ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০

প্রকাশ্যে যাই বলুক না কেন, নেপথ্যে কোন্ মিশন

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২২ মার্চ ২০১৬

প্রকাশ্যে যাই বলুক না কেন, নেপথ্যে কোন্ মিশন

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ এ দেশের স্বাধীনতার মহানায়ককে যারা এখনও জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার করতে চায় না, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এ বাঙালীকে বঙ্গবন্ধু বলতেও কণ্ঠে বাঁধে- রাজনীতির নামে ইতোমধ্যেই দেশের সর্বনাশ ঘটিয়ে সেনা ছাউনিতে জন্ম নেয়া বিএনপি নামের সেই রাজনৈতিক দলটি নতুন করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন যে দেখছে তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে হাস্যকর পরিস্থিতি ছাড়াও জল্পনা-কল্পনার নানা ডালপালার জন্ম দিয়েছে। উল্লেখ্য, গত ১৯ মার্চ ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দলের ষষ্ঠ কাউন্সিলের উদ্বোধনী বক্তব্যে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তার উদ্বোধনী বক্তব্যে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণাকালে জ্যোতিষীদের মতো করে বলেছেন, ‘ভবিষ্যত আমাদেরই’। এর পাশাপাশি তিনি জনগণের উদ্দেশে নতুন কিছু বক্তব্যও দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ক্ষমতায় গেলে তার দল দু’কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ করবেন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার ব্যবস্থা করা হবে, সংবিধানে গণভোটের ব্যবস্থা রাখা হবে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা হবে। তিনি আরও ঘোষণা দেন, ক্ষমতায় গেলে, আমরা দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করব না, নিজেরাও দুর্নীতি করব না, অন্যদেরও দুর্নীতি করতে দেয়া হবে না, দুর্নীতি বন্ধ করতে ন্যায়পাল আবারও কার্যকর করা হবে। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কাউকে হেনস্তা করা হবে না, কারও প্রতি অবিচার করা হবে না ইত্যাদি। বিএনপির পক্ষে ঘোষিত এই ভিশন এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে সহসা তা করা হবে বলে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপির পক্ষে বেগম জিয়ার এ ঘোষণার পর রাজনৈতিক বোদ্ধামহলে একটি প্রশ্নই প্রাধান্য পাচ্ছে। সেটি হচ্ছে- ভিশন ২০৩০ ঘোষণাকারী বিএনপির বর্তমান গোপন মিশন যদি যুদ্ধাপরাধী স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী জামায়াত, জঙ্গী তৎপরতা ও দেশবিরোধী অপকর্মে লিপ্তদের সঙ্গে সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে বজায় থাকে এবং পুরো গোপন মিশনের বিষয়বস্তু নিয়ে এসব স্বাধীনতাবিরোধী ও দেশবিরোধীর সঙ্গ ছাড়ার প্রকাশ্য ঘোষণা না আসেÑ তাহলে সচেতন মহল ও নতুন প্রজন্মের ভোটারদের পক্ষে অনাগত দিনগুলোতে বিএনপির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ইতিবাচক কোন পথ খোলা নেই। কেননা, নতুন প্রজন্মের ভোটারদের কাছে ইতোমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেছে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, একাত্তর ও একাত্তর পূর্ব কাদের কি ভূমিকা ছিল, স্বাধীনতা যুদ্ধে কারা অংশ নিয়েছে, আর কারা এর বিরোধিতা করে পাক হানাদার বাহিনীকে সহায়তা দিয়ে গণহত্যা চালিয়েছে, মা-বোনদের ইজ্জত সম্ভ্রম লুটের সুযোগ করে দিয়েছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকের বাড়িঘর, জমিজমা দখল করে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশ স্বাধীনতা হওয়ার পর থেকেই এ পর্যন্ত কারা ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করতে তৎপর থেকেছে, যারা