ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কি পোলারে বাঘে খাইলো

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ২৬ মার্চ ২০১৬

কি পোলারে বাঘে খাইলো

একাত্তরে স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ ছিল জনপ্রিয়তম অনুষ্ঠান। চরমপত্র থেকে একটি এখানে তুলে দেয়া হলো- কি পোলারে বাঘে খাইলো। শ্যেষ! আইজ থাইক্যা বংগাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শ্যেষ। ঠাস্্ ঠাস্্ কইরা আওয়াজ হইলো। ডরায়েন না, ডরায়েন না। আমাগো ঢাকার কুর্মিটোলায় বিচ্ছুগো আওয়াজ পাইয়্যা জেনারেল পিঁয়াজি সাবে চেয়ার থনে পইড়া গেছিলো। আট হাজার আটশ চৌরাশি দিন আগে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট তারিখে মুছলমান, মুছলমান ভাই ভাই কইরা, করাচি লাহুর পি-ির মছুয়া মহারাজরা বংগাল মুলুকে যে রাজত্ব কায়েম করেছিল... আইজ, তার খতম তারাবী হইয়া গেলো। বাঙালী পোলাপান বিচ্ছুরা দুইশ’ পয়ষট্রি দিন ধইর‌্যা বংগাল মুল্লুকের কেদো আর প্যাঁকেরা মাইদ্দে ওয়ার্ল্ড (ডঙজখউ) এর বেস্ট (ইঊঝঞ) পাইটিং ফোর্সগো পাইয়া... আহারে, বাড়িরে বাড়ি। ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়াগুলো ঘঁৎ ঘঁৎ কইরা দম ফালাইলো। ইরাবতীতে জনম যার, ইছামতিতে মরণ। আতকা আমাগো বকশীবাজারের ছক্কু মিয়া ফাল্্ পাইড়া উঠলো। ভাইসাব, আমাগো চকবাজারের চৌরাস্তার মোড়ে পাতথর দিয়া একটা সাইনবোর্ড বানামু। হেইডার মাইদ্দে কাউলারে দিয়া লেইখা লমু, “১৯৭১ সাল পর্যন্ত বংগাল মুলুকে মছুয়া নামে এক কিছিমের মাল আছিলো। হেগো ছোটপাট্্ বাইড়্যা যাওনের গতিকে হাজার হাজার বাঙালী বিচ্ছু... হেগো চুটিয়াকে তরে মানে কিনা পিঁপড়ার মতো ডউল্যা শেষ করছিল।” এই কিছিমের গেনজামরে কেতাবের মাইদ্দে লিইখ্যা থুুইছে, ‘পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে।’ টিক্কা মালেক্যা, গেল তল, পিঁয়াজি বলে কত জল? ২৫ শে মার্চ তারিখে সেনাপতি ইয়াহিয়া খান বাঙালীগো বেসুমার মার্ডারকরণের আর্ডার দিয়া কি চোট্্পাট। জেনারেল টিক্কা খান হেই আর্ডার পাইয়া দশ লাখ বাঙালীর খুন দিয়া গোসল করলো। হে-র-প-র বাংগাল মুলুকে খাল খোন্দক, দরিয়া পাহাড় আর গেরাম বন্দরের মাইদ্দে তৈরি হইলো বিচ্ছু যেই রকম বুনো ওল... হেই রকম বাঘা তেঁতুল। গেরামের পোলাপান যেমতে কইরা বদমাইশ লোকের গতরের মাইদ্দে চোত্্রা পাতা ঘইষ্যা দেয়, বিচ্ছুগো হেইরকম কাম শুরু হইয়া গেলো। হেই কাম বিগিন (ইঊএওঘ)। ডাঁ-ই-ই... কি হইলো? কি হইলো? ঢাকার মতিঝিলে বিচ্ছুগো কারবার হইলো। ঘট্্াঘট ঘটাঘ। কি হইলো? কি হইলো? অংপুরের ভুরুঙ্গামারীতে ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়াগুলা হালাক হইলো। কেইসটা কি? কই না তো...