ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বুক চিরে নির্মিত হয়েছে পাকা সড়ক ;###;ফসলি জমি আর ঘরবসতিতে ভরে গেছে

বিশাল জলরাশির চলনবিল শুকিয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২২ মার্চ ২০১৬

বিশাল জলরাশির চলনবিল শুকিয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে

সমুদ্র হক ॥ একদার পদ্মা-যমুনার সমন্বিত চলনবিল নামের সেই প্লাবনভূমি আজ আর নেই। দিনে দিনে পানি শুকিয়ে বিস্তীর্ণ বিল ফসলি জমিতে পরিণত হচ্ছে। যে বিলে একসময় ছিল থৈ থৈ পানি সেখানে ঘরবসতি গড়ে গাছ লাগানো হয়েছে। শুকনো বিলের বুকচিরে নির্মিত হয়েছে পাকা সড়ক। বিলদহর চামারি চাটমোহর গুরুদাসপুর সিংড়ার যে এলাকাগুলো ছিল দুর্গম বন্ধুর পথ তা এখন সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও বাস চলাচলে কাছে চলে এসেছে। চলনবিলের যে ভরাট জলাশয়ে কৃষক ও জেলেদের মাছধারা ছিল একমাত্র পেশা সেই জেলেরা পানির অভাবে ভিন শহরে গিয়ে হয়েছে মজুর কামলা। বিলের পুরুষরা এভাবে স্থানান্তরিত হওয়ায় জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ শুকনো ভূমিতে সকল ধরনের ফসল ফলাচ্ছে নারীরা। প্রমত্তা বিল ছোট হয়ে যে অংশে এখনও কিছু পানি আছে সেখানে জেলেরা মাছ শুকিয়ে শুঁটকি বানিয়ে দেশে সরবরাহ ছাড়াও বিদেশে রফতানি করছে। আরেকদিকে যে বিল এক সময় ছিল ঝিনুক চাষে মুক্তো আহরণের আধার পানি কমে যাওয়ায় সেই আধারও আর রক্ষা করা যাচ্ছে না। ঝিনুক থেকে মুক্তো আহরণের আগেই তা হাঁস-মুরগির খাবার ও চুন তৈরির শিল্পে চলে যাচ্ছে। প্রমত্তা চলনবিলের আয়তন ব্রিটিশ শাসনামলের খাতায় যা ছিল তাই হিসাব করা হয়। তবে তা যে কতটা কমে গেছে তা বিলপাড়ে গেলে সাদা চোখেই দেখা যায়। উত্তরাঞ্চলের তিন জেলার ৮ উপজেলার মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া বিলের আয়তন গত শতকের শুরুর দিকে ছিল প্রায় নয় শ’ বর্গমাইল (১ হাজার ৪শ’ ৪০ বর্গ কিলোমিটার)। বর্তমানে বিলের আয়তন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮৫ বর্গকিলোমিটার। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে চলনবিলের ওপর দিয়ে নাটোরের বনপাড়া পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার যে মহাসড়ক নির্মিত হয়েছে সেই বিলপাড় এখন পুরোটাই ফসলের সবুজে ছেয়ে গেছে। এক বিন্দু পানিও নেই। বর্ষাকালে স্বাভাবিক বাতাসে চলবিলের জলরাশির মোহনীয়তা এখন আর ফুলে ফেঁপে ওঠে না। ঝাপটা বাতাসে উথলে ওঠা সেই ঢেউ আর চোখে পড়ে না। সেদিনের কথা স্মৃতি থেকে টেনে চাটমোহরের আব্দুল মান্নান পলাশ বললেন, গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বিলের ভূভাগ ভর বছর জলমগ্ন থাকত। বাকি ভূখ-ের কিছু অংশ দু’চার বছর পর জেগে উঠলে বোনা আমন ধানের আবাদ হতো। পরবর্তী দফায় জমি জেগে ওঠার আগে পর্যন্ত নাড়ায় গজিয়ে ওঠা কুশিতেই ধান গাছ হতো। ফলে নৌকা ও কোথাও সামান্য জায়গায় পায়ে হেঁটে যাতায়াত ছাড়া অন্য কোন বিকল্প ছিল না। জীববৈচিত্র্যের এই বিলের মাছ কলকাতায় নেয়ার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে। সেই জলরাশির পরিবর্তনের পালা শুরু বেশি দিনের নয়। গত শতকের ৮০’র দশকে বিল শুকিয়ে যাওয়ার পালা শুরু হলে কৃষিতে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। পলি বিধৌত আবাদী জমি এতটাই উর্বরতা এনে দেয় যে ধান পাট গম যব ভুট্টা সবজি ফলতে বেশিদিন সময় নেয় না। বিশেষত পানি না থাকা সকল জমিতে সব ধরনের ধানের আবাদ শুরু হয়। একই সঙ্গে যোগাযোগ অবকাঠামোর বিস্তৃতি ঘটতে থাকে।
×