দেশকে পাকিস্তানি কায়দায় নিয়ে যেতে অতি তৎপর হয়েছে এবং এদের মূল সহযোগীর তৎপরতায় বিএনপির যে পরিষ্কার অবস্থান তা এখন আর কারও কাছে অজানা নয়। এ কারণেই বর্তমান সরকার আমলে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও অভিযুক্তদের শাস্তি কার্যকর হওয়ার বিষয়টি স্বাধীনতার পক্ষের সকল মহলে স্বীকৃতি পেয়েছে। রাজনৈতিক মহলের সূত্রগুলো বলছে, মৌলবাদী জামায়াত, যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে বিএনপির পক্ষে পরিষ্কার কোন ঘোষণা কাউন্সিলে না আসায় অপেক্ষাকৃত কম বয়সের বিএনপি সমর্থকরা ব্যাপকভাবে হতাশ হয়েছে। তাই এদেরই অনেকের মুখে বেগম জিয়ার ক্ষমতায় যাওয়ার আগাম স্বপ্নের বাণীকে ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’Ñ প্রবাদ বাক্যের সঙ্গে তুলনা করছেন। টানা দীর্ঘদিন ঢাকঢোল পিটিয়ে সারাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ঢাকায় একত্রিত করে কাউন্সিল থেকে বেগম জিয়ার ‘কাটছে আঁধার, আসছে আলো’ শিরোনামে লিখিত বক্তব্যের সারাংশ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নেতাকর্মী ও সমর্থকরা পুলকিত হতে পারেননি। কারণ তারা সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আশার কোন আলো দেখতে পাননি। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, বিএনপিকে ঘুরে দাঁড় করানোর প্রশ্নে বেগম জিয়া সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা দিতে পারেননি। শুধু বলেছেন, আপনারা জেগে উঠুন, ‘ভবিষ্যত আমাদেরই’। প্রশ্ন উঠেছে, ইতোপূর্বে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে এবং এর পরবর্তীতে বেগম জিয়ার বিভিন্ন আহ্বানে নেতাকর্মী ও সমর্থকরা সাড়া দেয়ার পর সফলতার ঘর রয়েছে একেবারেই শূন্য। বিভিন্ন ধরনের নাশকতা, বোমাবাজি, মানুষ হত্যাসহ জনবিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরাট একটি অংশ গ্রেফতার ও মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে এখন ধুঁকছে। দলটির পুনরায় নির্বাচিত সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে পলাতক অবস্থানে থেকে যাবতীয় কর্মকা- চালিয়ে গেলেও দেশে এসে সরকারদলীয় রাজনীতিকে মোকাবেলা করার সৎ সাহস হারিয়ে ফেলার জোরাল অভিযোগ উঠার পর কাউন্সিলে তার ভিডিও রেকর্ড করা বক্তব্য প্রচার করা হয়। তারেক রহমানের এ বক্তব্য নেতাকর্মী ও সমর্থকদের দৃষ্টি আকর্ষণে কার্যকর তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি বলে ইতোমধ্যেই নানা কথা উঠেছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বর্তমানসহ দুই টার্মে ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিকসহ উন্নয়নমূলক যে চমক দেখিয়েছে তাতে চরম আওয়ামী লীগ বিরোধীরাও নেতিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, দেশকে এগিয়ে নিতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত শক্তিশালী দেশকেও রীতিমতো বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পিছপা হয়নি। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ার আগেই অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগের যে সুস্পষ্ট জবাব সরকার দিয়েছে তা সচেতন মহলে আশার সঞ্চার করেছে। শুধু তাই নয়, এ সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হওয়া ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক পদকও অর্জন করেছে। অর্জনের এ ফিরিস্তি ইতোমধ্যেই এত দীর্ঘ হয়েছে যে, বিএনপি এর বিপরীতে গিয়ে এ দলকে টপকিয়ে পুনরায় ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ ইতোপূর্বেকার সময়ের চেয়ে বহু কঠিন পর্যায়ে চলে গেছে। সূত্রে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার রাজনীতিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটকে যে রাজনৈতিক মার দিয়েছে তা বিএনপি কখনও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। ইসলামের ব্যানারে কিছু ইসলামী নামের দলগুলোকে নিয়ে বিএনপি শক্তি সঞ্চার করে আওয়ামী লীগকে আঘাত করার যে নীল নক্সা এঁকেছিল তা অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে গেছে। বর্তমান সরকারী দল বিএনপি ও এর সমর্থনকারী দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকা-ের মাজা এমনভাবে ভেঙ্গে দিয়েছে তা এখনও সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মতো হয়নি। এ অবস্থায় রাজধানীতে ঢাকঢোল পিটিয়ে দীর্ঘ ছয় বছর পর কাউন্সিল আহ্বান করে বিএনপি নেত্রীর প্রায় সোয়া এক ঘণ্টার লিখিত বক্তব্য উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি করার যে প্রত্যাশা তারা করেছিল তা আঁতুড় ঘরেই মরেছে। কাউন্সিলে অংশগ্রহণ শেষে ফিরে আসাদের অধিকাংশই হতাশ। তাদের মুখ দিয়ে বের হচ্ছে ‘যে লাউ সেই কদু’। রাজনৈতিক বোদ্ধামহলের সূত্রগুলো অভিন্ন সুরে বলছে, বর্তমান সরকার বিরোধী দলকে সভা সমাবেশ বা আন্দোলন সংগ্রামের জন্য এখন তেমন কোন বাধা দিচ্ছে না। তবে সশস্ত্র হামলা, বোমাবাজি, আগুন, লুটতরাজের সঙ্গে লিপ্ত হলেই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ বদ্ধপরিকর। বিষয়টি খুব ভালভাবেই আঁচ করতে পারায় বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকরা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি তো নয়, মাঠে নামতেও ভীতি সন্ত্রস্ত্র। এছাড়া ক্ষমতা থেকে দলটি যখন দীর্ঘ সময় ধরে ছিটকে পড়ে আছে তখন হালুয়া রুটির ভাগ-বাটোয়ারা থেকেও নেতাকর্মী ও সমর্থকরা বঞ্চিত হয়ে আছে। আর হালুয়া-রুটির ভাগ না পেলে নেতাকর্মীদের মাঠে নামানোর বেশ যে কঠিন তা এদেশের সকলেরই জানা। সূত্র জানায়, রাজনৈতিক অধিকাংশ দলের অবস্থা এমন হয়েছে যে, সবাই নেতাকর্মীর পদ পেতে চান। আর পদ পেলেই নানা অনিয়ম অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে ‘টু পাইস’ কামানোর পথ খোলাসা হয়ে যায়। এই ‘টু পাইস’ কামিয়ে তার একটি অংশ বিতরণের মাধ্যমে কর্মী ধরে রাখার নিয়ম বর্তমানে রাজনৈতিক একটি কালচারালে পরিণত হয়ে আছে। সঙ্গত কারণে বলা যায়, ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ার পর বিএনপির নেতাকর্মীদের অবৈধ অর্থের ভা-ার ইতোপূর্বেকার চেয়ে রুগ্ণ অবস্থায় রয়েছে। শীর্ষস্থানীয় নেতারা নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সদা তৎপর রয়েছেন। যেখানে প্রয়োজন সেখানে চাহিদার যোগান দিচ্ছেন। ফলে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অবস্থার কোন পরিবর্তন আসছে না। এ অবস্থায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের ‘ভবিষ্যত আমাদেরই’Ñ বলে যে ঘোষণা এসেছে তাতে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থক মহলে তেমন কোন উজ্জীবনী শক্তির জন্ম দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। ভিশন ২০৩০ থেকে শুরু করে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ সংবিধানে গণভোটে ব্যবস্থাকরণ ইত্যাদিসহ যেসব বক্তব্য খালেদা জিয়ার কাছ থেকে এসেছে তা আমজনতার কাছে লোভনীয় কোন বক্তব্য হিসেবে গৃহীত হয়নি। সাধারণ মানুষ নিজেদের উন্নয়নের জন্য দেশের উন্নয়ন খোঁজে। তিনবার ক্ষমতায় থেকে যে বিএনপি দেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো মৌলবাদী, যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গীবাদীদের সঙ্গে গাটছড়া বেঁধে দেশের সর্বনাশ ঘটিয়েছে তাদের মুখে নতুন আশার আলো প্রদর্শনের বিষয়টি নতুন প্রতারণার শামিল হিসেবেই মনে করছে রাজনীতি সচেতন মহলের বিশাল একটি অংশ।
×