আমাগো মানিকগঞ্জ মুন্সীগঞ্জ কোন টাইমেই মছুয়ারা আছিলো না তো? মেরহামত মিয়া অক্করে চিক্কুর পাইড়া উঠলো। বুঝছি, বুঝছি, পুরা মছুয়া রেজিমেন্টের আলাদা না পাইয়া প্যাঁক আর দরিয়ার মাইদ্দে গায়েব কইর‌্যা কি সোন্দর, দুই হাত ঝাইড়া বিচ্ছুরা কইতাছে... কই না তো? এই দিকে কোনদিন মুছয়ারা আহে নাই তো? ব্যাইস্্... মেশিন গানের লগে মেশিন গান আর মর্টারের লগে মর্টারের বাইড়া-বাইড়ি শুরু হইয়া গেলো গাবুর বাড়ির চোটে জেনারেল টিক্কা খান পশ্চিম পাকিস্তানে ভাগোয়াট হইলেন। লগে লগে, আয় মেরে জান, পিয়ারে দামান, নুরে চামন, আসমান কি চাঁদ, আঁখো কি তারা, পেয়ারে সেনাপতি ইয়াহিয়া খান নতুন টিরিক্্স কইর‌্যা বইলো। কয়েকটা বাঙালী হারুমালের মুখে লাগাম লাগাইয়া ক্ষেমতা হস্তান্তর করছি, ক্ষেমতা হস্তান্তর করছি বইল্যা চিল্লাইতে শুরু করলো। ঠেটা মালেক্যা গভর্নর, ‘ওয়ানম্যান পাট্রির ছল্ল মিয়া মাইনক্যাচারের আবুল কাসেম, খুলনার খবরের কাগজের হকার এজেন্ট মওলানা ইসুপ্যা, জয়পুরহাটের মওলানা আব্বাস, ফেনীর ওবায়দুল্লা মজুমদার আর বরিশালের অখতার উদ্দিন মিনিস্টার হইলেন হবু চন্দ্র রাজার গবু চন্দ্র মন্ত্রী। পালের গোদা ছিয়াত্তুর বচ্ছর বয়সের বুড়া বিল্লী অস্তে কইর‌্যা ছালার মাইদ্দে থনে বারাইলো। স-অ-ব কামই হিসাব মতো চলতাছে। সাত্্ডা হারু পাট্রিরে এক গোয়ালে তুইল্যা মওলবী সাবের পেরধান মন্ত্রী হওনের চীরকিৎ হইলো। পুরানা তফনের নেকড়া দিয়া উরা বাইন্দা বেড়ায় হাওয়াই জাহাজে পিন্ডি যাইয়া ছদর ইয়াহিয়া খানের অক্করে কোলের মাইদ্দে বইয়া পড়লো। সেনাপতি ইয়াহিয়া খান যখন আন্তাজ করতে পারলো যে, কোন টিরিকস-এ আর কাম হইতাছে না, তখন পশ্চিম পাকিস্তান আর বংগাল মুলুকের লড়াইডারে ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের গেনজাম বইল্যা চালু করণের লাইগ্যা ভট কইর‌্যা কইয়া বইলো...‘আমি কিন্তুক আর নিজেরে আটকাইয়া রাখতে পারতেছি না। আমার লগে নতুন মামু রইছে, বুড়া শ্যাম চাচা রইছে। আমি ইন্ডিয়া এ্যাটাক করমু। দিনা দশেকের মাইদ্দে আমি এই কারবার করমু। এইবার আমি নিজেই পি-ির থনে বর্ডারে যামু।’ যেই কথা হেই কাম। মাথার ‘আপার চেম্বার’ খালি ছদর ইয়াহিয়ার যা থাকে ডুংগির কপালে কইরা কারবার তো কইর‌্যা বইলো। কিন্তুক মওলবী সাবরে আর বর্ডারে যাইতে হইলো না। আত্্কা সরাবন তহুরার গিলাস টেবিলের উপরে ঠক্্ কইর‌্যা থইয়া দেহে কি? লাড়াই অক্করে রাওয়ালপি-ির দরজায় আইস্যা হাজির হইছে। পাশে আজরাইল ফেরেশতা খাতা হাতে খাড়াইয়া রইছে। খাতায় লেখা ‘সাদা পাকা মোটা মোটা ভুরুওয়ালা আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। পিতা টঘকঘঙডঘ মানে কিনা পিতা অজ্ঞাত। হ-অ-অ-অ এই দিককার কারবার হুনছেন নি? সবাই হবুর কারবার। হবু পেদানী মন্ত্রী চুরুল আমীন, হবু দেশরক্ষা মন্ত্রী মিয়া মোমতাজ দৌলতানা, হবু যোগাযোগ মন্ত্রী আগায় খান পাছায় খান-খান আবদুল কাইয়ুম খান, হবু পোস্টাফিসের মন্ত্রী ‘ইসলামের যম’ গোলাম আযম আবর হবু ফরিন মিনিস্টার মদারু ভুট্টো। কেউই শপথ লইতে পারে নাইক্যা... টাইম শর্ট। বংগাল মুলুকে বিচ্ছুগো গাজুরিয়া মাইর গুরু হইয়া গেছে। ঠেটা মালেক্যার কি কাঁপন। মওলবী সাবে বাংকারের মাইদ্দে বইস্যা বল পয়েন্ট কলম দিয়া গভর্নরের পদ থাইক্যা ইসতফা দিছে। এ্যারেই কয়, ‘ঠেলার নাম জসমত আলী মোল্লা।’ বেডায় তাঁর সাংগোপাংগো লইয়া কি সোন্দর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এর মাইদ্দে হান্দাইছে। কিন্তু মওলবী সাহেব ‘লেইট‘ কইরা ফেলাইছেন। আপনার ঘেটুগো খবর কি? ছহি আজাদ পত্রিকার হরলিক্্স-এর বোতল ছৈয়দ ছাহাদাৎ হোসেন, মর্নিং নিউজের এসজিএম বদরুদ্দীন আর ছালাউদ্দীন মোহাম্মদ, সংগ্রাম পত্রিকার মওলানা আখাতার ফারুক্যা, দৈনিক পাকিস্তানের আহছান আহম্মদ আস্্ক পাকিস্তান অবজারভারের খাসীর গুর্দার সুরুয়া খাওয়াইন্যা মাহবুবুল হাক্ নেশানাল ব্যুরোর দাড়ি-নাই মাওলানা ড. হাসান জামাল, পাবনার চোরা মতিন, অংপুরের ‘ন্যাশ’ কাদের আর খোন্দাকর আব্দুল হামিদ- এইসব মালেরা অখন করবো কি? প্রাক্তন ফরিন মিনিস্টার হরিবল হক চৌধুরীর কোন খবর নাইক্যাÑ সিলেটের হারু মাল চুষ-পাজামা মাহমুদ আলীর কোন আও-শব্দ পাওয়া যাইতেছে না। কি হইলো এদ্দিন তো শাহ মোহাম্মদ আজিজুর রহমান আর দরদী সংঘের দালাল সম্রাট এটি সাদীরে লইয়া খুউব তো ফাল পাড়তাছিলা... ‘মালপানি জিন্দাবাদ, মালপানি জিন্দাবাদ।’ এলায় করবা কি? আমার সাজানো বাগান হুকায়া গেলো। এ্যাঃ এ্যাঃ এ্যাকটিং! জাতিসংঘে মদারু ভুট্টো, জেনারেল পিঁয়াজীর ছারেন্ডারের খবর পাইয়া এ্যাকটিং করছে। পয়লা গরম তারপর নরম। হে-র-প-র আরে কান্দন রে কান্দন! পকেটের রুমাল বাইর কইর‌্যা চোখ মুইচ্ছা নাক ‘ক্লিয়ার’ কইরা লইলো। চিল্লাইয়া কইলো ছারেন্ডার ছারেন্ডার তো ‘ইম্্পস’ মানে... কিনা অসম্ভব। আমরা ছারেন্ডার করমু না। আমি পাইট করমু, আমি পাইট করমু। এই না কইয়া মদারু মহারাজ আত্্কা গতরের জামা-কাপড়...