ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আহসান মঞ্জিলে মসলিন নাইট

প্রকাশিত: ০৭:৫৬, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

আহসান মঞ্জিলে মসলিন নাইট

মনোয়ার হোসেন ॥ এক সময় বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছিল ঢাকাই মসলিন। বাংলার বয়নশিল্পীদের নির্মিত এই সূক্ষ্ম ও মসৃণ কাপড়টির আভিজাত্যে মুগ্ধ ছিল পুরো পৃথিবী। পরবর্তীতে নানা প্রতিবন্ধকতায় গৌরবের এই ইতিহাসটি ক্রমশ ধাবিত হয় বিস্মৃতির পথে। বাংলার মসলিন হারিয়ে যায় সুদূরে। হারানো সেই গৌরব ফিরিয়ে আনার কথাটিই বলা হলো আয়োজনজুড়ে। ঐতিহাসিক স্থাপনা আহসান মঞ্জিলে হয়ে গেল মসলিন পুনরুজ্জীবনের বর্ণিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শনিবার শীতের রাতে শৈল্পিকভাবে তুলে ধরা হলো বিশেষ এই বস্ত্রশিল্পটির অতীত-বর্তমান ও ভবিষতের কথা। মসলিন নাইট শীর্ষক হৃদয়গ্রাহী আয়োজনটি সাজানো হয় নৃত্যনাট্য ও ফ্যাশন শোর সম্মিলনে। আলো ও শব্দের প্রক্ষেপণে বর্ণিল অনুষ্ঠানটি যেন রূপ নেয় হারানো দিনের নতুন গল্পে। এতে অংশ নেন বাংলাদেশ, ভারত ও যুক্তরাজ্যের ১২ জন ডিজাইনার। মসলিনের নবজাগরণের প্রত্যাশায় অসাধারণ এ অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে দৃক, জাতীয় জাদুঘর ও আড়ং। বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষা ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ভবন আহসান মঞ্জিলের সিঁড়ির নিচে সাজানো হয় মুসলিম পুনর্জাগরণের পরিবেশনার মঞ্চটি। তিন ভাগে বিভক্ত পরিবেশনা পর্বের সূচনা হয় আলোকরশ্মির আশ্রয়ে মসলিন বোনার গল্প দিয়ে। প্রজেক্টরের সাহায্যে দেখানো হয় কেমন করে ফুটি কার্পাস বৃক্ষ থেকে তুলো সংগ্রহ করে তৈরি করে নির্মিত হয় মসলিন। আলোর খেলা শেষে উপস্থাপিত হয় নৃত্যনাট্য। মসলিনের ইতিহাস ও অজানা গল্প ফুটে ওঠে ‘হাওয়ায় ইন্দ্রজাল’ শীর্ষক নৃত্যনাট্যে। উপস্থাপন করে লুবনা মরিয়মের দল সাধনা। সায়মন জাকারিয়ায় চিত্রনাট্যে পরিচালনায় ছিলেন সাব্বির আহমদে খান। শিল্পীদের মুদ্রায় উঠে আসে মসলিনের বয়নশিল্পীদের সেই সুখময় অতীত। এরপর যেন নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা। আসে বেনিয়া। থমকে যায় মসলিনের অগ্রযাত্রা। নাচ শেষে খোলা আকাশের নিচে সমাগত দর্শককে যেন উদ্দীপ্ত করে ফ্যাশন শোটি। র‌্যাম্পে মসলিনের ভবিষ্যত ফ্যাশন মেলে ধরেন বাংলাদেশের রোকসানা সালাম, কুহু প্লামনডন, হুমায়রা খান ও তেনজিং চাকমা। যুক্তরাজ্যের প্রবাসী মডেলদের মধ্যে ছিলেন রেজিয়া ওযাহেদ, সাইফ ওসমানী, লাকী হোসেন এবং মসলিন ট্রাস্ট নামের প্রতিষ্ঠান। ভারতের মডেলদের মধ্যে র‌্যাম্পে অংশ নেন শান্তনু দাশ, অনীথ আরোরা, সৌমিত্র ম-ল ও দর্শন শাহ। ফ্যাশন শোটির কোরিওগ্রাফিতে ছিলেন আজরা মাহমুদ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। আলোচনায় অংশ নেন দৃকের সিইও সাইফুল ইসলাম, ব্যাক এন্টারপ্রাইজের জ্যেষ্ঠ পরিচালক তামারা আবেদ ও জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। অনুষ্ঠানটিন দর্শক সারিতে বসে উপভোগ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরসহ দেশী-বিদেশী অতিথিরা। গওহর রিজভী বলেন, আজ রাতে আমরা আমাদের ইতিহাসের একটি মুহূর্তকে স্মরণ করব। মসলিন আবার পুনরুজ্জীবিত হবেÑএ আয়োজনের মাধ্যমে সেই বার্তাটি ছড়িয়ে দেব। রাশেদ খান মেনন বলেন, এই মসলিন সন্ধ্যা আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করছে। যে মসলিন বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল সেই মসলিন আবার ফিরে আসছে এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এই মসলিন একদিন চীনের সিল্ক রুট দিয়ে রোমে গেছে। মোগল সাম্রাজ্যে এটা উপহারসামগ্রী হিসেবে দেয়া হতো। শিল্প বিপ্লবের পরে মসলিনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ব্রিটিশরা মসলিন বয়নশিল্পীদের হাতের আঙুল কেটে দিয়েছিল। মসলিনের পরিবর্তে তাদের বাধ্য করা হয়েছিল নীল চাষে। নতুন করে আবার মসলিন ফিরে পাবে তার মর্যাদাটি। সাঈদ খোকন বলেন, মসলিন নিয়ে অনেক গল্প কথা এবং ইতিহাস শুনেছি। কখনও দেখা হয়নি। এ আয়োজনের মাধ্যমে দেশে মসলিন ফিরে আসলে নতুন প্রজন্মসহ দেশবাসী ঐতিহ্যবাহী মসলিনকে দেখার সুযোগ পাবে। সাইফুল ইসলাম বলেন, এটা হচ্ছে সেই ভূমি যেখান থেকে আমরা আবার আমাদের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা নিয়েছি। এই অঞ্চলের তাঁতীবাজার থেকেই একদিন উৎপাদিত হতো মসলিন।
×