ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মার্কিন সিনেটে শুনানি ॥ বাংলাদেশে বিদেশী হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে বিএনপি ও জামায়াত, এমন বক্তব্যই উঠে এসেছে

হাসিনা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করাই লক্ষ্য

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

হাসিনা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করাই লক্ষ্য

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকদের হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। মার্কিন সিনেটে মঙ্গলবার বৈশ্বিক হুমকির বিষয়ে অনুষ্ঠিত এক শুনানিতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেমস ক্ল্যাপারের বক্তব্যে এসব কথা উঠে এসেছে বলে জানা গেছে। মার্কিন সিনেটে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহনশীলতাসম্পন্ন একটি মুসলিম রাষ্ট্র, তবে দেশটিতে চরমপন্থী সহিংস কর্মকা- ধীরে ধীরে বাড়ছে। বাংলাদেশে বিদেশী নাগরিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হওয়া ১১টি গুরুতর হামলার দায় স্বীকার করে নিয়েছে ইসলামিক স্টেট। এছাড়া ২০১৩ সাল পর্যন্ত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আল-কায়েদা বাংলাদেশের ১১ জন প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগারকে হত্যা করার কথা উল্লেখ করে মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান বলেছেন, বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উপস্থিতির কথা বারবারই অস্বীকার করেছে শেখ হাসিনা সরকার। মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান জেমস ক্ল্যাপার মার্কিন সিনেটের শুনানিতে আশঙ্কা করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেয়া বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা বাড়তে পারে। বিশ্বব্যাপী হুমকির বিষয়ে মার্কিন সিনেটে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত শুনানিতে লিখিত বক্তব্যে তিনি এ আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেন। এদিকে শেখ হাসিনা সরকার দেশটিতে আইএসের উপস্থিতি নাকচ করে দিয়ে সহিংসতার জন্য দেশটির সরকার স্থানীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করছে। মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান বলেন, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বয়কট করার পর থেকে রাজনৈতিক উত্তেজনা চলছে। এছাড়া ১৯৭১ সালে মুক্তযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত অভিযোগে জামায়াতে ইসলামির নেতাদের বিচার নিয়েও দেশটিতে উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মার্কিন সিনেটে গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের বক্তব্যে বিদেশী হত্যাকা-ের বিষয়ে বিএনপি-জামায়াত যে জড়িত, তা ইতোমধ্যেই ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। দুই বিদেশী হত্যাকা- নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রতিবেদনে বিএনপি-জামায়াতের প্রতি সরকারের সন্দেহ করার পর বিশেষ অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা নেয় সরকার। ধরা পড়ে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। পলাতকও আছে অনেকেই। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন প্রকাশের পর দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকা- ঘটানোর ঘটনায় প্রভাবশালী বিদেশী দেশগুলোর সন্দেহের চোখে আছে বিএনপি-জামায়াতকে। এখন আবার একই কথা বলেলেন মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান জেমস ক্ল্যাপারও। সরকারের পতন ঘটাতে পেট্রোলবোমার সহিংস সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালিয়ে নাশকতা, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ নিরীহ নির্দোষ মানুষজনকে পুড়িয়ে মেরে হত্যা করেছে বিএনপি-জামায়াত। বিদেশী দেশসমূহের দৃষ্টি আকর্ষণ, সমর্থন, সহযোগিতা পাওয়ার আশায় তারা সহিংস সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়। দেশী-বিদেশী এনজিও, মানবাধিকার সংস্থা, বিদেশী দেশগুলোর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় তাদের আন্দোলন ব্যর্থ হয়। এবার আবার তারা নতুন কৌশলে বিদেশী নাগরিক হত্যাকা- ঘটানো বেছে নিয়ে জঙ্গী সংগঠন আইএসের নাম ভাঙ্গিয়ে বিদেশী দেশসমূহের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে তাদের সন্দেহের চোখে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকা-ের ঘটনার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেছেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়ও