থুড়ি, ফ্রান্স-ব্রিটেনের খসড়া প্রস্তাব টুকরা টুকরা কইর‌্যা ছিঁইড়া ফেলাইয়া গেট-মেট কইর‌্যা বার‌্যাইয়া গেলো। বাইর‌্যাইনের টাইমে ইন্ডিয়া-রাশিয়ার লগে ফ্রান্স আর ব্রিটেনের তুফান গাইল। সাদা চামড়ার জেন্টলম্যানরা খালি কইলো, ‘যার লাইগ্যা চুরি করি, হেই কয় চুর।’ জাতিসংঘ থাইক্যা আগা শাহীর রুমে আহনের লগে লগে মওলবী সাবে খবর পাইলো- ‘খেইল খতম-পয়সা হুজম।’ আট হাজার আটশো চৌরাশি দিনের সোনার হাঁস, মানে কিনা বংগাল মুলুকসহ পাকিস্তানের নামে দেশটা শ্যেষ হইয়া গেছে। আমাগো বক্্শী বাজারের ছক্কু মিয়া একটা গুয়ামুরী হাসি দিয়া গলাটা খেক্্রানী ম্যাইরা কইলো, ভাই সাব ২৬ শা মার্চ এই মদারু ভুট্টো ঢাকার থনে করাচীতে ভাগোয়াট হইয়া কইছিলো, ‘আল্লায় সারাইছে, ছদর ইয়াহিয়া বসুমার বাঙালী মার্ডারের আর্ডার দেওনের গতিকে পাকিস্তানটা বাঁইচ্যা গেলো।” এলায় কেমন বুঝতাছেন? বিচ্ছুগো বাড়ির চোটে হেই পাকিস্তানটা কেম্তে কইর‌্যা ফাঁকিস্তান হইয়া গেলো। হেইর লাইগ্যা কইছিলাম “কী পোলারে বাঘে খাইলো! শেষ... আইজ থাইক্যা বংগাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শ্যেষ। আট হাজার আটশ’ চৌরাশি দিন আগে ‘মুছলমান, মুছলমান ভাই ভাই’ কইয়্যা, করাচি-লাহুর-পি-ির মছুয়া মহারাজরা বংগাল মুলুকে যে রাজত্ব কায়েম করেছিলোÑ আইজ তার খতম তারাবী হইয়্যা গেলো। আইজ হেশের দিন একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আপনাগো খাদেমের নামটা কইয়্যা যাই। আমার নাম হইতাছে এম আর আখতার মুকুল। জয় বাংলা। খোদা হাফেজ। [ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মহান উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে বিখ্যাত চরমপত্র অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিদিন এ ধরনের প্রচার ও প্রোপাগা-া করা হয়েছিলো। এই অনুষ্ঠানে নাম উল্লেখ করে যাদের সমালোচনা করা হয়েছে, তাদের কারো কারো ভূমিকা অতীতে হয়তোবা উল্লেখযোগ্য থাকলেও, [একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে এদের রাজনৈতিক ভূমিকা ছিলো বিতর্কিত বা ঘৃণিত। অনেকের মতে পরবর্তীকালে এঁদের মধ্যে কেউ কেউ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। আবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিত্ব নিজেদের মন-মানসিকতা আর সংশোধন করতে পারেননি। জনাকয়েক অবশ্য এর মধ্যেই পরলোকগমন করেছেন। আমাদের উত্তরসূরিদের জ্ঞাতার্থে ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানের এই সর্বশেষ প্রতিবেদন অত্র পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করা হলো। ব্যক্তিস্পর্শের জন্য অপারগ। -লেখক]
×