ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এক বছরে ৪শ’ ১২টি মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার

বাল্যবিয়ে রুখতে সাতক্ষীরায় লালকার্ড প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বাল্যবিয়ে রুখতে সাতক্ষীরায় লালকার্ড প্রকল্প

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা থেকে ॥ সাতক্ষীরা জেলায় বাল্য বিয়ে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সংক্রামক ব্যাধির মতো বাল্যবিয়ের প্রবণতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে গোটা জেলায়। ২০১৫ সালে শুধু সাতক্ষীরা সদর উপজেলাতেই ৪শ’ ১২টি মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাল্যবিয়ে বন্ধে ৫৫টি মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করে তাৎক্ষণিক বাল্যবিয়ে বন্ধ করা গেলেও এদের মধ্যে ৫৩টি শিশুই পরবর্তীতে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এরা আর স্কুলে ফিরে আসেনি। আর এই বাল্যবিয়ের প্রবণতা রুখতে ছাত্রী ও অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে সদর উপজেলায় শুরু হয়েছে “শিক্ষাই প্রথম- বাল্যবিবাহকে লালকার্ড” শীর্ষক মোটিভেশন কার্যক্রম। সদর উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা নারী উন্নয়ন ফোরাম পরিকল্পনা ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। আর এতে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছে বেসরকারী সংস্থা ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স। এই লালকার্ডের স্লোগান হলো “থাকলে শিশু বিদ্যালয়ে, হবে না বিয়ে তার বাল্যকালে, থাকলে শিশু লেখাপড়ায়, সফল হবে সে জীবন গড়ায়।” এরই কার্যক্রমে বুধবার দুপুরে সদর উপজেলার ঝাউডাঙ্গা হাইস্কুল মাঠে আয়োজন করা হয় “লালকার্ড দেখিয়ে বাল্যবিবাহকে বিদায়” শীর্ষক সমাবেশ। ইউনিয়নের বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ৫ম থেকে ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবকদের উপস্থিতিতে সকলের হাতে তুলে দেয়া হয় বাল্যবিবাহকে লালকার্ড শীর্ষক কার্ড। এই কার্ডে রয়েছে উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদের হটলাইন নাম্বার। এই কার্ডগুলো ছাত্রীরা সংরক্ষণ করবে। নিজের বা বান্ধবীদের বাল্যবিয়ে ঠেকাতে তারা এইকার্ডের নাম্বার ব্যবহার করবে। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি। উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু, নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ আব্দুল সাদী, প্রেসক্লাব সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, অধ্যক্ষ মোঃ খলিলুর রহমান, কোহিনুর ইসলাম, শরিফুল ইসলাম বিশেষ অতিথি হিসাবে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। ইউনিয়নকে বাল্যবিয়েমুক্ত রাখতে পাঠ করা হয় ঘোষণা পত্র। উপজেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্যানুযায়ী ২০১৫ সালে শুধু ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নেই ৩৫টি মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এই বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে ১৮টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হলেও পরবর্তীতে ১৮টি মেয়েই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এরা আর স্কুলে ফিরে আসেনি। বাল্যবিয়েকে লালকার্ড শীর্ষক এই উদ্বুদ্ধকরণ প্রকল্পে ইতোমধ্যে ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের ২৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৫ম থেকে ১০ম শ্রেণীর ২০ হাজার ১শ’ ৬৩ জন ছাত্রীকে দেয়া হয়েছে শিক্ষাই প্রথম- বাল্য বিয়েকে লাল কার্ড । বিভিন্ন স্থানে টানানো হয়েছে বিলবোর্ড। এই প্রকল্পে ইতোমধ্যে ইউনিয়নের ২৪টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, মাদরাসা অধ্যক্ষ, গ্রামপুলিশ, ইউপি সচিব, কাজী, ইমাম, পুরোহিতকে দেয়া হয়েছে লালকার্ড বিষয়ক প্রশিক্ষণ। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গঠন করা হয়েছে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধী শিশু কিশোর রেডকার্ড দল। বাল্যবিয়েকে লালকার্ড প্রকল্পের প্রত্যাশিত ফলাফলে বাল্যবিয়ের আয়োজন বিষয়ে প্রশাসন সময়মতো তথ্য পাবে। শিশুটি বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়বে না। মেয়েটি সামাজিক, আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এই লাল কার্ডের প্রত্যাশিত প্রভাবে ছাত্রীদের ড্রপআউটের সংখ্যা কমে আসবে। মেয়েদের শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাবে। মেয়েরা পরিণত হবে মানবসম্পদে। মেয়েদের অধিক কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়ন হবে এবং মেয়েদের অপরিণত বয়সে বিয়ে ও সন্তান ধারণজনিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমে আসবে। ইতোমধ্যে সদর উপজেলার ভোমরা ইউনিয়নে বাস্তবায়িত এই লালকার্ড প্রকল্পে ৫টি মেয়ে হেল্পলাইনের সহযোগিতা নিয়ে তাদের বাল্যবিয়ে রোধ করতে পেরেছে। এদের মধ্যে শাখরা কোমরপুর স্কুলের অষ্টমশ্রেণীর ছাত্রী, ভোমরা দাখিল মাদ্রাসার ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী, পল্লীশ্রী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী, আলিপুর ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী ও ভোমরা কোমরপুর স্কুলের নবম শ্রেণীর এক ছাত্রী লালকার্ডে দেয়া হটলাইন নাম্বারে যোগাযোগ করে তাদের বাল্যবিয়ে ঠেকাতে পেরেছে। তারা এখন নিয়মিত স্কুল করছে।
×