ফেসবুকের স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছেন, দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকা-ের ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছেন এবং এটা লন্ডন বিএনপির পক্ষে এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। বিদেশী হত্যাকা-ে বিএনপি-জামায়াত জড়িত এমন দাবি করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, খুব নির্ভরযোগ্য একটা সূত্র থেকে আমি জেনেছি যে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বিদেশী হত্যাকা-ে বিএনপি-জামায়াত জড়িত। অত্যন্ত মরিয়া হয়ে তারা এটা করছে যাতে বিদেশী সরকারগুলো আমাদের দেশের বিরাগভাজন হয় এবং দেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। লন্ডন বিএনপির ভেতর থেকে এ তথ্য এসেছে বলেও দাবি করেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা জয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিজ কার্যালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, সজিব ওয়াজেদ জয় প্রমাণ পেয়েই এমন কথা বলেছেন, তার বক্তব্য গুরুত্ব সহকারে নেয়া হয়েছে এবং তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। এরপরই দুই বিদেশী নাগরিক খুনের ঘটনা ঘটাতে বিএনপি-জামায়াত কাদেরকে নিয়োগ করেছে এবং লন্ডন ষড়যন্ত্রে কারা জড়িত তা চিহ্নিত করতে মাঠে নেমেছেন গোয়েন্দারা। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃত জেএমবি ও হুজির শীর্ষ স্থানীয় নেতারা গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে জামায়াতের সঙ্গে তাদের গোপন যোগাযোগের কথা স্বীকার করেছেন। তারা জানান, প্রথম ও দ্বিতীয় সারির বিপুলসংখ্যক নেতাসহ তাদের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে জামায়াতে যোগ দিয়েছে। এ ছাড়াও নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীর, জেএমজেবি, হিযবুত তাওহিদ, ইসলামী সমাজ, উলামা আঞ্জুমান আল বাইয়্যিনিয়াত, ইসলামী ডেমোক্রেটিক পার্টি, জাগ্রত মুসলিম জনতা, আল্লার দল, শাহাদাৎ ই হিকমা পার্টি বাংলাদেশ, তামির আ-দ্বীন বাংলাদেশ ও তৌহিদী ট্রাস্টসহ প্রায় চার ডজন জঙ্গী সংগঠনের অর্ধ লক্ষাধিক দলছুট সদস্য জামায়াতের পক্ষে কাজ করছে। মোটা অঙ্কের অর্থের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরিসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের দলে ভেড়ানো হয়েছে বলে গ্রেফতারকৃত জঙ্গী নেতারা দাবি করেছেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে জামায়াত আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবা, জইশে মোহাম্মদ, ইন্ডিয়ান মুজাহিদীন, হরকাতুল মুজাহিদীন, ইন্দোনেশিয়ার জেমাহ ইসলামিয়াকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের মুখপাত্র ও গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে জঙ্গী কানেকশনের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত পাওয়ার পর থেকেই পুলিশকে সর্বোচ্চ সতর্ক রাখা হয়েছে। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের গতিবিধি নজরদারিতে রাখা হয়েছে। বিশেষ করে দলের জঙ্গী কানেকশন খতিয়ে দেখতে গোয়েন্দারা তৎপর রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, জামায়াতের সঙ্গে জঙ্গী সংগঠনগুলোর লিংকআপ নতুন করে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সক্রিয় সব জঙ্গী সংগঠনের কর্মতৎপরতা, অর্থের উৎস, সাংগঠনিক লক্ষ্য ও ভিত্তি খুঁজে দেখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অখ্যাত জঙ্গী সংগঠনও যেন বাদ না পড়ে এজন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী বিচার বাধাগ্রস্ত করতে বাধা-বিপত্তি আসতেই পারে। এজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সারাদেশে জঙ্গীবাদের কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করছে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে যারা রাজনীতি করে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে কার্যক্রম চালাতেই পারে। পাকিস্তান ও তার গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ইতোমধ্যেই বিএনপি-জামায়াতের সহায়তায় বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক জেমস ক্ল্যাপারের দেয়া বক্তব্যের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, মার্কিন সিনেটে যারা বক্তব্য দিয়েছে, আপনারা তাদের কাছেই জিজ্ঞাসা করুন। তারাই ভাল বলতে পারবেন। সিনেটে দেয়া প্রতিবেদনের বিষয়ে আমরা এখনই কোন মন্তব্য করতে চাইছি না। তবে তাদের প্রতিবেদনটি আমাদের কাছে পৌঁছলে সে বিষয়ে আমরা আমাদের বক্তব্য দেব। তখন আপনারাও বিষয়টি জানতে পারবেন।
×