ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এক বছর আগেই রিজার্ভ থেকে টাকা চুরির পরিকল্পনা করে হ্যাকাররা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২০ মার্চ ২০১৬

এক বছর আগেই রিজার্ভ থেকে টাকা চুরির পরিকল্পনা করে হ্যাকাররা

রহিম শেখ ॥ এক বছর আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরির পরিকল্পনা করে হ্যাকাররা। আর দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে নজর রেখেছিল তারা। ধারণা করা হচ্ছে, ফিলিপিন্সে বসেই হ্যাকাররা এ জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, হংকং, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স ও বাংলাদেশী নাগরিকদের। হ্যাকার ছাড়াও এর মধ্যে রয়েছে একাধিক দেশের ব্যাংক, জুয়াড়ি চক্র ও ব্যাংকের কর্মকর্তারা। স্মরণকালের এ জালিয়াতির ঘটনায় ইতোমধ্যে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংকের জুপিটর শাখা ব্যবস্থাপক দিগুইতো। স্বাক্ষর জাল করে এ্যাকাউন্ট খোলার অপরাধে শনিবার তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। দিগুইতো বলেছেন, পুরো ঘটনাটি ঘটেছে ব্যাংকের সিইও লরেঞ্জো ট্যানের নির্দেশেই। যে চারটি এ্যাকাউন্টে রিজার্ভের টাকা পাচার হয়েছিল তারা ছিলেন ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী ট্যানের পরিচিত। দেশটির একটি সূত্র বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ জালিয়াতির অন্যতম হোতা হিসেবে দেখা হচ্ছে এই ট্যানকে। এ ঘটনায় চীনা ব্যবসায়ী কিম অং নামে আরও এক মূল হোতার নাম এসেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। ফিলিপিন্স স্টক একচেঞ্জ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ট্যান ও কিম অং খুব অল্প সময়ে ‘ধনকুবে’র বনেছেন। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা হ্যাকিংয়ের ঘটনায় ফিলিপিন্সের ব্যাংকিং সিস্টেম বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। পুরো প্রশাসন থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, সাধারণ মানুষের সমালোচনার মুখে পড়ে ব্যাংকিং সিস্টেম। দেশটির গণমাধ্যমেও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে প্রতিদিন প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। সূত্র বলছে, ব্যাংকিং সিস্টেমের মধ্যেই এমন জালিয়াতি হওয়ার আন্তর্জাতিক চাপে পড়েছে দেশটির বৈদেশিক ব্যাংক লেনদেন। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বেশকিছু দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করেছে ফিলিপিন্সের সঙ্গে। কিন্তু হঠাৎ কেন এই সতর্কতা! খোদ ফিলিপিন্সের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রিজার্ভ এ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরি হয়ে কেন ফিলিপিন্সে এলো? কারা এর সঙ্গে জড়িত! অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যে এ্যাকাউন্টগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করা হয়েছে ফিলিপিন্সে তা খোলা হয়েছিল প্রায় এক বছর আগেই। গেল বছরের ১৫ মে এই হিসাব খোলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় টাকা পাচারের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এর মধ্যে অন্যের সই জাল করে একটি হিসাব খুলেন ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংকের জুপিটর শাখা ব্যবস্থাপক দিগুইতো। ওইসব এ্যাকাউন্ট খোলার জন্য যেসব ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল সেগুলোও ছিল ‘ভুয়া’। ওই চারটি এ্যাকাউন্ট যাদের নামে খোলা হয় তারা হলেন এনরিকো টিওডোরো ভাসকুয়েজ, আলফ্রেড স্যান্তোষ ভারগারা, মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ ও জেসি ক্রিস্টোফার ল্যাগ্রোসাস। ৫০০ ডলার দিয়ে এ্যাকাউন্ট খোলার পর প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও এ সময়ে কোন লেনদেন হয়নি। জমা পড়েনি কোন অর্থ। উত্তোলনও করা হয়নি। চারটি এ্যাকাউন্টে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ৮১ মিলিয়ন ডলার জমা হয় ৫ ফেব্রুয়ারি। ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ওই এ্যাকাউন্ট জব্দ করার অনুরোধ পাঠায় বিকেল ৫টায়। ওইদিন ব্যাংক ছুটি থাকায় কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ নেয়নি। পরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি শাখা ব্যবস্থাপক ওই অনুরোধ পাওয়ার পরও তিনি চার এ্যাকাউন্টের অর্থ পরিশোধ করে দেন। ওই চার এ্যাকাউন্টে পরিশোধ হয় ক্রিস্টোফার লাগরোসাস ৩০ মিলিয়ন, আলফ্রেড ভারগারা ১৯.৯৯ মিলিয়ন, এনরিকো ভাসকুয়েজ ২৫ মিলিয়ন ও মাইকেল ক্রুজের ৬ মিলিয়ন ডলার, যা দুটি ক্যাসিনোতে চলে যায়। এই চারজনের এ্যাকাউন্ট খুলতে যে তথ্য জমা দেয়া হয়েছিল সেটা পুরোপুরি ভুয়া। এর মধ্যে লাগরোসাসের আলাদা ডিপোজিট এ্যাকাউন্ট করে সেখানে ২২ মিলিয়ন ডলার জমা করেন এবং গার্মেন্ট ব্যবসায়ী উইলিয়াম সোগো নামে একজনের এ্যাকাউন্টে দুটি অর্ডারের মাধ্যমে ১৪.৭ মিলিয়ন ডলার জমা হয়। এরপর ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করে ওই শাখা ব্যবস্থাপক তার গাড়িতে করে নিয়ে যান ২০ মিলিয়ন পেসো (স্থানীয় মুদ্রা)। বাকি টাকাগুলো উইলিয়াম সো গো এবং ফিলরেম মানি রেমিটেন্স কোম্পানির এ্যাকাউন্টে যায়। পরে সেখান থেকে রিজার্ভ জালিয়াতির টাকা ক্যাসিনো হয়ে হংকং চলে আসে। এর মধ্যে কিম অং নামে হংকংয়ে এক ব্যক্তির কাছে চলে যায় বড় অংশ। এখানেই ৬৮ হাজার ডলার জমা রয়ে যায়। পরে ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই অনুরোধ পরিপালন করে এ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করা হয়। লেনদেনের পরও ওই ৬৮ হাজার ডলার জব্দ করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। শাখা ব্যবস্থাপক ওই এ্যাকাউন্টগুলোতে হ্যাক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা নিয়ে আসা হয়েছে শুরু থেকেই জানতেন। জানার পরও ডলার জমা হলে তড়িঘড়ি করে তা ট্রান্সফার করা হয়। ক্যাসিনোর কর্মকর্তা উইক্যাং জু চীনের নাগরিক। তার মাধ্যমে এই অর্থ হংকংয়ে কিম অং নামের এক ব্যক্তিকে পাঠানো হয়। উইক্যাং জু বর্তমানে সিঙ্গাপুরে রয়েছেন। এসব ঘটনায় বিস্মিত ফিলিপিন্সের তদন্তকারীরা। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো ব্যাংকের ওই শাখায় ৪ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোন সিসিটিভিগুলোও কার্যকর ছিল না। এই সময়ে ২০ মিলিয়ন ডলার অর্থ স্থানান্তর করা হয় শ্রীলঙ্কায়। এদিকে সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ফায়ারআইইঙ্ক এবং ওয়ার্ল্ড ইনফরমেট্রিক্সের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা অন্তত এক বছর আগে করা হলেও ঘটনার দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে নজর রেখেছিল হ্যাকাররা। হ্যাকাররা সার্ভার হাউজে ম্যালওয়্যার বসিয়ে দেয় যাতে টাকা সত্যিকার অর্থেই হস্তান্তর হয়। বের হয়ে যাওয়ার আগে হ্যাকারদল নিজেদের সবগুলো কাজের ইতিহাসও মুছে দিয়ে যায়। টাকা ট্রান্সফার করার আগে তারা নেটওয়ার্কে ঢুকে এমন একটি সফটওয়্যার ইন্সটল করে যা আবারও সেই সফটওয়্যারে কাজ করা নিশ্চিত করবে। দীর্ঘদিন সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে জেরুজালেম ভিত্তিক কোম্পানি সাইবারআর্ক। প্রতিষ্ঠানটির একজন পরিচালক আন্দ্রে ডালকিনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফিলিপিন্সে বসেই হ্যাকাররা বাংলাদেশের রিজার্ভ এ্যাকাউন্ট থেকে টাকা লোপাটের চেষ্টা করে। এ জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, হংকং, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স ও বাংলাদেশী নাগরিকদের। হ্যাকার ছাড়াও এর মধ্যে রয়েছে একাধিক দেশের ব্যাংক, জুয়াড়ি চক্র ও ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ফিলিপিন্সের আর্থিক