদহের উদ্দেশে। সেখানে গিয়ে দেখি প্রচুর মানুষের সমাগম। ইতোমধ্যে সবখানে রটে গেছে আমি নাকি প্রথম বাঙালী কমান্ডার ফর উইং ইপিআরের ইতিহাসে। আমি জরুরী সভায় উপস্থিত সবাইকে ডাকলাম, ভাইসব এখানে আসুন। শুদ্ধ বাংলা শুনে উপস্থিত সবাই বুঝে গেছে আমি বাঙালী। পরে তাদের আমি আমার পরিচয় দিই। আমি তাদের বললাম, সময় খুব কম। যদি এদের বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্র ধরতে হয় তোমরা কি আমার সাথে থাকবে? তারা জয় বাংলা বলে উত্তর দিয়েছে। জয় বাংলা ধ্বনিতে চতুর্দিক কাঁপিয়ে দিয়েছে তারা। সবাই জানে আমাদের অস্ত্রবল নেই, প্রশিক্ষিত জনবল নেই, শিক্ষিত সৈন্য নেই। কিন্তু আমাদের মনোবল ছিল দুর্দমনীয়। আমি বললাম এমনও তো হতে পারে, আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাব। আমাদের সঙ্গে আপনারাও মারা যেতে পারেন। এতে আপনারা রাজি আছেন? তারা জয় বাংলা বলে কাঁপিয়ে দিল। সে যে কি মুহূর্ত, তা আপনাদের বোঝাতে পারব না। এ সময়ের গভীরতা বিস্ফোরণ মুহূর্ত, না দেখলে বোঝা যায় না। আমি যতই গলা ফাটিয়ে বলি, কিন্তু আপনারা বুঝতে পারবেন না, যদি আপনারা সরেজমিন না দেখেন। সে মুহূর্তের অনুভূতি বোঝানো কোনভাবেই সম্ভব হবে না। সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত মিটিং করলাম, বিছানায় শরীর লাগালাম, কিন্তু ঘুম হলো না। শোয়া থেকে উঠে গেলাম। সকাল হলো। সবার সাথে যোগাযোগ করে বললাম, আমার পরের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করো। একাত্তরের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ দেখে আপনি কতটুকু তৃপ্ত? না। আমি সম্পূর্ণভাবে তৃপ্ত নই। কারণ আমরা যা চেয়েছি তা পাইনি। শুধু স্বাধীন হয়েছি আর কিছুই পাইনি। পাকিস্তানীদের কাছ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলাম, স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। ভৌগলিক স্বাধিনতা আমরা পেয়েছি। রাজনৈতিক স্বাধিনতা পেয়েছি। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতাটা আমরা পাইনি। সর্বস্তরে দুর্নীতি ছেয়ে গেছে। বর্তমানে দেশে অনেক রকম দুর্নীতি হচ্ছে। এমন দেশ আমরা চাই, যেখানে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা থাকবে। আমরা ভৌগলিক ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও কথাবার্তায় স্বাধীন থাকব। সর্ব অধিকারের মালিক আমরা থাকব। তবে সর্বোপরি বর্তমান সরকার যথেষ্ট উন্নয়ন করছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে, কী বলবেন? খুব কঠিনভাবে তাদের সাজা দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও ওই ঘোষণাপত্র ক্যানসেল করে তাদের আবার মাঠে নামায় জিয়াউর রহমান। কিন্তু বর্তমান সরকার দেশের এক-তৃতীয়ংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এসেও কেন এদের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো না? যদি তাদের নিষিদ্ধ করত তবে তারা আন্তর্জাতিকভাবে কোন সুবিধা ভোগ করতে পারত না। আর জাতীয়ভাবে তাদের সীমাবদ্ধতা চলে আসত। যুদ্ধাপরাধীরা যুদ্ধের সময় লুটপাট করেও আমাদের-ই কোন কোন রাজনৈকিত দলের ছত্রছায়ায় পুনর্বাসিত হয়েছে। সরকার থেকেও তারা সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, এ সুযোগে সবদিক দিয়েই তারা নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে। জীবনসায়াহ্নে এসেও দেশের জন্য কাজ করছেন, ক্লান্তি অনুভব করেন? মোটেই না। ভালই লাগছে। বৃদ্ধ হয়ে গেছি বুঝতেই পারছি না। উন্নয়নমূলক কাজকর্মে থাকছি তো তাই। কাজে আছি বলে আমার মাঝে অলসতা আসে না। আর আমি যে বৃদ্ধ হয়েছি তা বুঝতেই পারি না। ৪৫ বছরে বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়েছে? দেশ অবশ্যই এগোচ্ছে। তবে সময় লাগবে। বর্তমান সরকারের নিজেদের মাঝেই বহু শত্রু আছে। দেশের উন্নয়ন আরও বেগবান করতে আপনার পরামর্শ কী? স্থিতিশীল সরকার চাই। ক্রমাগত কয়েক বছর, অন্তত এক যুগ। তাহলে আশা করা যায় দেশের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যাবে। রাজনীতিকদের মাঝে এমন বোধ আসা প্রয়োজন। ভালভাবে কাজ না করলে সরকার ফের ক্ষমতায় আসতে পারবে না। দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন? দেশকে নিয়ে স্বপ্ন তো নতুন কিছু নয়। প্রথম স্বপ্ন ছিল স্বাধীন হতে হবে। আমাদের অর্জন আমরাই ভোগ করব। তারা (পাকিস্তানী) নেবে কেন? এসব পরিস্থিতি আমারা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি। আমরা স্বাধীন হয়েছি। আমাদের অর্জিত টাকা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাচ্ছি। কেউ হয়ত সেখান থেকে কিছুটা পকেটে ঢোকাচ্ছে। এমনটা হতেই পারে। এটা খুব বড় কোন সমস্যা না। বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, আমি সোনার দেশ গড়তে চাই। আমরা যদি দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে পারি তবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া সম্ভব। বিভিন্ন ক্ষেত্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যদি ইচ্ছা করেন তাহলে অধীনস্থদের ঠিক করতে পারবেন। ধরুন একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যদি ঠিক থাকেন তবে তার অধীনস্থ ব্যক্তিদের তিনি ঠিক রাখতে পারবেন। এভাবে উপর লেভেল থেকে সব ঠিক করতে হবে। নিচের লেভেল থেকে ঠিক করা সম্ভব নয়। তবে নিচ থেকেও ঠিক করা যাবে যদি তার বাবা-মা নৈতিক শিক্ষা দেন। শিশুদের দেশপ্রেম কী জিনিস, দেশের প্রতি মায়া শেখাতে হবে। সে শিক্ষা দেয়া স্কুলে কিংবা পরিবারেই সম্ভব। তরুণ প্রজন্মের নিকট প্রত্যাশা কী? তরুণ প্রজন্ম ও সর্বস্তরের কাছে আমার প্রত্যাশা আছে। তরুণ প্রজন্ম ছাড়া কোন উপায় নেই। ভবিষ্যতে আমরা থাকব না, তাদেরই এ দেশের পতাকা ধরতে হবে। সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনাকেও ধন্যবাদ।
×