ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আ-মরি বাংলা ভাষা

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

আ-মরি বাংলা ভাষা

রজতকান্তি বর্মন বায়ান্ন সালে সংঘটিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বয়স ৬৪ বছর হচ্ছে এবার। এতগুলো বছর পরেও রাষ্ট্র ও সমাজের ভাষা হতে পারেনি বাংলা। এখন দেশ স্বাধীন। বাংলা রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রের ভাষা আজও বাংলা হয়নি। এটা কারও ব্যক্তিগত সমস্যা নয়। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সমষ্টিগত সমস্যা। অনেক অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন সহ্য করে বাংলা ভাষা টিকে আছে। গোপনে প্রকাশ্যে ইংরেজী, হিন্দী ভাষার উৎপাত চলছে বাংলার ওপর। আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনভিত্তিক অনেক অর্জন আছে। আবার অসন্তোষ ও ব্যর্থতারও অনেক বিষয় আছে। যেমন শিক্ষাক্ষেত্রে দেশে এখন ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলের চেয়ে বেশি বৈষম্য বিরাজ করছে। ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলেও শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল। তবে এখনকার মতো এত বৈষম্য ছিল না। ভাষা আন্দোলনের মূল প্রত্যাশা ছিল বাংলা ভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলন হলো। অথচ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বস্তরে সেই ভাষা নেই। আমাদের জাতি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত মূলত ভাষাভিত্তিক। আমরা চেয়েছিলাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালতসহ সবখানে বাংলা ভাষার প্রচলন হোক কিন্তু তা হয়নি। এ রাষ্ট্রের মাতৃভাষার চর্চাই প্রধান হিসেবে গৃহীত হবে, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন-গবেষণা হবে বাংলা ভাষায় এটাই ছিল স্বাভাবিক। ব্রিটিশ, পাকিস্তান আমলেও বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত ছিল, অন্য ভাষার প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে আজ সেই প্রতিবাদ নেই। সচেতনতা নেই। যা হওয়া অনিবার্য ছিল। এ পরিণতি প্রত্যাশিত নয়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বিভাজনটা এখন তিন ধারার। মাতৃভাষার ভিত্তিতে অভিন্ন শিক্ষারীতি হওয়ার কথা ছিল। এসব ধারার শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের ঐক্যবদ্ধ করার বিভক্তিটা মূলত সামাজিক ক্ষেত্রে বিভাজনের ফল। এতে সমাজে বাড়ছে শ্রেণী-দূরত্ব। বাড়ছে বৈষম্য। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা এখনও আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার কিছু চ্যালেঞ্জও ছিল। সেজন্য বাংলায় বই লেখা এবং বিদেশি বই অনুবাদ করা দুটিরই দরকার ছিল। কাজগুলো গত বছরগুলোতে কিছুটা এগিয়েছে, তবে তা উল্লেখযোগ্য নয়। এখনও উচ্চস্তরের অধিকাংশ বই ইংরেজীতে লেখা। এটাও সত্য, সাহিত্য, প্রবন্ধ ও বিভিন্ন বিষয়ের বই বাংলায় প্রচুর লেখা হয়েছে। তবে মৌলিক ও উচ্চশিক্ষার জায়গাগুলোর জন্য বই লেখার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা আছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের এতগুলো বছর পরও বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ তুলে ধরতে পারছি না। বিশ্বকে বাংলা সাহিত্যের একটি সামগ্রিকতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারছি না। এ ব্যর্থতার দায়ভার আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর। বাংলাভাষার বিপদ ও শত্রুকে আমাদের চেনা দরকার। পাকিস্তান আমলেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে বাংলা। নানা সময়ে রাজনৈতিক কারণে বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ এসেছে। একসময় সংস্কৃত ভাষার দাপট বাংলা ভাষার ওপর চড়াও হয়েছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়- আরবী ফার্সি ভাষাও বাংলা ভাষার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়। ব্রিটিশদের শাসনামলে আমরা দেখেছি ইংরেজী ভাষার প্রসার ও কর্তৃত্ব তৎকালীন শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দ্বিভাষীতে পরিণত হয়েছিল। কেননা রাষ্ট্রের ভাষা ছিল ইংরেজী। তবুও সে সময় খুব জোরালোভাবে বাংলা ভাষার চর্চা চালানো হয়েছে। ইংরেজীর আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল। আমাদের সাহিত্যিকরা তাতে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। সম্প্রতি আরও একটি নতুন উৎপাত এসে জুটেছে। তা হলো হিন্দী চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে হিন্দী ভাষার উৎপাত। শিশুরাও হিন্দীর দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আবার এফএম রেডিওর ঘোষকরা ইংরেজী বাংলা মিশ্রিত অর্থাৎ বাংরেজীতে কথা বলে থাকেন। এরকম বলেন ডিয়ার লিসেনার্স বা এখন আমি অমুক সংটি অন করে দিচ্ছি। ব্রিটিশ বা পাকিস্তানী শাসনামলেও বাংলার যতটা বিকৃতি তারা করতে পারেনি, স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষার বিকৃতি ঘটেছে তার চেয়েও অনেক বেশি। গাইবান্ধা থেকে
×