খাতে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় জালিয়াতির ঘটনা হিসেবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। দেশটির সর্বোচ্চ আইন প্রণয়ন সংস্থা সংসদের উচ্চ কক্ষ সিনেট কমিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব কর্তৃপক্ষকে ডেকে শুনানি করেন। শুনানিতে উঠে আসে জালিয়াতির ভয়াবহ চিত্র। শুনানিতে ডাকা হয়, আরসিবিসির চেয়ারম্যান হেলেন ওয়াই ডি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক লরেন্স ট্যান, জুপিটার স্ট্রিট শাখা ব্যবস্থাপক মাইয়া স্যান্তোস দিগুইতো, রেমিটেন্স লেনদেন কোম্পানি ফিলরিমের প্রেসিডেন্ট বাতিস্তা, পাচারের ব্যবহৃত এ্যাকাউন্ট হোল্ডার ব্যবসায়ী উইলিয়াম সো গোকে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে এক বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর কীভাবে নজরদারি করে এই টাকা চুরি করা হয়েছে তার বিস্তারিত তথ্য। কীভাবে একের পর এক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়েছে হংকংয়ে। শুনানিতে রিজার্ভ জালিয়াতির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অকপটে স্বীকার করে আরসিবিসি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মায়া স্যান্তোস দেগুইতো বলেছেন, আমি জানতাম এগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এ্যাকাউন্ট লুটের টাকা। তবে তিনি বলেছেন, পুরো ঘটনাটি ঘটেছে ব্যাংকের সিইও লরেন্স ট্যানের নির্দেশেই। যে চারটি এ্যাকাউন্টে রিজার্ভ পাচার হয়েছিল তারা ছিলেন ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহীর ট্যানের পরিচিত। এদিকে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন এএমএলসি তদন্ত কমিটি গঠন করে হ্যাক হওয়ার পর থেকে পুরো লেনদেন কার্যক্রমের বিষয়টি তুলে ধরে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে। দেশটির বিচার বিভাগও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে মামলা দায়ের করেছেন। গত ১৫ মার্চ বিচার বিভাগ মামলা দায়ের করে আগামী ১৯ এপ্রিল শুনানিতে ডেকেছেন ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব পক্ষকে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে হংকংয়ে পাচার করা রেমিটেন্স কোম্পানি ফিলরিম, দুই ক্যাসিনোর কার্যক্রম। দিগুইতোর বিরুদ্ধে মামলা ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় আরসিবিসি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মায়া স্যান্তোস দিগুইতো এবং তার সহকারীর বিরুদ্ধে স্বাক্ষর জাল করে এ্যাকাউন্ট খোলার অভিযোগে মামলা করেছেন উইলিয়াম গো নামে এক ব্যবসায়ী। শনিবার মামলাটি দায়ের করা হয়। এর আগে শুক্রবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিটের ম্যানেজার মায়া স্যান্তোস দিগুইতোসহ পাঁচজনকে তলব করে দেশটির বিচার বিভাগ। এ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের করা মামলায় তাদের তলব করা হয়। আগামী ১২ ও ১৯ এপ্রিল মায়াসহ অভিযুক্ত পাঁচজনকে প্রয়োজনীয় নথি ও সাক্ষীসহ হাজির হওয়ারও নির্দেশ দিয়েছে বিচার বিভাগ। মূল হোতা কিম অং ॥ চীনা ব্যবসায়ী কিম অং। বেশিরভাগ সময় ফিলিপিন্সই কাটান। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে একটি গার্মেন্টস ও তিনটি রেস্টুরেন্টের মালিক তিনি। এছাড়া গলফ ও টেনিস ক্লাবের সদস্য অং। শুধু তাই নয়, প্রতারণা ও অবৈধ কর্মকা-ের খাতায় বহু আগেই নাম লিখিয়েছেন এ ধনকুবের। তবে ফিলিপিন্সের পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ভাল সম্পর্কের কারণে পার পেয়ে যান বারবার। ফিলিপিন্স স্টক একচেঞ্জর ওয়েবসাইট ঘেঁটে এসব তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনায় উঠে এসেছে তার নাম। ফিলিপিন্সের সিনেট কমিটির চেয়ারপার্সন সার্জেই অসমেনা মনে করেন, রিজাল ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির মূল পরিকল্পনাকারী এই কিম অং।
×